জিনা! ওঠো! উঠে পড়ো! ভয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসতে চাইছে মুসার। আই, জিনা, প্লীজ! বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে!
নড়ে উঠল জিনা।
ভরসা পেয়ে আরও জোরে ঝাঁকাতে লাগল মুসা।
অবশেষে চোখ মেলল জিনা। গুঙিয়ে উঠল। কে?
আমি, জিনা, আমি! মুসা! জলদি ওঠো! পালাতে হবে!
পেছনে কারও উপস্থিতি টের পাওয়া গেল।
ঝট করে ঘুরে গেল মুসা।
জন!
ঠোঁট ফাঁক করে, খদন্ত বের করে, জানোয়ারের নখের মত আঙুল বাকিয়ে মুসার গলা টিপে ধরতে ছুটে এল সে।
.
১৮.
গলা চিরে বুনো চিৎকার বেরিয়ে এল মুসার। নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই চিনতে পারল না। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো সে শব্দ বাইরে বাদুড়ের কলরব বেড়ে গেল।
ক্ষণিকের জন্যে থমকে গেল জন। পরক্ষণে আবার আঙুল বাকা করে। এগিয়ে এল মুসার দিকে। চকচক করছে ওর বড় বড় শূদন্ত।
জলজ্যান্ত ভ্যাম্পায়ারকে চোখের সামনে দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছে মুসা। ভাবনার সময় নেই। পরিকল্পনার সময় নেই। দাঁড়টা তুলে ধরল। চোখা দিকটা জনের দিকে করে।
এগিয়ে আসছে জন।
সামনে ছুটে গেল মুসা। কোনভাবেই যাতে মিস না হয়, একবারেই ঢুকিয়ে দিতে পারে জনের বুকে, সেভাবে দাঁড়টা ঠেলে দিল সামনের দিকে।
থ্যাপ করে জনের বুকে লাগল দাঁড়ের মাথা। পাজরের হাড় ভাঙার বিশ্রী শব্দ হলো। গলা চিরে বেরিয়ে এল বিকট চিত্তার।
দাড়টা ওর বুকে ঢোকেনি।
ঢোকানোর জন্যে টান দিয়ে পিছিয়ে এনে আবার ঠেলে দিতে যাবে মুসা, এই সময় দেখল তার আর প্রয়োজন নেই। হাটু ভাজ হয়ে পড়ে যাচ্ছে জন। গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
এত সহজে ভ্যাম্পায়ারকে কাবু করতে পেরে বিমূঢ় হয়ে গেল মুসা। চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলেছে, মুখে এসে বসল একটা বড় মথ। থাবা দিয়ে ওটাকে সরাতেই কানে এল জিনার চিৎকার। মুসা, মুসা, বাঁচাও আমাকে! মেরে ফেলল!
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। লীলার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে জিনা।
এত তাড়াতাড়ি হাজির হয়ে গেল!
