পেছনের পকেট থেকে খামটা পড়ে গেল বালিতে। ফিরেও তাকাল না মুসা। তোলার চেষ্টা করল না। ওগুলো এখন অর্থহীন। একাকী জিনার দেখা পাবেও না আর, ছবি দেখিয়ে তাকে বোঝানোরও সময় নেই। ভ্যাম্পায়ারে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওকে, ওদের ভয়ঙ্কর আস্তানায়। ঠেকানো দরকার।
ডকের কাছে আসার আগে গতি কমাল না মুসা। মুখের কাছে হাত জড় করে চেঁচিয়ে ডাকল জিনা! জিনা! বলে।
তার ডাকে সাড়া দিল না জিনা। ফিরে তাকাল না।
সরে যাচ্ছে নৌকাটা। সাগরের পানিতে পড়া চাঁদের ঝিলমিলে ভূতুড়ে আলোতে এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার দ্বীপটার দিকে। অস্পষ্ট হয়ে আসছে ক্রমে।
বনে ঢাকা দ্বীপ। বাদুড়ে বোঝাই দ্বীপ। ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ।
ওহ, খোদা! ককিয়ে উঠল মুসা। বড়ড় দেরি করে ফেললাম! অনেক দেরি!
সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল লীলার ওপর। ওকে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্যে সে-ই দায়ী।
প্রচণ্ড রাগে ভয়ডর সব গায়েব হয়ে গেছে মুসার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তোমার ব্যবস্থা পরে করব আমি, শয়তানী! আগে ওই বদমাশটার একটা ব্যবস্থা করি!
.
১৭.
একটা নৌকার বাঁধন খুলতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগল না মুসার। দ্রুতহাতে গিট খুলে দড়িটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে নামল নৌকায়। দাঁড় তুলে নিল।
সময় বয়ে যাচ্ছে। মহামূল্যবান সেকেন্ডগুলোর টিক-টিক টিক-টিক শব্দটাও যেন শুনতে পাচ্ছে সে।..
লীলার ডাক কানে এল। তীরে দাঁড়িয়ে ডাকছে ওকে লীলা। ফিরে যেতে অনুরোধ করছে। ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, বালির ওপর দিয়ে বোট হাউসের দিকে দৌড়ে আসছে লীলা। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে যেন উড়ে আসছে। ওকে ধরতে আসছে নিশ্চয়।
ঝপাৎ করে পানিতে দাঁড় ফেলল মুসা। বাইতে শুরু করল। জনকে ধরতে হলে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যাওয়া দরকার।
বোট হাউসের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল লীলা। বুঝতে পেরেছে, তার ডাকে সাড়া দেবে না মুসা। থামবে না। বাকি যে নৌকাটা আছে এখনও, সেটার দিকে ছুটল। শেষবার ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, নৌকার কাছে ঝুঁকে আছে লীলা। নিশ্চয় দড়ির গিট খুলছে।
যতটা ভেবেছিল মুসা, স্রোতের বেগ তার চেয়ে অনেক বেশি। যতই শক্তি দিয়ে সামনে এগোতে চাইছে সে, স্রোত তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। এক ফুট সামনে এগোলে দুই ফুট পিছাচ্ছে। কি করে যেন বার বার পিছলে এসে স্রোতের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নৌকাটা। কাত হয়ে যাচ্ছে, দুলছে ভীষণ। অথচ। ঢেউ ততটা নেই।
কাত হলেই পানি ঢুকছে। দেখতে দেখতে মুসার জুতো ভিজে গেল নৌকার তলায় জমা পানিতে। জুতো ভিজল, মোজা ভিজল, জুতোর মধ্যে ঢুকে গেল পানি। এ হারে উঠতে থাকলে নৌকা ডুবে যেতেও সময় লাগবে না। স্রোতের কারণে ঢেউগুলোও কেমন অশান্ত এখানে। নৌকার কিনারে বাড়ি লেগে পানির ছিটের ফোয়ারা সৃষ্টি হচ্ছে। চোখেমুখে এসে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য করছে ওকে।
নাহ, পারব না! হতাশা গ্রাস করতে চাইছে মুসাকে। অনেক দেরি করে ফেলেছি আমি।
কিন্তু হাল ছাড়ল না।
চোখ মেলে সামনের দিকে তাকাল। নৌকাটা কোথায়?
