গতরাতে কখন ফিরেছিল? মনে করতে পারল না মুসা। বাড়ি ঢুকে ঘড়ি দেখেনি। সিনেমা দেখে, টনি আর আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিল কার্নিভলে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে তখন। মাঠ অন্ধকার।
মাঝরাতের পরই হবে, এটা ঠিক। কারণ নাইট শো দেখেছে। তার সঙ্গে জিনা আর রিকিকে না দেখে প্রশ্ন চেপে রাখতে পারেনি টনি। জিনার কি হয়েছ, বলো তো?
কি জানি! কেন? জানতে চেয়েছে মুসা।
অন্য একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা। আমাদের চেয়ে বয়েস বেশি। এ শহরের লোক নয়। আর রিকি ঘোরে একটা মেয়ের সঙ্গে। তাকেও এ শহরের ছেলেমেয়েরা কেউ কখনও দেখেনি। ঘটনাটা কি, বলো তো?
কি জানি! যার যেখানে ইচ্ছে ঘুরুক। আমি কি ওদের গাজেন নাকি?
না, তা বলছি না। তবু…
দেখো, এ শহরের লোক নয় বলেই সন্দেহ করতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আমিও তো এখানকার লোক নই। টুরিস্ট সীজন। অপরিচিত লোক আসবেই।
আলোচনাটা আর এগোতে দেয়নি মুসা। ওখানেই চাপা দিয়েছে।
জিনার কথা ভাবতেই মনে হলো ফোন করে। দিনের বেলায়ও কি জনের সঙ্গে বেরোবে ও? কে জানে। ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বাজে। ঢকঢক করে গিলে ফেলল এক গ্লাস কমলার রস। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গলায় আটকে গেল। ব্যথা লাগল। শুকিয়ে আছে কণ্ঠনালী।
জিনাদের নম্বরে ডায়াল করল সে।
তিন-চার বার রিঙ হওয়ার পর তুলে নিলেন জিনার আম্মা। হালো?
আন্টি? আমি মুসা। জিনা কোথায়?
ঘুমোচ্ছে।
এত বেলায়? ও তো সকাল সকালই উঠে পড়ে।
কি জানি, বুঝলাম না। ঘণ্টাখানেক গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করে এসেছি। ঘুমই ভাঙে না। বলল, শরীর খারাপ লাগছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। এ রকম তো কখনও হয় না।
হু! কাল রাতে কখন ফিরেছে, জনের সঙ্গে কতক্ষণ ছিল জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল মুসার। করল না। বলল, ঘুম ভাঙলে বলবেন সৈকতে যেতে। আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি।
লাইন কেটে দিল সে। ঘাড়ের পেছনটা চুলকাল। রান্নাঘরের মধ্যে আরও গরম। ভারী, ভেজা ভেজা বাতাস।
বেজায় গরম তো আজকে। ঘরে কিংবা বাগানে না থেকে সৈকতে যাওয়াই ভাল।
রিকিকে ফোন করল। সবে উঠেছে সে। ওকে বলল সৈকতে চলে যেতে। সঙ্গে বুগি বোর্ড নিয়ো। সাগরের অবস্থা জানি না এখনও। ঢেউ থাকলে সার্ফিং জমবে আজ।
সৈকতে এসে দেখল ইতিমধ্যেই ভিড় জমিয়েছে সকালের সাঁতারুরা। ডোবাডুবি করছে, নীলচে সবুজ ছোট ঢেউ কেটে সাঁতরে যাচ্ছে এদিক ওদিক। হলুদ আর সাদা ডোরাকাটা একটা বড় ছাতার নিচে তোয়ালে বিছিয়ে শুয়ে আছে রিকি।
আই, রিকি, বলে এগিয়ে গেল মুসা।
কি খবর? ঘুমজড়িত কণ্ঠে জানতে চাইল রিকি।
বুগি বোর্ড আনোনি?
