কখন পাবেন?
কাঁধ নাচিয়ে হতাশ ভঙ্গি করল ম্যানেজার, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত দোকান খোলা আছে। আধা ঘণ্টা আগেই এসো। পেয়ে যাবে। পাশে রাখা একটা স্থানীয় খবরের কাগজ তুলে নিয়ে হেডলাইন পড়তে শুরু করল সে। মুসা দাঁড়িয়েই আছে দেখে মুখ তুলে বলল, ঠিক সাতটায় চলে এসো। চিন্তা নেই। হয়ে যাবে।
.
১৬.
কোনমতে দিনটা পার করে দিল মুসা। সারাদিনে একবারের জন্যেও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। বিকেলে সামান্য পরিষ্কার হলো আকাশ। সাদাটে উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিম আকাশে। কিন্তু বাতাস সেই আগের মতই কনকনে।
দুপুরের পর কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করেছিল সে। তন্দ্রামত এসেছিল। সেই সামান্য সময়েও দুঃস্বপ্ন দেখল। লীলা এসে রক্ত খাওয়ার চেষ্টা করল তার।
চমকে জেগে উঠল সে।
ঘুমের মধ্যেও ধস্তাধস্তি করেছে। কিছুতেই রক্ত খেতে দেয়নি লীলাকে।
দিনের চেয়ে বিকেলের আলো খুব একটা কমল না। অতি সামান্য। কালচে ধূসর মন খারাপ করে দেয়া আলো। কোন কিছুই ভাল লাগে না।
মুসারও লাগল না। বিছানা থেকে নেমে ভাল করে চোখে মুখে পানি দিয়ে এল। পরিষ্কার একটা শার্ট পরল। কেন করল এ সব জানে না। বোধহয় মন। ভাল করার জন্যে। মানিব্যাগে দেখে নিল টাকা আছে কিনা, ছবির বিল দিতে পারবে কিনা। টাকা না পেলে আবার ছবিগুলো আটকে দিতে পারে ম্যানেজার।
বেকার একটা দিন গেল। মেজাজই খারাপ হয়ে গেল ছবির দোকানের লোকটার ওপর। আরও খারাপ হবে ছবিগুলো যে ভাবে চাইছে সে, সেভাবে না এলে। ছবিতে জনের ছবি না উঠলেই কেবল জিনাকে বোঝাতে পারবে তার সঙ্গে আর মেলামেশা না করার জন্যে।
সাতটা বাজার কয়েক মিনিট আগে দোকানে ঢুকল মুসা।
হাসিমুখে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যানেজার। এই যে, এসে পড়েছ।
কোন ভূমিকার মধ্যে গেল না মুসা। হয়েছে?
মাথা ঝাঁকিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা পেটমোটা খাম বের করে ধড়াস করে টেবিলে ফেলল ম্যানেজার। খামের মুখটা পাতলা টেপ দিয়ে আটকানো। সাংঘাতিক ক্যামেরা। স্পষ্ট ছবি। এত দামী জিনিস পেলে কোথায়?
অহেতুক কথা বলার মেজাজ নেই মুসার। আমার বাবার। বিল কত হয়েছে?
কয়েক সেকেন্ড পর খামটা প্যান্টের পেছনের পকেটে নিয়ে ঝড়ের গতিতে দোকান থেকে বেরিয়ে এল সে। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা আর্কেডে ছুটল জিনাকে ফোন করার জন্যে।
সাতটা বেজে কয়েক মিনিট। ভারী মেঘ থাকায় আকাশ অস্বাভাবিক অন্ধকার। জন নিশ্চয় কফিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, এতক্ষণে। ওর আগেই জিনার সঙ্গে দেখাটা করতে হবে তার। নইলে আজ রাতেও জিনাকে বের করে নিয়ে যাবে জন। তারপর হয়তো দেখা যাবে জিনার লাশও রিকির মত সাগরের পানিতে ভাসছে।
পে ফোন থেকে জিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল মুসা। বার বার চেষ্টা করেও লাইন পেল না। জবাব দিল না কেউ।
জিনাদের বাড়িতে লোক নেই। জিনা কোথায়? শহরে এসেছে? এলে কোন্ কোন্ জায়গায় যেতে পারে ভাবল। খুঁজতে চলল তাকে। প্রথমে এল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে মুভি থিয়েটারটায়। শো দেখার জন্যে লাইন দিয়ে থাকা মানুষগুলোর চেহারার দিকে তাকাতে লাগল। জিনা নেই এখানে। ডিউন লেন পার হয়ে প্রিন্সেসে এল এরপর। আইসক্রীম পারলার কিংবা আর্কেডের কোনখানেও নেই জিনা।
কোথায় গেল?
