কথাটা মনে পড়তেই আরেকটা বুদ্ধি মাথায় এল চট করে। হাতের দাঁড়টাও কাঠের। মাথাটা যদি চোখা করে নেয়া যায়…কিন্তু ছুরি পাবে কোথায়? হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, দাঁড়ের মাথা মোটামুটি চোখাই আছে। প্রচণ্ড শক্তিতে খোঁচা মারলে হয়তো বসিয়ে দেয়া যাবে পিশাচের বুকে। কিন্তু সেটা দিনের বেলায় সম্ভব। কফিনে যখন শুয়ে থাকে ওরা, আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে থাকে। এখন রাতে, পূর্ণ জাগরণের মধ্যে? অসম্ভব! মনকে হাত নেড়ে ভাবনাটা দূর করে দিল সে। এতসব যুক্তির কথা ভাবতে গেলে কোন কাজই হবে না। পিছিয়ে যেতে হবে। সব সময় এখন আল্লাহ-রসুলের কথাই কেবল মনে রাখা দরকার। তাহলে কোন প্রেতেরই ক্ষমতা হবে না তার ধারে কাছে। ঘেঁষে।
পথের শেষ মাথায় নিচু চালাওয়ালা কাঠের তৈরি একটা বীচ হাউস। অন্ধকার। কাছে এসে দেখা গেল কোন জানালায় একটা কাচও নেই। চালার ওপর পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে বাদুড়ের ঝাঁক। একটা বাদুড় খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসে মুসার গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে শাই করে পাশ কেটে সরে গেল, তীক্ষ্ণ ডাক ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝোপের মধ্যে।
দাঁড়টা দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল মুসা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কিছুই দেখা গেল না।
ওর মনে হলো, জিনাকে নিয়ে এর মধ্যেই ঢুকেছে জন। এই বাড়িটাই ভ্যাম্পায়ারের আস্তানা। দ্বিধা করল একবার। তারপর যা আছে কপালে, ভেবে, দাড়ের মাথায় ভর রেখে লাফ দিয়ে উঠে বসল জানালার চৌকাঠে। পা রাখল
সব কটা জানালা খোলা থাকার পরেও ভেতরে ভাপসা গন্ধ। ছত্রাকের গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। আরও একটা বোটকা গন্ধ আছে। বুনো জানোয়ারের? নাকি শুকনো হাড়গোড়! ভাবতে চাইল না আর। দম আটকে রেখে লাভ নেই। কতক্ষণ রাখবে? তারচেয়ে এই বিশ্রী গন্ধযুক্ত বাতাসেই দম নিয়ে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়া ভাল। তাতে চলাফেরা সহজ হবে।
অন্ধকার চোখে সওয়ানোর জন্যে দাঁড়িয়ে রইল সে। স্থির। কানে আসছে বাইরের একটানা ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ।
ধীরে ধীরে চোখের সামনে ফুটে উঠছে ঘরটার অবয়ব। লম্বা, সরু একটা ঘর। বেডরূম। কিন্তু খাট বা বিছানা নেই।
কোন কিছুই স্পষ্ট নয়। আলো না হলে দেখা যাবে না।
হঠাৎ মনে পড়ল রিকির লাইটারটার কথা। পকেটে হাত দিয়ে দেখল, আছে। বের করে আনল তাড়াতাড়ি।
কাঁপা আলোয় দেখতে পেল জিনাকে।
এক দিকের দেয়ালের ধার ঘেঁষে বসানো বড় একটা আর্ম চেয়ারে নেতিয়ে আছে। গদি মোড়া একটা বিরাট হাতলে মাথাটা পড়ে আছে।
মরে গেছে ও! মুসার প্রথম ভাবনাই হলো এটা। মেরে ফেলা হয়েছে। ওকে!
ভালমত দেখার জন্যে এগিয়ে গেল সে। জিনার হাতে হাত রাখল। গরম। ঠাণ্ডা হয়নি এখনও। নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। না, মরেনি! নিঃশ্বাস পড়ছে!
