কতক্ষণ এভাবে ছিল বলতে পারবে না। হুশ হলো, যখন অস্পষ্ট হয়ে এল। দ্বীপটা। তাকিয়ে দেখল, নিচে নেমে আসছে মেঘ। চাঁদ ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগের রূপালী সৈকতটাকে লাগছে লম্বা, ধূসর একটা ছায়ার মত। বিচিত্র। অদ্ভুত। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মত পাক খেয়ে খেয়ে সাগরের দিক থেকে উড়ে আসতে শুরু করেছে কুয়াশা। বাতাস ভেজা, ঠাণ্ডা, ভারী।
মুসারা কি চলে গেছে? না বোধহয়। ওকে ফেলে যাবে না।
সুন্দর জায়গা। চমৎকার পরিবেশ। সবাই কেমন আনন্দ করে কাটাচ্ছে। কিন্তু ও পারে না। নিজের ওপর রাগ হলো রিকির। কেন মিশতে পারে না মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করতে হবে এখন থেকে। কিন্তু নিজের কথায় নিজেরই আস্থা নেই। বহুবার এরকম কথা দিয়েছে নিজেকে, চেষ্টাও করেনি তা নয়, কিন্তু পারেনি। এইবার পারতে হবে, পারতেই হবে নিজেকে বুঝিয়ে পাথর থেকে নামতে যাবে, এই সময় ফড়ফড় শব্দ হলো মাথার ওপর।
মুখ তুলে দেখল, অনেকগুলো বাদুড় উড়ে এসেছে পাহাড়ের দিক থেকে। বিচিত্র ভঙ্গিতে ডানা ঝাঁপটে রওনা হয়েছে যেন মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
বাদুড়েরা খুব ভাল প্রাণী, নিজেকে বোঝাল সে। ওরা পোকামাকড় খায়। খেয়ে মানুষের উপকার করে।
কিন্তু বাদুড়ের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ আর তীক্ষ্ণ চিৎকার এখন ভাল লাগল না তার কাছে। মেরুদণ্ডে শিহরণ তুলল।
আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না। তাড়াহুড়ো করে নেমে এল নিচের কুয়াশা পড়া ভেজা বালিতে। নেমেই থমকে দাঁড়াল।
সে একা নয়। আরও কেউ আছে।
ওর পেছনে। পাথরের চাঙড়ের আড়ালে।
দেখার চেষ্টা করেও দেখতে পেল না। কিন্তু মন বলছে, আছে।
মাথার ওপর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ বাড়ছে। ঝাঁকে ঝাকে বাদুড় উড়ে আসছে এখন পাহাড়ের দিক থেকে। অনেক নিচ দিয়ে উড়ছে। চলে যাচ্ছে সাগরের ওপরে নেমে আসা মেঘের দিকে। ওর গায়ে এসে ঝাঁপটা মারছে নোনা পানির কণা মেশানো ঝোড়ো বাতাস।
চোখের কোণ দিয়ে নড়াচড়া লক্ষ করে ঝট করে পাশে ঘুরে গেল রিকি। দেখতে পেল মেয়েটাকে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কয়েক ফুট দূরে একটা পাথরের ওপর দাঁড়ানো। খালি পা।
ওকে তাকাতে দেখে নড়ে উঠল মেয়েটা। নিঃশব্দে পাথর থেকে নেমে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
সুন্দরী। খুব সুন্দরী মেয়েটা। মেঘে ঢাকা চাঁদের আবছা আলোতেও ওর রূপ যেন ঝলমল করছে। রিকিরই বয়েসী হবে। কিংবা দুএক বছরের বড়।
হাই, মোলায়েম, মধুঝরা মিষ্টি কণ্ঠে ডাক দিল মেয়েটা। ডাগর কালো চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে। বড় বড় ফুল ছাপা কাপড়ে তৈরি সারং স্কার্ট পরনে, তার সঙ্গে ম্যাচ করা বিকিনি টপ। ঝাঁকি দিয়ে কাঁধে সরিয়ে দিল মুখে এসে পড়া লম্বা লাল চুল। হাসল রিকির দিকে তাকিয়ে।
হাই! বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে রিকির। সবার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করবে-খানিক আগে নিজেকে দেয়া এই কথাটা বেমালুম ভুলে গেল। মানুষ! অপরিচিত! তার ওপর মেয়েমানুষ! ইস, বালি ফাঁক হয়ে যদি গর্ত হয়ে যেত এখন, তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে রেহাই পেত সে।
আমি পথ হারিয়েছি, কাছে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। পারফিউমের গন্ধ লাগল রিকির নাকে। লাইলাক ফুলের মিষ্টি সুবাস।
আ! কি হারিয়েছেন?
