কেমন?
বুঝতে পারছ না?
না
ঠিক বোঝাতে পারব না। মোটকথা, অন্য রকম।
পিজ্জা হাউসটায় খুব ভিড়। প্রায় সবই ওদের বয়েসী ছেলেমেয়ে। গুতোগুতি করে টেবিলে জায়গা করে নিচ্ছে। হই-হল্লা করছে।
মুসাদের দেখেই আড়ষ্ট হয়ে গেল রিকি। বোধহয় আগেই লীলাকে কিছু বলে রেখেছে, লীলাই ওদের সঙ্গে পরিচয় করে নিল, হাই, আমি লাইলাক। রিকির নতুন বন্ধু। অতএব তোমাদেরও। লীলা বলে ডাকবে।
কিন্তু নতুন বন্ধুটিকে পছন্দ করতে পারল না জিনা। লীলার বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত মিলিয়ে শুকনো গলায় বলল, হাই।
মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রিকি, পিজ্জার অর্ডার দিয়ে রেখেছি।
তোমরাও কি রকি বীচ থেকে? লীলা জানতে চাইল।
হ্যাঁ, জবাব দিল মুসা।
জিনা তাকিয়ে আছে লীলার নখের দিকে। লম্বা, নিখুঁত। সুন্দর করে নেল পালিশ লাগানো। লিপস্টিকের মত একই রঙের। রিকির দিকে কাত হয়ে বসেছে সে।
রিকির এই পরিবর্তনে অবাক হয়ে গেছে জিনা। মেয়েটার বেহায়াপনা সহ্য করছে কি করে রিকি?
ধাতব ট্রে তে করে গরম গরম পিজ্জা এল। ধোয়া উড়ছে। কেটে নিয়ে আসা হয়েছে। হাত বাড়িয়ে একটা করে টুকরো তুলে নিল মুসা, জিনা আর রিকি।
লীলা নিল না। তাকালই না প্লেটের দিকে। কৈফিয়ত দিল, পেট ভরে ডিনার খেয়ে এসেছি। একটা কণাও আর ঢোকানোর জায়গা নেই।
আরে একটু নাও না, অনুরোধ করল রিকি।
উঁহু, পারব না। খাও তোমরা।
খাবার দেখে হঠাৎ যেন কেমন হয়ে গেছে লীলা, লক্ষ করল মুসা। চোখে। ক্ষুধার্ত মানুষের দৃষ্টি। তাহলে নিচ্ছে না কেন?
জিনাও তাকিয়ে আছে লীলার চোখের দিকে। দরজার দিকে তাকিয়ে বড় বড় হয়ে যেতে দেখল ওর বাদামী চোখ।
ফিরে তাকাল জিনা। জনকে ঢুকতে দেখে তার চোখও স্থির হয়ে গেল ওর ওপর।
চোখে চোখ পড়তে হাসল জন।
মুসার গায়ে কনুই দিয়ে তো দিল জিনা। ওর সঙ্গেই কাল রাতে দেখা হয়েছিল আমার।
মুখ ভর্তি পিজ্জা চিবাতে চিবাতে ফিরে তাকাল মুসা। ও। একনজর দেখল জনকে। তারপর আবার খাবারে মন দিল।
ওদের দিকে এগিয়ে এল জন।
পরিচয় করিয়ে দিল জিনা, ও জন গুড় ওয়াকার। কাল রাতে পরিচয়।…জন, ও আমার বন্ধু মুসা। ও রিকি। আর ও লীলা, রিকির নতুন বন্ধু।
হাত মেলাল জন। একটা চেয়ারে বসল।
ট্রেটা ওর দিকে ঠেলে দিল মুসা, পিজ্জা নাও।
নো, থ্যাংকস, চেয়ারে হেলান দিল জন। এইমাত্র খেয়ে এলাম। তাকালই না খাবারের দিকে। জিনাকে জিজ্ঞেস করল, সৈকতের ধারে হাঁটতে যাবে না আজ?
জনের দিকে তাকাল জিনা। আটকে রইল চোখ। কেমন সম্মোহনী দৃষ্টি জনের চোখে। জোর করে নজর সরাতে হলো জিনাকে। মুসার দিকে তাকাল, মুসা, কি করবে?
