বাহ, দারুণ খেলা তো, রোমাঞ্চকর মনে হলো জিনার।
অবাক হয়ে রিকির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। এই খেলা তোমার পছন্দ?
না না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল রিকি। ওটা কোন খেলা হলো নাকি? এত ভয় পেতে কে চায়? বিপদও কম না!
নাগরদোলাও আমার ভাল লাগে, অন্ধকার মাঠের দৈত্যটার দিকে তাকিয়ে আছে জিনা।
ওসব পোলাপানের খেলা, মুসা বলল। এর মধ্যে উত্তেজনার কি আছে?
সব কিছুতেই উত্তেজনা দরকার হয় নাকি? খেলা খেলাই। মজা পাওয়াটা আসল কথা।
জিনার হাত ধরে টানল মুসা, দেখা তো হলো। চলো, সৈকতে। এখানে বিরক্ত লাগছে আমার।
পরিষ্কার রাতের আকাশ। উজ্জ্বল। মেঘমুক্ত। জ্যোৎস্নায় বালির সৈকতটাকে লাগছে চওড়া, রূপালী ফিতের মত।
পানির কিনার দিয়ে হাত ধরাধরি করে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে নারী পুরুষ। গোড়ালিতে মৃদু বাড়ি খাচ্ছে ঢেউ। পাউডারের মত মিহি বালিতে চাদর বিছিয়ে বসে হাসাহাসি করছে, গান গাইছে, চেঁচিয়ে কথা বলছে ছেলেমেয়েরা। কেউ বাজাচ্ছে টেপ। ড্রামের ভারী গুমগুম শব্দ তুলে বাজছে রক মিউজিক। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রেডিওর গান। ঢেকে দিচ্ছে সৈকতে ক্রমাগত আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎছল শব্দকে।
বালিয়াড়ির গোড়ায় আগুন জ্বেলে বসেছে কয়েকটা ছেলেমেয়ে। বালির ওপর দিয়ে ওদের দিকে খালি পায়ে হাঁটতে গিয়ে কয়েকজনকে চিনতে পারল মুসা আর জিনা। স্যান্ডি হোলোরই বাসিন্দা ওরা। আগের বার বেড়াতে এসে পরিচয় হয়েছে।
হাই, টনি, ডাক দিল মুসা।
ফিরে তাকাল টনি হাওয়াই। আগুনের আলো আর ছায়া নাচছে ছেলেটার চোখেমুখে। বেশ লম্বা। খাটো করে ছাটা কালো চুলের গোড়া ঝাড়র শলার মত খাড়া খাড়া। মুসাকে দেখে উজ্জ্বল হলো মুখ। আরি, মুসা? কেমন আছ? এখনও ভূতের ভয়ে কাবু?
তুমিও কি এখনও সেই বোকাই রয়ে গেছ? বলেই এক থাপ্পড় কষাল ওর পিঠে মুসা।
গুঙিয়ে উঠল টনি। উফ, বাপরে! গায়ের জোর কমেনি একটুও!
হেসে উঠল দুজনেই।
পরিচিত সবগুলো ছেলেমেয়ে স্বাগত জানাল জিনা আর মুসাকে। সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিল। পরিচয় করিয়ে দিল অপরিচিতদের সঙ্গে। কড়কড়, ফুটফাট, নানা রকম বিচিত্র শব্দ করছে আগুন। আরামদায়ক উষ্ণতা। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে একসঙ্গে কথা শুরু করল সবাই।
রিকির কথা মনে পড়তে ডাক দিল মুসা, আই, রিকি, বসো।
এত মানুষ দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেছে রিকি। দুই হাত প্যান্টের পকেটে। ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে আস্তে করে বসে পড়ল মুসার পাশে। দ্বিধা যাচ্ছে না কোনমতে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মুসা, ও আমার বন্ধু, রিকি শর।
কিশোর আর রবিন এল না এবার? জানতে চাইল টনি।
নাহ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, রবিন আবার পা ভেঙেছে। কিশোর ইয়ার্ডের কাজে ব্যস্ত। তবে বলেছে, সারতে পারলে, দুচারদিনের জন্যে হলেও চলে আসবে।
কিশোর নেই, বলল মুনা নামে একটা মেয়ে, তারমানে কোন রহস্য আর পাচ্ছ না তোমরা এবার।
পেলেই বা কি? নাকের সামনে পড়ে থাকলেও হয়তো দেখতে পাব না।
হু, তা ঠিক। জিনা, কেমন আছ?