আস্তে মাথা তুলে তাকাল রিকি, ভুলে গেছি।
অধৈর্য ভঙ্গিতে নিজের বোর্ডটা হাত থেকে ছেড়ে দিল মুসা। বসে পড়ল বালিতে। পিঠে রোদ লাগছে। কাল রাতে কি করেছ? মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
হ্যাঁ, হাই তুলল রিকি। লীলার সঙ্গে শহরে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ঘোরার পর সৈকতেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজি হইনি। এত ক্লান্ত লাগছিল, সোজা বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়েছি।
ওঠো, সাঁতার কাটলেই শরীরের জড়তা চলে যাবে।
সাড়া দিল না রিকি।
অ্যাই, রিকি, চুপ করে আছ কেন?
নীরবতা।
রিকি?
মুখের ওপর ঝুঁকে ভালমত দেখে মুসা বুঝল, রিকি ঘুমিয়ে পড়েছে।
হয়েছে কি ওর? অবাক হলো মুসা। সারারাত ঘুমিয়ে সকালে সৈকতে আসতে না আসতে ঘুমিয়ে পড়ল আবার, এই হট্টগোল আর রোদের মধ্যে!
ঘুমের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিকি। গড়িয়ে গিয়ে চিত হলো।
আরও একটা ব্যাপার অবাক লাগল মুসার। কোন্ ধরনের সানট্যান ব্যবহার করে রিকি? রোদে পুড়ে চামড়া তো বাদামী হবার কথা। তা না হয়ে হচ্ছে ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য।
*
সেদিন অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লীলার দেহে। সৈকতে এসেছে খাবারের নেশায়। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে। কিন্তু কোন হোটেলে গিয়ে কিছু খেতে পারবে না। একটা জিনিস দিয়েই খিদে মেটাতে হবে।
রক্ত!
মানুষের রক্ত!
শুরু যখন করেছে, শেষ না করে উপায় নেই।
অন্যান্য রাতের মত আজও সেই উদ্দেশ্যেই বেরিয়েছে। শিকার ঠিকই করা আছে। গত কয় রাত তার রক্ত পান করেই কাটিয়েছে। আজও করবে। তবে আজ শেষ। এক শিকারে বেশিদিন চালানো যায় না। বড় জোর তিন কি চারবার রক্ত পান করা যায়। এর বেশি করতে গেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শিকার। মেরে ফেললে পুলিশ আসবে। তদন্ত হবে। ঘাবড়ে যাবে লোকে। রাতে আর সৈকতে বেরোতে চাইবে না। শিকার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই রিকিকে একেবারে মেরে ফেলতে চায় না সে। শেষবারের মত তার রক্ত খাবে আজ।
রিকির আসার অপেক্ষাই করছে লীলা।
আসতে দেখা গেল ওকে। হাত নেড়ে ডাকল লীলা।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে অনেকটা বুড়ো মানুষের মত ঝুঁকে পা টেনে টেনে এগিয়ে আসতে লাগল রিকি।
হাঁটতে শুরু করল লীলা। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল নৌকা রাখার ডকটার দিকে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। পেছনের পানিতে ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে তিনটা নৌকা। গায়ে গায়ে ঘষা খেয়ে মৃদু শব্দ তুলছে।
লীলা, কোথায় তুমি? ক্লান্তস্বরে ডাকল রিকি।
এই যে এখানে। এসো।
রিকি আরও কাছে আসতে হাত ধরে তাকে ছায়ায় টেনে নিল লীলা। গলার। শিরাটার দিকে তাকাল। দপদপ করে লাফাচ্ছে। ওটার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঘন তরল পদার্থ চুমুক দিয়ে পান করার ইচ্ছেটা পাগল করে তুলল ওকে। প্রথম প্রথম ভাল লাগত না। ঘেন্না লাগত। ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন তো বরং ভালই লাগে। নেশা হয়ে গেছে। বাঘের যেমন হয়ে যায়। আফ্রিকার মাসাইদের যেমন হয়। জ্যান্ত গুরুর শিরা ফুটো করে চুমুক দিয়ে রক্ত পান। করে ওরা।