দুইবার অন্য মেয়েকে জিনা বলে ভুল করল সে। দুটো মেয়েরই চুল জিনার মত। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখে ভুল ভাঙল। ওর দিকে কৌতূহলী- চোখে তাকাল মেয়েগুলো। মুচকি হাসল। বোকা ভেবেছে নিশ্চয়।
ভাবুকগে। মাথা ঘামাল না মুসা। জিনাকে খোঁজা চালিয়ে গেল।
দূর থেকে চোখে পড়ছে নৌকার ডকটা। সেদিকেই চলেছে সে, পাথরের পাহাড়ের একটা ধার যেখানে পানিকে ঠেলে সরিয়ে নেমে গেছে সাগরে, যার কাছে পাওয়া গিয়েছিল রিকির লাশ। দিনের আলো না থাকলেও সৈকতে এক ধরনের আলোর আভা থাকে প্রায় সব সময়। চোখে সয়ে এলে সেই আলোতে মোটামুটি অনেক কিছুই দেখা যায়। ডকের পানিতে তিনটে নৌকাকে ঢেউয়ে ডুবতে ভাসতে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে।
কয়েকজন মানুষ দেখা গেল তীরে। জিনা আছে বলে মনে হলো না। আর এগিয়ে লাভ নেই। ফেরা দরকার।
শহরেও নেই, সৈকতেও নেই। কোথায় গেল জিনা?
জোরে জোরে হাপাচ্ছে মুসা। নুড়ি মাড়িয়ে যাওয়ার সময় জোরাল মচমচ শব্দ তুলছে তার জুতো। সেই শব্দের জন্যেই প্রথমবার ডাকটা কানে এল না তার। দ্বিতীয়বারেও না। তৃতীয়বারে শুনতে পেল, মুসা! আই, মুসা!
লীলা!
থেমে গেল মুসা। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক। শিসের শব্দ বেরোচ্ছে নাকের ফুটো দিয়ে। জিরানোর জন্যে বালিতে বসে পড়ে দম নিতে লাগল জোরে জোরে।
মুসা, আমাকে খুঁজছ?
দৌড়ে আসছে লীলা। বাতাসে উড়ছে চুল। চাঁদের আলো পড়ে ঝিক করে উঠছে চোখের মণি। মড়ার মত ফ্যাকাসে গায়ের চামড়া।
কাছে এসে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল লীলা। আবার করল একই প্রশ্ন, মুসা, আমাকে খুঁজছ? এসে পড়েছি।
এতই মোলায়েম কণ্ঠস্বর, মনে হলো বাতাসের সঙ্গে কানাকানি করে কথা বলছে লীলা, মধুর ঝঙ্কার তুলে। কাল দেখা করোনি কেন?
হাঁটু গেড়ে মুসার পাশে বসে পড়ল সে। চোখে চোখ পড়ল। সম্মোহনী দৃষ্টি। মোলায়েম কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করল লীলা, কাল দেখা করোনি কেন? কোথায় ছিলে? তোমার জন্যে মন খারাপ লেগেছে।
জবাব দিল না মুসা। মন খারাপ, না শরীর খারাপ? মনে মনে বলল সে। আমার রক্তে খিদে মেটাতে পারোনি বলে! পিশাচী কোথাকার!
আরও কাছ ঘেঁষে এল লীলা। চোখ দুটো স্থির মুসার গলার ওপর। কোন্দিকে তাকিয়ে আছে সে বুঝতে অসুবিধে হলো না মুসার। ওর গলার শিরাটার দিকে। শিউরে উঠল।
আবার মুসার চোখের দিকে নজর ফেরাল লীলা। সম্মোহনের চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু সতর্ক রয়েছে মুসা। আজ আর কোনমতেই ওর সম্মোহনের ফাঁদে ধরা দিল না। তাকে সাহায্য করল আরেকটা জিনিস। লীলার চোখ থেকে চোখ সরাতেই তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখা গেল ডকটা। একটা নৌকায় উঠেছে। একজন লোক। হাত ধরে আরেকজনকে উঠতে সাহায্য করছে। ঢেউয়ে নৌকাটা দুলতে থাকায়ই বোধহয় যাকে তুলছে তার উঠতে অসুবিধে হচ্ছে।
জিনা!