ভাল।
নতুন আর্কেডটা দেখেছ নাকি? মুসাকে জিজ্ঞেস করল টনি। সাংঘাতিক!
দেখেছি। কিন্তু পয়সা আনিনি।
আমার কাছে আছে, হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল টনি। চলো। খেলে আসি।
উঠে দাঁড়াতে গিয়েও দ্বিধা করতে লাগল মুসা। জিনার দিকে তাকাল। একসঙ্গে বেড়াতে বেড়িয়ে ওকে ফেলে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। মাথা নাড়ল, নাহ, আজ আর যাব না। এইমাত্র এলাম ওখান থেকে। দেখা যাক, কাল।
কাল তাহলে বেশি করে পয়সা নিয়ে এসো, হাসল টনি। বসে পড়ল আবার। চুটিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করল সবাই মিলে। রিকি বাদে। চুপ করে বসে আছে। চাদরের কিনারে জড়সড় হয়ে বসে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। কথা শুনছে। হাতের তালুতে আনমনে অনবরত ঘোরাচ্ছে নীল লাইটারটা।
ও যে অস্বস্তি বোধ করছে, বুঝতে পারল জিনা। বলল, রিকি, বসে থাকতে তোমার ভাল না লাগলে হেঁটে আসতে পারো ওদিক থেকে। আমরা আছি এখানে।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রিকি। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল লাফ দিয়ে।
.
০৩.
গোল ছায়ায় বসে থাকা ছোট ছোট বিন্দুগুলোকে চিনতে সময় লাগল রিকির। সাগরের মাছখেকো পাখি। টার্ন। ছোট, মসৃণ একটা পাথরের টিলায় উঠে দাঁড়িয়েছে সে।
চলতে শুরু করল বিন্দুগুলো। এগিয়ে চলল পানির দিকে। অন্ধকার গ্রাস করে নিল ওগুলোকে।
রিকির দুই হাত পকেটে ঢোকানো। পানির দিক থেকে ঘুরল। ফিরে তাকাল পাথরের পাহাড়ের দিকে। চূড়াটা একখানে সমতল একটা টেবিলের রূপ নিয়েছে। বাদুড় উড়ছে ওটার ওপরে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার। সাগরের দিকে ঘুরল সে। প্রায় অস্পষ্ট ছোট একটা দ্বীপের কালো অবয়ব চোখে পড়ছে, বাতাস নিতে ভেসে ওঠা সাবমেরিনের পিঠের মত। বাদুড়গুলো বোধহয় ওই দ্বীপ থেকেই আসে, মনে হলো তার।
এত বাদুড় এখানকার সৈকতে! মুখ তুলে বেগুনী আকাশের দিকে তাকাল সে। একটু আগেও মাথার ওপর উড়ছিল দুটো বাদুড়। এখন নেই।
সৈকতের এই অংশটুকু নৌকা রাখার উকটা থেকে দক্ষিণে। এখানে দাঁড়ালে গাছপালায় ছাওয়া নির্জন দ্বীপটা ভালমত দেখা যায়, দিনের বেলায়ই দেখেছে। দূর থেকেই দ্বীপটা পছন্দ হয়ে গেছে তার। এর কারণ বোধহয় নির্জনতা। মানুষজন বিশেষ পছন্দ করে না সে। একা থাকতে ভাল লাগে। মসূণ, শীতল পাথরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে অপলক চোখে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে রইল।