দ্বীপে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়।
চোখের পাতা সরু করে, নোনা পানির ছিটে বাঁচিয়ে দ্বীপের দিকে তাকাল সে। মেঘে ঢাকা চাঁদের ভূতুড়ে আলোয় কালো সাগরের পটভূমিতে ভয়ঙ্কর। অজানা জলদানবের মত লাগছে দ্বীপটাকে।
বিশাল সাগর যেন গিলে নিয়েছে জিনাদের নৌকাটা। চিহ্নও দেখা গেল না। ওটার।
ডানা ঝাপটানোর শব্দে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুসা। খুব নিচু দিয়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে উড়ে চলেছে শত শত বাদুড়। ফল খেতে যাচ্ছে। নাকি রক্ত! ওগুলোর মধ্যে কয়টা আছে ভ্যাম্পায়ার?
দ্বীপের আরও কাছে আসতে ওটার ওপরও ঝাঁকে ঝাকে বাদুড় উড়তে দেখা গেল। ডানার শব্দ আর কর্কশ, তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঢেউয়ের শব্দও চাপা পড়ে যাচ্ছে। খোলা পেয়ে বাতাস বইছে হু-হুঁ করে। দামাল বাতাসে ভর করে উড়ছে শত শত, হাজার হাজার বাদুড়। উড়ছে, চিৎকার করছে, ডানা ঝাঁপটাচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, ওপরে উঠছে, নিচে নামছে। দ্বীপের ওপরের আকাশটাকে ভরে দিয়েছে। পঙ্গপালের মত। একসঙ্গে এত বাদুড় জীবনে দেখেনি মুসা। আমাজানের জঙ্গলেও না।
দ্বীপের কিনারে একটা ছোট বোট হাউস চোখে পড়ল ওর। পুরো দ্বীপটাকেই গিলে নিয়ে গাছপালা আর আগাছা এখন খুদে সৈকতটাকেও গ্রাস করতে চাইছে। ঢেউয়ে দুলতে দেখা গেল একটা বোট। নিশ্চয় ওটাই! জিনাকে নিয়ে আসা হয়েছে যেটাতে করে।
খালি নৌকা। দুজনের কাউকে দেখা গেল না ওতে।
ডকের কাছে এনে নৌকা থামাল মুসা। লাফ দিয়ে তীরে নেমে নৌকাটা টেনে তুলল বালিতে। চারপাশে তাকাল। সরু একটা পায়ে চলা পথ বাঁক নিয়ে ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে।
খালিহাতে না গিয়ে অস্ত্র হিসেবে দাঁড়টা হাতে রেখে দিল সে। ভ্যাম্পায়ারের মত মহাক্ষমতাধর শত্রুর বিরুদ্ধে অতি সাধারণ একটা দাঁড়। তুচ্ছ! মনে মনে ডেকে বলল, আল্লাহ, তুমিই এখন আমার সবচেয়ে বড় ভরসা!
মনে জোর এনে, সাহস সঞ্চয় করে, একটা দাঁড় সম্বল করে দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে পা বাড়াল সে। এগিয়ে গেল পায়ে চলা পথটার দিকে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ড মেরুদণ্ডে শীতল শিহরণ।
মাথার ওপর নেমে এসেছে গাছের ডাল। এড়ানোর জন্যে মাঝে মাঝেই মাথা নুইয়ে ফেলতে হচ্ছে। ডানা ঝাঁপটানোর শব্দের বিরাম নেই। কোন গাছ, কোন ডালই খালি নেই। সবগুলোতে বাদুড় আছে। ওকে দেখে চিৎকার করছে ওগুলো। দাঁড় দিয়ে বাড়ি মেরে ভর্তা বানিয়ে দেয়ার ইচ্ছেটা বহুকষ্টে রোধ করল সে। বাড়ি যদি মারতেই হয় ওগুলোর গুরুকে মারতে হবে, ভ্যাম্পায়ারকে। তাতে অবশ্য রক্তচোষা পিশাচের কিছু হবে কিনা সন্দেহ। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা পড়েছে। ছবিও দেখেছে। জেনেছে, ভ্যাম্পায়ার মারতে হলে হৃৎপিণ্ডে কাঠের কীলক ঢুকিয়ে দিতে হয়।