কেমন একটা বিচিত্র ধোয়া ধোয়া গন্ধ ঘরের বাতাসে। কোন ধরনের সুগন্ধী? বুঝতে পারল না মুসা।
ওর মুখ দেখেই অনুমান করে ফেলল যেন ক্রিসি, বোঝা যায়?
যায়। কিসের? মশার কয়েল?
না না, কয়েলের এত ভাল গন্ধ হয় নাকি। ও তো দম আটকে দেয়। এটা ধূপের গন্ধ। ইনডিয়ায় খুব ব্যবহার এটার, জানো: বোধহয়। মশা তাড়াতে কাজ করে ধূপের ধোয়া। আরও নানা কাজে, বিশেষ করে দেবদেবীর পূজায় ব্যবহার করে ওরা এই জিনিস।
এখানে তো মশা নেই। আপনি কিসের পূজা করেন?
হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ক্রিসি। করি যেটারই হোক। কফি খাবে?
দিতে পারেন। মাথাটা খুব ধরেছে।
দুধ দিয়ে না দুধ ছাড়া?
দুধ দিয়ে। চিনি দেবেন বেশি করে যাতে তেতোটা না থাকে।
রিফ্রিজারেটরের দিকে ঘুরল ক্রিসি। আমি খাই খুব কড়া। দুধ চিনি ছাড়া। আর এত গরম, জ্বলতে জ্বলতে ভেতরে নামে। কি, অবাক লাগছে শুনতে? হাসপাতালের সব নার্সই এরকম খায়। নাইট ডিউটি করতে হয় যে।
হাসপাতালে আসলে কাজটা কি করেন আপনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
এই নানা রকম টুকটাক কাজ, দুধ আর চিনি বের করে আনল ক্রিসি। একটা কাপও আনল। পট থেকে কফি ঢেলে তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে ঠেলে দিল মুসার দিকে। বাজে চাকরি। ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছি আমি।
সেটা কি ঠিক হবে?
মুসার মুখোমুখি বসল ক্রিসি। সবুজ চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, কেন হবে না?
ঘরের জিনিসপত্রের দিকে ইঙ্গিত করল মুসা, বেতন তো ভালই পান মনে হচ্ছে। নাকি বাবার টাকা আছে?
বাবার টাকাই বলতে পারো, মগ তুলে কফিতে চুমুক দিল ক্রিসি। দেখা হওয়ার পর থেকেই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। তুমি ফোন করবে জানতাম।
কি করে জানলেন?
অনুমান। খেলোয়াড়রা চায় ওষুধপত্র খেয়ে, ম্যাসাজ করে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগ আর ব্যথা কমিয়ে ফেলতে। খেলার মাঠ ছাড়া থাকতে পারে না তো।
হেসে ফেলল মুসা। ঠিকই বলেছেন। এখন কোত্থেকে এসেছি জানেন? মাঠ থেকে। দিনের বেলা এমন দৌড়ান দৌড়েছি…তারপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম গাছের নিচে। এক ঘুমে পার করে দিয়েছি সারাটা দিন।
হাসল ক্রিসি। কফিটা শেষ করো। তারপর শুরু করছি।
.
০৭.
পার্ক থেকে ফেরার পর গুম হয়ে বাড়িতে বসে রইল রবিন। একা বাড়িতে কিছুই ভাল লাগছে না। খেতে ইচ্ছে করছে না। টিভি দেখতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি বই পড়তেও ভাল লাগছে না। না খেলে শরীর ভেঙে পড়বে। তাই সামান্য কিছু মুখে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মুসার মতই আগের রাতটায় তারও ঘুম হয়নি।
বিকেলে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। ক্লান্ত, ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল। হালো?
ওপাশের কণ্ঠটা শুনে সচকিত হয়ে উঠল মুহূর্তে। কিশোর! ফিরেছ! কখন?
এই তো খানিক আগে। মুসাদের বাড়িতে ফোন করলাম। পেলাম না। ও কোথায়, জানো নাকি?
কিশোর, উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে রবিন। অনেক কথা আছে। তুমি তো ছিলে না, জানোও না। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। এখুনি। ইয়ার্ডে আসছি আমি। তুমি কোথাও বেরিয়ো না।
এসো। বেরোব না।
.
হু, ভাল বিপদেই পড়েছ! আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। পুলিশের কাছে না যাওয়াটাই বোকামি হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ভুল। ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের কাছে গিয়ে খুলে বলতে পারতে।
কি করব? রবিন বলল। সবাই এমন বিরোধিতা শুরু করল, বাধা দিতে লাগল, কিছুই করতে পারলাম না। অ্যাক্সিডেন্টটা করে ড্যানি তো পুরোপুরি বোকা হয়ে গিয়েছিল। কথাই বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে জঞ্জালের নিচে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে মুখোমুখি বসে আছে দুজনে। কিশোর বসেছে ডেস্কের ওপাশে তার চেয়ারে। অন্যপাশে একটা টুলে পিঠ বাকা করে বসেছে রবিন।
ওই সব ঘোড়ার ডিম কনসার্টগুলো এই জন্যেই আমার ভাল লাগে না, মুখ বাকিয়ে বলল কিশোর। কোন আনন্দ তো নেইই, যত রাজ্যের হট্টগোল আর পাগলামি। গায়কদের দেখে মনে হয় না ওরা কোন সুস্থ লোক। সব যেন উন্মাদ। ওসব দেখে বেরোলে কোন লোকের মাথা ঠিক থাকে? ড্যানি তো সহ্য করতে পারে না জানোই, গাড়ি চালাতে দিলে কেন?
সেটাও হয়ে গেছে আরেক বোকামি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। যা হবার তা হয়েছে। এখন কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, তাই বলো? পুলিশের কাছে যাব?
ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। কয়েক সেকেন্ড পর মাথা ঝাঁকাল, যেতে তো হবেই। সঙ্গে সঙ্গে গেলে শুধু ড্যানির। শাস্তি হত, জেলে যেত সে একা। তবে তোমরা বেঁচে যেতে…
সেজন্যেই তো গেলাম না।
কিন্তু এখন সবাইকে জেলে যেতে হবে। ড্যানি যাবে অ্যাক্সিডেন্ট করে খুন করার অপরাধে, আর তোমরা যাবে লাশ গুম করতে তাকে সহযোগিতা আর সত্য গোপন রাখার অপরাধে। বাঁচতে আর কেউ পারবে না।
না পারলে নেই। জেলে গিয়ে বসে থাকা বরং অনেক ভাল। একে তো অপরাধ করে মানসিক চাপে ভুগছি, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই তত্ত্বাবধায়কের যন্ত্রণা। সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। শীঘ্রি এ থেকে মুক্তি না পেলে পাগল হয়ে যাব।
চুপ করে ভাবতে লাগল কিশোর।
অধৈর্য হয়ে উঠল রবিন, কি ভাবছ?
উ! ঠোঁট থেকে আঙুল সরাল কিশোর। পুলিশের কাছে তো যেতেই হবে। ভাবছি, নিজেরা আগে একবার তদন্ত করে দেখলে কেমন হয়।