এতই ঠাণ্ডা, জিনার মনে হলো বরফের ছোঁয়া লেগেছে ওর হাতে। অনেক পুরানো নাম। তোমার পোশাকও খুব পুরানো আমলের।
মাথা ঝাঁকাল জন, হ্যাঁ। পুরানো আমলই আমার পছন্দ। এখনকার কোন কিছু ভাল লাগে না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল দুজনে।
ঘড়ি দেখল জিনা। পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
তোমার বন্ধু আসবে তো? জিজ্ঞেস করল জন। এখানেই দেখা করার কথা?
মাথা ঝাঁকাল জিনা, হ্যাঁ, আর্কেডের সামনেই থাকতে বলেছে। শহরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সৈকতে যাওয়ার কথা আমাদের। কি হলো ওর বুঝতে পারছি না!
দেখোগে, দেরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখানে তোমাকে পাবে না ভেবে সরাসরি সৈকতেই চলে গেছে।
তাই তো! একথাটা তো ভাবেনি এতক্ষণ।
আজ রাতে বেশি ভিড় থাকবে না সৈকতে, আবার বলল জন। অনেকেই কুয়াশা পছন্দ করে না। ওকে খুঁজে বের করতে সময় লাগবে না।
তা ঠিক, জিনার কণ্ঠে অনিশ্চয়তা। কিন্তু যা অন্ধকার…
চলো, আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে। আমার কোন কাজ নেই। ঘুরতেই বেরিয়েছিলাম…
কিন্তু…
আরে, চলো। এই এলাকা আমার মুখস্থ। দশ মিনিটও লাগবে না ওকে খুঁজে বের করতে।
কোন রকম প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে জিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল জুন।
পথের মোড় ঘুরে ডিউন লেনে পড়ল ওরা। সোজা এগোল সাগরের দিকে। অবাক লাগল জিনার, যতই সৈকতের কাছাকাছি হচ্ছে, পাতলা হচ্ছে কুয়াশা।
জিনার মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন জবাব দিল জন, স্যান্ডি হোলো শহরটা অনেক নিচুতে, অনেকটা গিরিখাতের মত জায়গায়। এতে হয় কি, সাগর থেকে কুয়াশা এসে একবার চড়াও হলে বদ্ধ জায়গায় আটকে যায়, আর সরতে চায় না।
তুমি কি ভূগোলের ছাত্র?
নাহ। ব্যাপারটা জানি আর কি।
সৈকতের কিনার থেকে সাগরের বেশ খানিকটা ভেতর পর্যন্ত আকাশে ভারী, ধূসর মেঘ। কিন্তু কুয়াশা প্রায় নেই। বড় বড় ঢেউ আছড়ে ভাঙছে তীরে। অন্ধকারেও ঢেউয়ের মাথার সাদা ফেনা চোখে পড়ছে।
পানির কিনারে হাঁটছে কয়েক জোড়া দম্পতি। খানিক দূরে পানির বেশ কিছুটা ওপরে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে কতগুলো ছেলেমেয়ে। উঁচুস্বরে টেপ আর রেডিও বাজছে।
কাছে গিয়ে দেখল জিনা। মুসাও নেই, রিকিও না।
তাতে হতাশ হলো না দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল জিনা। তারমানে জনের সঙ্গ তার খারাপ লাগছে না। পানির কিনার ধরে পাশাপাশি হেঁটে চলল দুজনে। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে জন। অনেক কিছু জানে। একটা তিমির গল্প বলল। পথ হারিয়ে বসন্তের শুরুতে নাকি তীরের একটা অল্প পানির খড়িতে এসে আটকে গিয়েছিল। ওটার বন্দি চেহারার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে ছবিটা দেখিয়ে দিল জিনাকে। শহরের লোকে বহু কষ্টে খোলা সাগরে বের করে দিয়েছিল আবার তিমিটাকে।
কথা বলতে বলতে কখন যে ওরা দক্ষিণের পাহাড়ের দিকে ঘুরে গেছে, বলতে পারবে না। হঠাৎ লক্ষ করল জিনা, পানির ধার থেকে তীরের অনেক ভেতরে চলে এসেছে। সামনেই পাথরের পাহাড়।
একপাশে বেশ খানিকটা দূরে বোট ডক। ঢেউয়ের গর্জন বেড়েছে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জিনা। এত নির্জনতা তার পছন্দ হচ্ছে না।
কই, সমস্ত সৈকতই তো চষে ফেললাম, যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই সহজ কণ্ঠে বলল জন। তোমার বন্ধুকে তো পাওয়া গেল না। বেরোয়ইনি হয়তো বাড়ি থেকে।
চলো, ফিরে যাই, পা বাড়াতে গেল জিনা।
দাঁড়াও না, ভালই তো লাগছে। থাকি আরেকটু।
নাহ, আমার ভাল লাগছে না।
সামনে এসে দাঁড়াল জন। মুখোমুখি হলো। হাতটা চলে এল জিনার নাকের কাছে।
অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে ঢুকল জিনার। বডি স্প্রের নয়। আফটার শেভ লোশন? হবে হয়তো। কোন্ ব্র্যান্ডের লোশন ব্যবহার করে জন, জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল জিনা, এই সময় চোখ চলে গেল ওপর দিকে। মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে যেতে দেখল কয়েকটা বাদুড়কে।
এখানে অতিরিক্ত বাদুড়!
বাদুড়কে ভয় পাও নাকি?
মুখ নামাল জিনা। ভয় পাব কেন?
না, এমনি। বাদুড়ের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের সম্পর্ক আছে কিনা। স্যান্ডি হোলোতে কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের গুজব আছে। মানুষকে আক্রমণ করার কথাও শোনা যায়।
দূর, ওসব ফালতু কিচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি না।
যখন পড়বে ওদের কবলে, তখন বুঝবে মজা, রহস্যময় কণ্ঠে বলে হাসতে লাগল জন। আবার হাত বাড়াল জিনার নাকের কাছে।
মিষ্টি গন্ধ পেল জিনা। কিসের গন্ধ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে এবারও জিজ্ঞেস করা হলো না। কথা শোনা গেল। বাকের আড়াল থেকে বেশ জোরেই কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এল একজোড়া দম্পতি। ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। মুখ ফিরিয়ে তাকাল। জিনা আর জনের উদ্দেশে হাত নাড়ল মহিলা।
জিনাও হাত নেড়ে জবাব দিল। জনের হাত ধরে টানল, এসো। এখানে। আর ভাল লাগছে না আমার।
মনে হলো, দম্পতিরা আসাতে নিরাশ হয়েছে জন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, চলো।
.
০৫.
সাগরের কি অবস্থা? জানতে চাইলেন মিস্টার আমান। পরনে বেদিং স্যুট। রান্নাঘরের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কাপে কফি ঢালছেন। চোখে এখনও ঘুম।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল মুসা। বাবা-মা তখনও ঘুমে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সৈকতে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি সেরে সবে ফিরেছে।
সাংঘাতিক, বলে, টান দিয়ে ফ্রিজের ডালা খুলল মুসা। কমলার রসের প্যাকেট বের করল।