পথ। আপনি আপনি করছ কেন? আমি তোমার বয়েসীই হব।
প-প-প্লথ হারিয়েছেন…মানে, হা-হা-হারিয়েছ… ঢোক গিলল রিকি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, বেড়াতে এসেছি আমরা। বাবা কটেজ ভাড়া নিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম ওইই পাহাড়ের দিকে, হাত তুলে দেখাল মেয়েটা। হাতির দাঁতের মত ফ্যাকাসে সাদা চামড়া। এখন আর বুঝতে পারছি না। কোনদিকে গেলে বাসাটা পাওয়া যাবে।
আমি..মানে… কথা বলার জন্যে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল রিকি। মনে মনে ধমক লাগাল নিজেকে-এই ব্যাটা, স্বাভাবিক হ! কথা,বল ঠিকমত! এবং ধমকের চোটেই যেন হড়হড় করে শব্দগুলো বেরিয়ে এল মুখ থেকে,
বেশির ভাগ সামার হাউসই ওই ওদিকটাতে।
ওদিকে ফিরে তাকাল মেয়েটা। দ্বিধা করছে।
যাবে আমার সঙ্গে? ওদিকেই যাব।
থ্যাংকস, বলে রিকিকে অবাক করে দিয়ে আন্তরিকতা দেখানোর জন্যে ওর একটা হাত ধরে টান দিল মেয়েটা। চলো।
এক ঝলক কড়া মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে ঢুকল। বোঁ করে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল রিকির। অবশ হয়ে আসছে হাত-পা। জোর করে ছাড়িয়ে নেয়ার সাহস, শক্তি, কোনটাই পেল না। অদ্ভুত অনুভূতি। তাকে বাদ দিয়েই যেন পা দুটো চলতে শুরু করল মেয়েটার সঙ্গে।
এদিকে এই প্রথম এলাম। সুন্দর জায়গা। ছুটিটা এবার খুব ভাল কাটবে, মেয়েটা বলল।
অ্যাঁ!..হ্যাঁ। খুব ভাল।
ফিরে তাকাল মেয়েটা। আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছ কেন এমন কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ নাকি তোমার?
মেয়েটার কুঁচকানো ভুরু আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে তাকানোর সাহস হলো না রিকির। আরেকদিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, কই, না তো! অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি তো, বোধহয় ঠাণ্ডা লেগেছে।
হ্যাঁ, তা লাগতে পারে। ঠাণ্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে খুব। কুয়াশাও কি রকম করে ছুটে আসছে। অবাক কাণ্ডই। সন্ধ্যায় যখন বেরিয়েছি, রীতিমত গরম ছিল।
ওই পাহাড়ে গিয়েছিলে কি করতে? একা একা তোমার ভয় করে না?
না। তোমার করে?
না। একা থাকতেই আমার বরং ভাল লাগে।
আমারও।
এই একটা কথাতেই আড়ষ্টতা অনেকখানি কেটে গেল রিকির। হয়তো। নিজের সঙ্গে মেয়েটার মিল খুঁজে পেয়েই। ভেবে নিল, মেয়েটাও লাজুক, সে ও লাজুক। যদিও আড়ষ্টতার ছিটেফোঁটাও নেই মেয়েটার মধ্যে।