দোকানগুলোর ধার দিয়ে রাস্তার শেষ মাথার দিকে হেঁটে চলল মুসা। প্রতিটি রেস্টুরেন্ট, কাপড়ের দোকানে, কসমেটিক্সের দোকানে উঁকি দিল। জোড়ায় জোড়ায় হাঁটছে যে সব ছেলেমেয়ে, সবার কাছাকাছি এসে চেহারার দিকে তাকাল। কিন্তু নেই।
জিনা, কোথায় তুমি?
প্রায় একঘণ্টা ধরে শহরের দোকানপাট, অলিগলি, সবখানে চষে বেড়াল মুসা। ঘড়ি দেখল। আটটা পনেরো।
পকেটে হাত দিয়ে খামটার অস্তিত্ব অনুভব করল একবার। আছে। সৈকতে রওনা হলো সে।
সী-ব্রিজ রোড ধরে প্রায় ছুটতে ছুটতে চলল। গালে লাগছে সাগরের বাতাস। উত্তেজনায় টান টান হয়ে গেছে স্নায়ু, শক্ত করে দিয়েছে শরীরের পেশিকে। থেকে থেকে পেটে খামচি ধরা একটা অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। ঠাণ্ডা ঘামের ধারা বইছে গাল বেয়ে। কয়েক মন ওজন লাগছে পা দুটোকে।
লাগুক। জিনাকে খুঁজে বের না করে থামবে না। কি রকম বিপদে রয়েছে। সে, বোঝাতেই হবে। কিশোর হলে যা করত। ওকে বিপদ থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত নিরস্ত হত না কিশোর। মুসাও হবে না।
মেঘে ঢাকা গোধূলির ঘনায়মান অন্ধকারে সৈকতের বালির রঙ হয়ে উঠেছে নীলচে রূপালী। ঢেউয়ের উচ্চতা নেই বললেই চলে। আলতো করে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে সৈকতের কিনারা। ডুবন্ত সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না মেঘের আড়ালে থাকায়, তবে কালচে লাল করে তুলেছে পশ্চিমের মেঘপুঞ্জকে। সেই আলোর রেশ এসে লেগেছে সাগরের পানিতে। কিনারটা লালচে। গভীর যেখানে, সেখানকার রঙ সবুজ। তাতে কালো রঙ মেশানো। দূর থেকে সাগরের উল্টোদিকে বনের গাছগাছালির মাথাকেও একই রঙের লাগছে।
জিনা, দোহাই তোমার, দেখা দাও! কোথায় তুমি?
সৈকতে এখন অনেক লোক। সারাদিন যারা ঘরে বসে ছিল, তারাও বেরিয়েছে। সন্ধ্যাটা উপভোগ করার জন্যে।
বালিয়াড়ির ধার ঘেঁষে দৌড়াচ্ছে মুসা। এগিয়ে চলেছে পানির দিকে। হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল সূর্য। ডুবতে দেখা গেল না। মেঘের বুকে লাল রঙ মুছে যাওয়া দেখে অনুমান করা গেল ডুবেছে। মুহূর্তে শীতল হয়ে গেল বাতাস। ঝপ করে নামল অন্ধকার।