জানালার কাছে দাপাদাপি শুরু করল কয়েকটা বাদুড়। আরও আসতে লাগল। প্রায় ঢেকে দিল জানালাটাকে। কয়েকটা ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। আলোর পরোয়া করল না। যেন এই আলোর সঙ্গে পরিচয় আছে ওদের। অবাক কাণ্ড, বদ্ধ ঘরে উড়তে গিয়ে ছাতের সঙ্গে কিংবা দেয়ালে ধাক্কা খেল না– একটাও।
একটা বাদুড় উড়তে উড়তে আলোর এত কাছাকাছি চলে এল, ডানার ঝাঁপটায় নিভে গেল লাইটার। খস করে টিপে আবার জ্বালল মুসা। মেঝেতে রাখা একটা হ্যারিকেন চোখে পড়ল। পুরানো, তবে মরচে পড়া নয়। বেশ ঘষেমেজে রাখা হয়েছে। হ্যারিকেনটা তুলে আরও অবাক হলো। তেল ভরা। আশ্চর্য! ভ্যাম্পায়ারদের আলোর দরকার হয় নাকি? হ্যারিকেনও ব্যবহার করে! মনে পড়ল, কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গে প্রচুর লণ্ঠন ছিল। তবে সেগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ত না কাউন্টের। মেহমান এলে তাদেরকে জ্বেলে দিত।
হ্যারিকেন নিয়ে মাথা ঘামাল না আর। বাদুড়ের দিকেও নজর দেয়ার সময় এখন নেই। জিনা বেঁচে আছে। ওকে বের করে নিয়ে যাওয়া দরকার।
হ্যারিকেন ধরিয়ে লাইটারটা পকেটে রেখে দিল সে। দেখতে লাগল ঘরে কি কি আছে।
জানালা থেকে দূরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা জিনিস চোখে পড়ল। চিনতে সময় লাগল না। খাইছে! কেঁপে উঠল মুসা। কফিন! ডালা নামানো। জন নিশ্চয় এই কফিনে ঢুকে শুয়ে আছে!
আঙুলগুলো আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল দাঁড়ের গায়ে।
বেশিক্ষণ ঘরে থাকল না বাদুড়গুলো। বেরিয়ে গেল। ঝটাপটির শব্দ বন্ধ হলো। তবে আবার আসবে ওরা, বুঝতে পারছে মুসা। যে কোন সময় ঝাক বেঁধে এসে ঢুকবে ঘরে। এখানে বাদুড়ের নিত্য আসা-যাওয়া, আচরণেই বোঝা যায়। আলফ্রেড হিচককের বার্ড ছবিটার কথা মনে পড়ল। ছবির পাখিগুলোর মত খেপে গিয়ে বাদুড়রা যদি একযোগে এসে এখন আক্রমণ করে ওকে? ছিন্নভিন্ন করতে সময় লাগবে না! ওগুলোর মধ্যে জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু বহন করছে এমন বাদুড়ও থাকতে পারে…
উদ্ভট ভাবনাগুলো জোর করে মন থেকে তাড়িয়ে দিয়ে জিনার দিকে ঘুরল। সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকল, জিনা! জিনা!
গলা কাঁপছে ওর।
জিনার কাঁধ চেপে ধরে কঁকি দিয়ে কণ্ঠস্বর আরেকটু চড়িয়ে আবার ডাকল, জিনা! ওঠো! এই জিনা!
শিহরণ বয়ে গেল জিনার শরীরে। কিন্তু চোখ মেলল না।
জিনা? আরও জোরে কাধ ধরে নাড়া দিল মুসা।
আবার শিহরণ বইল জিনার শরীরে। কিন্তু মাথা তুলল না।
দুই হাতে ওর মাথাটা চেপে ধরে সোজা করল মুসা। চোখের পাপড়ি ধরে পাতা খোলার চেষ্টা করল।