কফির কাপে চুমুক দিলেন মিস্টার আমান। সাংঘাতিক মানে? খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। পরিষ্কার আকাশ। ঝলমলে রোদ। ঝড়ের তো কোন লক্ষণ দেখছি না।
ঝড়ের কথা বলিনি। বড় বড় ঢেউ। বিশাল একেকটা। প্যাকেটের কোণা দাঁত দিয়ে কেটে ফুটো করে মুখে লাগাল মুসা। এক চুমুকে অর্ধেকটা খতম করে ফেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে তাকাল। বাবা, কখন উঠেছ?
দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালেন মিস্টার আমান। সাড়ে নটা বাজে। এই বিশ মিনিট। কেন?
রিকি ফোন করেছিল?
না, হাই তুললেন মিস্টার আমান। টেনিস খেলতে যাবে নাকি?
না। সাঁতার। বডিসার্ফিং। যা ঢেউ একেকখান, খুব মজা হবে। ওয়ালফোনের কাছে এসে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মুসা। নম্বর টিপতে যাবে, এই সময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন আমান, দেখো দেখো, একটা হামিংবার্ড!
রিসিভার রেখে লাফ দিয়ে এগিয়ে এল মুসা। কই? কোথায়?
ওই তো, ওই ফুলটার কাছে ছিল। মিস করলে।
কত্তবড়?
মৌমাছির সমান।
এখানে সবই মৌমাছির সমান নাকি? কাল রাতে আমার ঘরে কতগুলো নীল মাছি ঢুকেছিল। মৌমাছির সমান। এত্তবড় মাছি আর দেখিনি।
এত্ত ছোট পাখিও আর দেখিনি, ফুলগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। আমান। পাখিটাকে খুঁজছে তাঁর চোখ।
মুসাও তাকিয়ে আছে।
কফি শেষ করে কাপটা কাউন্টারে রেখে ফিরে তাকালেন আমান, রিকিকে ফোন করছিলে নাকি?
হ্যাঁ
এত সকালে? এখানে এত তাড়াতাড়ি তো কেউ ওঠে না।
রিকি আমার চেয়েও সকালে ওঠে।
আবার গিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল মুসা।
অনেকক্ষণ রিঙ হওয়ার পর ধরলেন রিকির আম্মা।
আন্টি, আমি মুসা। রিকি কোথায়?
অ, তুমি। বাগান থেকে রিঙ হচ্ছে শুনলাম। এসে ধরতে দেরি হয়ে গেল।…রিকি তো এখনও ওঠেনি। কাল রাতে দেরি করে ফিরেছে। দাঁড়াও, দেখে আসি।
আলসেমি রোগে ধরল নাকি ওকে! আনমনে বলল মুসা। ঘড়ির দিকে তাকাল। সব সময় ভোরে ওঠা রিকির অভ্যেস। পৌনে দশটা পর্যন্ত কখনও বিছানায় থাকে না।
রিসিভার ধরেই আছে মুসা। অনেকক্ষণ পর পায়ের শব্দ শুনল। খুটখাট শব্দ। ভেসে এল রিকির ঘুমজড়ানো, খসখসে ভারী কণ্ঠ, হালো!
রিকি? ঘুম থেকে উঠে এলে নাকি?
নীরবতা। হ্যাঁ। হাই তোলার শব্দ।
কাল রাতে কোথায় ছিলে?
গলা পরিষ্কার করে নিল রিকি, একটা মেয়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম।
খাইছে! কি বললে? বিস্ময় চাপা দিতে পারল না মুসা।
মেয়েটা অদ্ভুত, বুঝলে। ওর সঙ্গে হাঁটতে, কথা বলতে, একটুও সঙ্কোচ হচ্ছিল না আমার।
তোমাদের হলো কি! তুমি গেলে একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে, জিনা গেল একটা ছেলের সঙ্গে হ্যাঁ, তারপর?