বোট হাউসের তৃতীয় নৌকাটার কথা মনে পড়ল মুসার। দাঁড় হাতে লীলাকে গুতো মারার জন্যে এগোতে যাবে, এই সময় সাঁড়াশির মত পা চেপে ধরল শক্ত, শীতল কয়েকটা আঙুল। মরেনি জন। এত সহজে মরে না। ভ্যাম্পায়ার।
লাথি মেরে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার দাঁড়টা তুলে ধরল মুসা। উত্তেজনা, আতঙ্কে গুতো মারার কথা ভুলে গায়ের জোরে বাড়ি মারল। জনের মাথা সই করে। ঢিল হয়ে এল আঙুলের চাপ। টা ছাড়িয়ে নিল মুসা। আবার বাড়ি মারল জনকে সই করে। তাড়াহুড়োয় জায়গামত না লেগে অর্ধেক লাগল মেঝেতে। ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল দাঁড়।
ভালই হলো। দাড়ের ডাণ্ডার মত অংশটা ওর হাতে রয়ে গেছে। ভাঙা দিকটা বর্শার ফলার মত চোখা। সেটা বাগিয়ে ধরে লীলার বুকে বসিয়ে দেয়ার জন্যে ছুটল সে।
মুসাকে আসতে দেখে অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় লাফ দিয়ে সরে গেল লীলা। শেষ মুহূর্তে যেন ব্রেক কষে দাঁড়াল মুসা। সামলাতে না পারলে দাঁড়টা লাগত জিনার গায়ে। ওর পেটে ঢুকে যেত।
ঘুরে দাঁড়াল আবার মুসা। লীলাকে সই করে দাঁড় তুলে ছুটল।
আবার সরে গেল লীলা।
নেচে উঠল আলোটা। কেন, দেখার জন্যে ফিরে তাকানোর সময় নেই। মুসার নজর লীলার ওপর।
গুতোটা এড়াতে পারল না এবার আর লীলা। তবে ঠিকমত লাগল না। যেখানে লাগাতে চেয়েছিল মুসা, তার সামান্য ভানে লাগল, হৃৎপিণ্ডে নয়।
আর্তনাদ করে বুক চেপে ধরে জনের পাশে পড়ে গেল লীলা। গোঙাতে লাগল। ওই সামান্য আঘাতে মরবে না। ঘাড়ের পাশে বাড়ি মারল মুসা। নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল লীলার।
জিনা! জলদি চলো বলে ওর দিকে ঘুরে দেখল হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনা। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। এগিয়ে যেতে শুরু করল। মেঝেয় পড়ে থাকা দুই ভ্যাম্পায়ারের দিকে।
কি করছ?
বিড়বিড় করে জবাব দিল জিনা, আগুনে নাকি ধ্বংস হয়ে যায় ভ্যাম্পায়ার!
হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। কি করবে বুঝতে পারছে না। ভ্যাম্পায়ারের ধ্বংস সে-ও চায়। একটু আগে দাঁড় দিয়ে গুতা মেরে তা-ই করতে চেয়েছিল।
দুজনের গায়ে তেল ঢেলে দিল জিনা। মুসাকে জানালার দিকে যেতে বলে নিজেও পিছাতে শুরু করল। পঁড়িয়ে গেল জ্যনালার কাছে এসে। একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল পড়ে থাকা দুই ভ্যাম্পায়ারের দিকে।
নড়তে শুরু করেছে লীলা। মরেনি। বেহুশ হয়ে ছিল।
দুজনকে সই করে জ্বলন্ত হ্যারিকেনটা ছুঁড়ে মারল জিনা।
কি ঘটে দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে চাইল না মুসা। তাড়াতাড়ি জিনাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আগুনে সত্যি সত্যি ধ্বংস হবে কিনা ভ্যাম্পায়ার, নিশ্চিত নয় সে। হলে তো ভাল। নইলে ওরা আবার জেগে ওঠার আগেই পালাতে হবে দ্বীপ থেকে।
বুনোপথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে সৈকতে এসে পড়ল দুজনে। তিনটে ডিঙি এখন ঘাটে বাঁধা। যেটাতে করে এসেছিল মুসা, সেটাতে দাঁড় নেই। জুন যেটায় করে জিনাকে নিয়ে এসেছিল, সেটাতে উঠল।
তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে সরে যেতে শুরু করল দ্বীপের কাছ থেকে। সারাক্ষণ ভ্যাম্পায়ারের আক্রমণের আশঙ্কায় দুরুদুরু করছে বুক। দ্বীপের দিক। থেকে কোন বাদুড় নৌকার বেশি কাছে এলেই চমকে উঠছে। ভাবছে বাদুড়ের। রূপ ধরে চলে এসেছে জন কিংবা লীলা।
তবে এল না ওরা।
জিনা আবার নেতিয়ে পড়েছে। কোন কথা বলছে না। সাংঘাতিক ধকল গেছে ওর ওপর। নিশ্চয় ভয়াবহ রক্তশূন্যতায় ভুগছে। ফিরে গিয়েই আগে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।