ছোট্ট নৌকাটায় জিনাকে তুলে নিচ্ছে জন।
না! নিজের অজান্তেই মুসার মুখ থেকে বেরিয়ে এল চিৎকার।
ওর দুই কাঁধ চেপে ধরল লীলা। মিষ্টি গন্ধ মুসার নাকে ঢুকতে আরম্ভ করল। দম আটকে ফেলল মুসা। সুগন্ধী মেশানো কোন ধরনের ওষুধ শুকিয়ে শিকারকে অবশ করে দেয় এখানকার ভ্যাম্পায়াররা, কিংবা ঘুম পাড়িয়ে ফেলে নিরাপদে রক্ত খাওয়ার জন্যে, এটা এখন বুঝে গেছে সে।
নৌকার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। জিনা নৌকায় উঠে পড়েছে। দাঁড় তুলে নিয়েছে জন।
না! আবার চিৎকার করে উঠল মুসা।
লীলা ভাবল তাকেই বাধা দিচ্ছে মুসা। কাঁধে হাতের চাপ বাড়িয়ে মুসাকে আরও কাছে টানতে শুরু করল।
এত কাছে থেকে ওষুধের প্রভাব পুরোপুরি কাটাতে পারল না মুসা। বো করে উঠল মাথার ভেতর। লীলার হাতের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে নিল নাকটা। ওর কাঁধের ওপর দিয়ে দেখছে নৌকাটা তীর থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে।
সত্যি বলছি, মুসা, কাল তোমার জন্যে ভীষণ মন খারাপ লেগেছে আমার, কানের কাছে প্রায় ফিসফিস করে বলল লীলা। কানের লতি ছুঁলো ঠোঁট।
ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে মুসা। মুখটা নামিয়ে নিতে চাইছে গলার শিরায়।
একবার দাঁত ছোঁয়াতে পারলে আর রক্ষা নেই। কুটুস করে ফুটিয়ে দেবে। রক্ত শুষে নিতে শুরু করবে।
মিষ্টি গন্ধ অবশ করে আনতে শুরু করেছে মুসার অনুভূতি।
অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে নৌকাটা। ছোট্ট দ্বীপটার দিকে চলেছে। যেটাতে লক্ষ বাদুড়ের বাস। যেটাতে ভ্যাম্পায়ারের বাস।
চলে যাচ্ছে জিনা। নিয়ে যাচ্ছে ওকে জন। দূরে। বহুদূরে। চিরকালের। জন্যে।
কিছু করতে না পারলে মুসা নিজেও হারিয়ে যাবে চিরকালের জন্যে! এদিকেও ভ্যাম্পায়ার, ওদিকেও। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে আরম্ভ করল। মুসা। বাঁচতে চাইলে এখনই কিছু করা দরকার। নইলে শেষ করে দেবে ওকে লীলা।
ধাক্কা দিয়ে লীলাকে সরিয়ে দিল সে। ফাঁক হয়ে গেছে লীলার ঠোঁট। শ্বদন্ত দুটো চিকচিক করছে চাঁদের আলোয়। ধকধক করে জ্বলছে দুই চোখ। তাতে রাজ্যের লালসা।
অবাক লীলাকে আরেক ধাক্কায় বালিতে ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা।
মুসা, শোনো! দাঁড়াও! মুসা!
কিন্তু ততক্ষণে ডকের দিকে দৌড় দিয়েছে মুসা। সরে যাচ্ছে লীলায় সম্মোহনী দৃষ্টির মায়াজাল থেকে, মারাত্মক সুগন্ধীর কাছ থেকে দূরে। বালিতে, নুড়িতে পিছলে যেতে লাগল জুতো। মচমচ শব্দ। যতই দৌড়াল কেটে যেতে লাগল মাথার ঘোলাটে ভাবটা। দেখতে পাচ্ছে বোট হাউসের কাছে বাধা নৌকা দুটো দোল খাচ্ছে ঢেউয়ে।