ঘুমজড়িত কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠল রিকি।
আই রিকি, শুনতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ। কি জানি হয়েছে আমার। কিছুতেই চোখ টেনে খুলে রাখতে পারছি না। ঘুম যাচ্ছেই না।
জাহান্নামে যাক তোমার ঘুম। মেয়েটা কে?
লীলা। খুব ভাল মেয়ে। না দেখলে বুঝবে না। আমার সঙ্গে এত ভাল আচরণ করল। আমাকে ব্যঙ্গ করল না, ইয়ার্কি মারল না। ওর সঙ্গে কথা বলতে কোন অসুবিধেই হয়নি আমার।
ভাল। তা-ও যে আড়ষ্টতাটা দূর হচ্ছে তোমার..সৈকতে যাবে না?
নাহ। পারব না। শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। দুর্বলও লাগছে খুব। রাতে কুয়াশার মধ্যে ঘোরাঘুরি করেছি অনেক। জ্বরটর আসবে নাকি বুঝতে পারছি না। এলে বিপদে পড়ে যাব।
কিসের বিপদ?
লীলাকে কথা দিয়েছি, আজ রাতে ওকে নিয়ে শহরে ঘুরতে বেরোব। তুমি আর জিনাও চলে এসো।
আসব। তোমার শরীর কি খুবই খারাপ? যা দারুণ ঢেউ দেখে এলাম। সার্ফিঙে না গেলে মিস করবে।
পারছি না, ভাই। সত্যি খুব দুর্বল লাগছে। এত ঘুম আমার জীবনেও পায়নি। রিসিভার ধরে রাখতে পারছি না। রাখি, আঁ? রাতে দেখা হবে।
মুসা জবাব দেয়ার আগেই লাইন কেটে গেল।
রিসিভার রেখে ভাবতে লাগল মুসা, কার সঙ্গে সার্ফিঙে যাওয়া যায়? টনির কথা মনে পড়ল।
ফোন করল। কিন্তু বহুক্ষণ চেষ্টা করেও পেল না ওকে। ফোন ধরল না কেউ টনিদের বাড়িতে।
তারপর করল জিনাকে। জিনার আম্মা ধরলেন। জানালেন, জিনা। বাথরূমে। দিনের বেলা কোথাও বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। ঘরের কাজ আছে। এত বেশি জঞ্জাল, সাফ করতে করতেই বেলা গড়াবে।
হতাশ হয়ে শেষে জানালার কাছে এসে দাঁড়লি সে। বাবা বাগানে ফুলগাছগুলোর কাছে ঘোরাঘুরি করছেন। হামিংবার্ডটাকে আবার দেখার আশা ছাড়তে পারেননি এখনও। মনেপ্রাণে তিনি একজন নেচারালিস্ট। জন্তু জানোয়ার ধরতে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে কত জায়গায় যে গিয়েছেন। আমাজানের জঙ্গলেও গিয়েছিলেন একবার।
বাইরে বেরোল মুসা। আর কোন উপায় না দেখে বাবাকেই পাকড়াও করল। বাবা, সাঁতার কাটতে যাবে না? এক মিনিট দাঁড়াও। আমি স্যুটটা পরে আসি।
ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন মিস্টার আমান। ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে, কেন, কাউকে জোগাড় করতে পারলে না। সাগরে যখন ঢেউ বেশি, সাঁতার কাটতে না-ই বা গেলাম আজ। বরং এক কাজ করি চলো। হামিংবার্ড আর প্রজাপতির ছবি তুলেই কাটাই। একটা দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতিও দেখলাম ওদিকের ঝোপটায়। ধরতে পারলে মন্দ হয় না।
০৬.
রাত আটটার সামান্য পরে জিনাকে নিয়ে পিজ্জা কোভে ঢুকল মুসা। একটা টেবিলে বসে থাকতে দেখল রিকি আর লীলাকে।
রিকিকে অমন লাগছে কেন? মুসার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল জিনা।