রিকির কব্জিতে চেপে বসল মেয়েটার আঙুল। মৃদু হাসল। তাহলে তো আমরা বন্ধু হতে পারি।
তা পারি, মনে মনে বলল রিকি। মুখ দিয়ে বের করতে পারল না।
কোন শহর থেকে এসেছ তুমি? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
রকি বীচ।
পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে। বালিয়াড়ির পাশ থেকে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। কথা বলতে বলতে পানির দিকে টেনে নিয়ে চলেছে ওকে মেয়েটা। তবে টানটা দিচ্ছে বড়ই আস্তে, হাঁটছে ধীরে ধীরে।
পানির কিনারে কুণ্ডলী পাকানো কুয়াশা।
লাইলাক ফুলের গন্ধ থেকে থেকেই নাকে ঢুকছে রিকির।
ওই দেখো, কেমন সুন্দর কুয়াশা, ঘন একটা কুণ্ডলীর দিকে হাত তুলে বলল মেয়েটা। ঢুকে দেখবে নাকি কুয়াশার মধ্যে কেমন লাগে?
রিকির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ করছে: যেয়ো না, যেয়ো না! কিন্তু বাধা দিয়ে। নিজেকে রুখতে পারল না রিকি। এড়াতে পারল না মেয়েটার হাতের টান। আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ঘন কুয়াশার মধ্যে। এতই ঘন, দুই হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ে না। এরই মধ্যে একটা ঝিলিমিলি ছায়ার মত মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে সে।
নাকের কাছে দুলে উঠল কি যেন। বুঝতে পারল না রিকি। লাইলাকের মিষ্টি গন্ধটা তীব্রতর হলো। তার সঙ্গে মিশে গেছে ঝাঝাল আরেকটা কি রকম। গন্ধ।
বোঁ করে আবার চক্কর দিল মাথাটা। এবার আর গেল না অদ্ভুত অনুভূতিটা। এরই মধ্যে টের পেল গলায় নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। পরক্ষণে কুট করে চামড়ায় তীক্ষ্ণ সুচ বেঁধার মত যন্ত্রণা।
একটা মুহূর্ত মাথার ভেতরে-বাইরে সমানে পাক খেতে থাকল.যেন ভেজা কুয়াশা। তারপর অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার।
.
০৪.
কোথায় ও?
আর্কেডের ভেতরের সরু গলি ধরে এগিয়ে চলল জিনা। গিজগিজে ভিড়। বোমা বিস্ফোরণ, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি, মহাকাশ যুদ্ধ আর রেসিং কার ছুটে চলার শব্দে ছোট্ট, স্বল্পালোকিত ঘরটায় কান পাতা দায়।
এখানে নেই।
কোথায়?
আর্কেডের পেছনে পিনবল মেশিন নিয়ে যেখানে খেলা চলছে সেখানেও নেই।
রাস্তায় বেরিয়ে এল জিনা। খোলা বাতাসে বেরিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাচল। অত বদ্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন মজা যে পায় ওই ছেলেগুলো! ভিডিও গেম খেলার নেশাটা আগে ছিল না মুসার, ইদানীং ধরেছে। কিশোর আর রবিনের কথা ভেবে আরেকবার আফসোস করল জিনা। ওরা থাকলে এই একাকিত্বে ভুগতে হত না। মুসাও নিশ্চয় খেলা নিয়ে মেতে উঠত না এতটা।
মুসাকে দোষ দিল না সে। মেয়েমানুষের সঙ্গে সারাক্ষণ যদি থাকতে না চায়, কিছু বলার নেই। আর তার নিজের মুশকিল হলো, সে নিজে মেয়ে হয়েও মেয়েদের সঙ্গ তেমন পছন্দ করে না।
দূর! কাজ নেই, কর্ম নেই, কথা বলার মানুষ নেই; এই বেড়ানোর কোন মানে হয় নাকি? রকি বীচে ফিরে যাবে কিনা ভাবতে শুরু করল সে।
সাগর থেকে ভেসে আসছে কুয়াশার কুণ্ডলী। অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পথের ওপর। রাস্তার আলোর আশেপাশে বিচিত্র ছায়া তৈরি করছে। মেইন রোডের পাশের দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোর দিকে তাকাল। জিনা। প্রচুর ভিড়। কুয়াশার মধ্যে মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে দল বেঁধে উড়ছে।
ঘন হচ্ছে কুয়াশা। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঢেকে ফেলবে সব কিছু। প্রিন্সেস শপিং মলের পাশে আইসক্রীম পারলারটার দিকে এগোল সে।
পেল না এখানেও। আশ্চর্য! মুসারও দেখা নেই, রিকিরও কোন খবর নেই। গেল কোথায় ওরা? আশেপাশেই তো থাকার কথা। এ সময় বাসায় ঘরে বসে আছে, এটাও বিশ্বাস করতে পারল না। ভুল করেছে। মুসাদের কটেজটা হয়ে এলে পারত।
হাই, জিনা!
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল জিনা।
না, মুসা নয়। আগের রাতে সৈকতে আগুনের ধারে পরিচয় হওয়া একটা ছেলে। সঙ্গে আরেকজন। দুজনেই ওর দিকে হাত নেড়ে চলে গেল সামনের দিকে। হারিয়ে গেল ঘন কুয়াশায়।
বাড়ি থেকে বেরোতে বোধহয় দেরি করে ফেলেছে মুসা। চলে আসবে এখুনি, ভেবে, একটা স্ট্রীটল্যাম্পের নিচে গিয়ে দাঁড়াল জিনা। হঠাৎ বিচিত্র এক অনুভূতি হলো-কেউ নজর রাখছে ওর ওপর।
ফিরে তাকাতে দেখল, ঠিক ছায়া থেকে বেরিয়ে এল একটা ছেলে। ওর চেয়ে বছর দুতিনের বড় হবে। তরুণই বলা চলে। হালকা-পাতলা শরীর, তবে রোগা বলা যাবে না। গায়ে কালো সোয়েটশাট, পরনে গাঢ় রঙের মোটা সূতী কাপড়ের প্যান্ট। ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল। কাছে এসে দাঁড়াল। অপূর্ব সুন্দর কৌতূহলী দুটো কালো চোখের দৃষ্টিতে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দেখল, জিনাকে। সিনেমার নায়ক কিংবা দামী মডেল হবার উপযুক্ত চেহারা। হেসে জিজ্ঞেস করল, কারও জন্যে অপেক্ষা করছ বুঝি?
এক পা পিছিয়ে গেল জিনা।
ও। সরি। বিরক্ত করলাম, তাড়াতাড়ি বলল ছেলেটা। এ শহরের বাসিন্দা। নয় ও, চামড়াই বলে দিচ্ছে। ফ্যাকাসে সাদা। এখানকার মানুষের চামড়া রোদে পুড়ে পুড়ে সব তামাটে হয়ে গেছে।
না না, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বলল জিনা। এই কুয়াশার মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে না। সঙ্গী পেলে মন্দ হয় না। আটকাতে চাইল ছেলেটাকে, আপনি এখানে এই প্রথম এলেন?
তুমি করেই বলো। আপনি শুনতে ভাল্লাগে না। মাথা নাড়ল, না, আরও বহুবার এসেছি।…দেখো, কি কুয়াশা! এ রকম আর কখনও দেখিনি এখানে।
আমিও না, হাত বাড়িয়ে দিল জিনা, আমি জরজিনা পারকার। জিনা বললেই চলবে।
জন গুডওয়াকার, জিনার হাত চেপে ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকি দিয়েই ছেড়ে দিল ছেলেটা।