আমি? সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যেন মুসা। তোমার কি ইচ্ছে?
হাঁটতে যেতেই ইচ্ছে করছে।
আমারও, লীলা বলল। রিকির সঙ্গে। রিকির বাহুতে হাত রাখল লীলা, রিকি, কি বলো?
ঘাড় কাত করল রিকি, ভালই হয়।
ভিডিও গেম খেলতে যাবে না?
বদ্ধ জায়গায় ঢুকতে ইচ্ছে করছে না আর আমার। হট্টগোল, মনিটরের স্ক্রীনের আলো…নাহ্! তারচেয়ে সৈকতের খোলা হাওয়া, অন্ধকারে হেঁটে বেড়ানো অনেক ভাল।
জিনার দিকে তাকাল মুসা।
মাথা নাড়ল জিনা, উঁহু, আমিও যাচ্ছি না ওই আর্কেডে। সিনেমাও ভাল লাগবে না। তারচেয়ে সাগরের খোলা হাওয়াই ভাল।
হঠাৎই আবিষ্কার করল মুসা, এখানে বড় একা হয়ে গেছে সে। ধীরে ধীরে বলল, ঠিক আছে, যাও তোমরা। দেখি, আমি বরং টনিকে খুঁজে বের করিগে। ভিডিও-গেম খেলব। ওকে না পেলে সিনেমা দেখতে যাব। একাই যাব।
দ্রুত খাওয়া শেষ করল রিকি। বেরোনোর জন্যে যেন আর তর সইছে না। ওর অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারল না মুসা। তবে বদলে যে গেছে, এ ব্যাপারে জিনার সঙ্গে এখন সে-ও একমত।
প্রায় অপরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে জিনার যাওয়াটা পছন্দ হচ্ছে না তার। কিন্তু কি করবে? যার সঙ্গে খুশি বেরোতে পারে জিনা, তাকে বাধা দেয়ার কোন অধিকার তার নেই। বাধা দিলে জিনাই বা শুনবে কেন?
খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল রিকি। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, বিল আমি দিয়ে যাচ্ছি। তুমি শেষ করেই বেরোও। জিনার দিকে ফিরল, তোমার হয়েছে?
হ্যাঁ, চলো। পেপার ন্যাপকিনে মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল জিনা।
বেরিয়ে গেল চারজনে।
দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তিত ভঙ্গিতে পিজ্জা চিবাতে লাগল মুসা। কিশোর আর রবিনের অভাবটা তীব্রভাবে বোধ করল আরেকবার। দূর, একা একা কোথাও বেড়াতে বেরিয়ে আনন্দ নেই। স্যান্ডি হোলোর মত এত চমৎকার জায়গাতেও না। একমাত্র ভরসা এখন টনি। ওকে খুঁজে বের করতে না পারলে সন্ধ্যাটাই মাটি হবে।
.
০৭.
দুদিন পর। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে, হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙল মুসা। উঠে এসে দাঁড়াল বেডরূমের জানালার সামনে। বাইরের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে চোখ মিটমিট করতে লাগল। পরিষ্কার আকাশ। গাছের মাথার ওপরে উঠে গেছে সূর্য। ঘরটা গরম, আঠা আঠা লাগছে।
আবার হাই তুলতে তুলতে ড্রেসারের দিকে এগোল সে। ড্রেসারের গায়ে ধাক্কা লাগল। ঘুম যায়নি এখনও। ড্রয়ার ঘেঁটে বের করল বেদিং স্যুট। টেনেটুনে পরে নিল কোনমতে।
দুপদাপ করে নেমে এল রান্নাঘরে। কাউন্টারে রাখা চাপা দেয়া এক টুকরো কাগজ দেখতে পেল। বাবা লিখে রেখে গেছেন। মাকে নিয়ে চলে গেছেন এক বন্ধুর বাড়িতে। দূরে কোথাও মাছ ধরতে যাবেন সকলে মিলে। ইস, আফসোস করতে লাগল মুসা। জানলে সে-ও যেতে পারত সঙ্গে। এখানে আর কোন আকর্ষণ বোধ করছে না। রিকি যেন কেমন হয়ে গেছে। জিনার সঙ্গেও জমছে না।