কি আর করবে। সময় কাটানোর জন্যে নির্জন রাস্তার এমাথা ওমাথায় পায়চারি শুরু করল সে। হাতটা এখনও পকেটে। আঙুলগুলো ধরে রেখেছে। কৌটাটা। যেন ছাড়লেই পকেট থেকে পড়ে গিয়ে হারিয়ে যাবে মূল্যবান সূত্রগুলো।
হাঁটার সময় দুএকজন মানুষ দেখা গেল। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। উদ্ভ্রান্তের মত ওকে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে দেখে কৌতূহলী চোখে তাকাতে লাগল ওরা। ফিরেও তাকাল না সে। অন্য কোন দোকানের দিকে সামান্যতম আগ্রহ নেই। হাটছে আর কয়েক মিনিট পর পরই হাত চোখের সামনে তুলে এনে ঘড়ি দেখছে, দশটা বাজতে আর কত দেরি।
পায়চারি করার সময় বাড়িঘরের বেশি কাছে গেল না, বিশেষ করে বিল্ডিঙের মাঝে মাঝে যেখানে কুয়াশা জমে রয়েছে। ভয় পাচ্ছে আবছা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ওর দামী সূত্রগুলো কেড়ে নেবে জন। যদিও জানে, ভয়টা একেবারেই অমূলক। বোকার মত ভাবনা। দিনের বেলা কোন কারণেই বেরোয় না ভ্যাম্পায়ার। বেরোতে পারে না। ওদের সে-ক্ষমতাই নেই।
কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে যখন মনে হলো মুসার, ঘড়িতে দেখে তখনও মাত্র সাড়ে নটা। একটা দুটো করে খাবারের দোকান খুলতে আরম্ভ করেছে। অন্যান্য দোকানের চেয়ে খাবারের দোকানগুলো আগে খোলে। সী-ব্রিজ কফি শপের কাউন্টারের সামনে একটা টুলে এসে বসল সে। হালকা খাবার আর। কফির অর্ডার দিল। পেট ভরানোর চেয়ে খাবার খেয়ে সময় কাটানোর দিকেই বেশি নজর তার। কেকের টুকরোটা চিবাতে গিয়ে করাতে কাটা কাঠের গুঁড়োর মত লাগল। কফিটা আরও বিস্বাদ। মগের কানায় কানায় পূর্ণ করে দিল দুধ দিয়ে। কয়েক চামচ চিনি মেশাল। তারপরেও কোন স্বাদ পেল না। উত্তেজনায় জিভই নষ্ট হয়ে আছে, ভাবল সে। নইলে এত বিস্বাদ লাগতে পারে না কোন খাবার।
কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর বার বার চোখ যাচ্ছে কাউন্টারের পেছনে দেয়াল ঘড়িটার দিকে। অনড় হয়ে আছে যেন কাঁটাগুলো।
দশটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে ছবি ডেভেলপের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। দোকানের তরুণ ম্যানেজার তখন তালা খুলছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। তাকিয়ে থেকে ওর দোকান খোলা দেখতে দেখতে মনে মনে তাগাদা দিতে লাগল আরও তাড়াতাড়ি করার জন্যে। লোকটার লাল চুল। শজারুর কাটার মত খাড়া। এক কানে পান্না বসানো একটা মাকড়ি।
দরজা খুলে লোকটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ল মুসা।
ভুরু কুঁচকে অবাক চোখে মুসাকে দেখতে দেখতে ম্যানেজার বলল, গুড মর্নিং। খুব তাড়া নাকি তোমার?
পকেট থেকে কৌটাটা বের করে পুরু কাচ লাগানো কাউন্টারে রাখল মুসা। অতিরিক্ত তাড়া। এগুলো করে দিন।
কিন্তু ম্যানেজারের মধ্যে কোন তাড়া দেখা গেল না। পেপার ব্যাগ থেকে কফির একটা পাত্র বের করে ধীরে সুস্থে প্লাস্টিকের ঢাকনা খুলল। মুসার দিকে তাকাল। মেশিন খুলে রান করতে কিছুটা সময় লাগবে, হাই তুলতে লাগল
এক ঘণ্টার মধ্যে পাব না? জানতে চাইল মুসা।
মাথা নাড়ল লোকটা, দেড় ঘণ্টা পর এসো, সাড়ে এগারোটার দিকে। খাতা খুলে মুসার নাম-ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর লিখতে শুরু করল সে। এক সেটই করাবে? এ হপ্তায় স্পেশ্যাল বোনাসের ব্যবস্থা করেছি আমার। এর পর যত সেটই নাও, অর্ধেক দামে করে দেব।
থ্যাংক ইউ, লাগবে না, মুসা বলল। এক সেটই যথেষ্ট। সাড়ে এগারোটায় আসব, না? হবে তো?
মাথা ঝাঁকাল ম্যানেজার। নিশ্চয় খুব সাংঘাতিক জিনিস তুলে এনেছ, মুসার দিকে ঝুঁকে চোখ টিপল সে। দাম পাওয়া যাবে, এমন কিছু? আমার নিজের জন্যেও এক সেট করে রাখতাম তাহলে। ভয় নেই, বিনে পয়সায় রাখব না, কমিশন পাবে।
রাখলে রাখুনগে। কোন লাভ হবে না আপনার। আমাকেও পয়সা দেয়া লাগবে না। দয়া করে আমার ছবিগুলো আমাকে সময়মত দিয়ে দিলেই আমি খুশি।
আবার মেইন স্ট্রীটে ফিরে এল মুসা। জিনাকে ফোন করা দরকার। জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে সাড়ে এগারোটায় সে, কি করছে।
পে ফোনের দিকে এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। না, আগে থেকে কিছু বলে লাভ নেই। প্রমাণগুলো সব হাতে নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। মুখ বন্ধ করে দেবে ওর। যাতে কোন তর্ক আর করতে না পারে।
তা ছাড়া, এখন ফোনে ওর সঙ্গে জিনা কথা বলবে কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আরও দেড়টি ঘণ্টা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে বেড়ানো বড় কঠিন। সৈকতে রওনা হলো মুসা। কুয়াশা এখনও আছে। ধূসর রঙের ভারী মেঘ জমেছে আকাশে। ঝুলে রয়েছে সাগরের ওপর। সূর্য ঢেকে অন্ধকার করে দিয়েছে। সৈকত থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে সানবেদারদের।
বালিয়াড়ির ধার ধরে কিছুক্ষণ হাঁটল সে। সময়টাকে দ্রুত পার করার জন্যে।
এগারোটা বিশে ফিরে এল ডেভেলপিং স্টোরে। মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে স্বাগত জানাল ওকে ম্যানেজার, সরি!
কি হয়েছে? বুঝতে পারল না মুসা। বেশি তাড়াতাড়ি চলে এসেছিঃ প্রিন্ট রেডি হয়নি?
না, হয়নি, লাল চুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে জোরে জোরে চুলকাতে লাগল ম্যানেজার।
আরও সময় লাগবে? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মুসার কণ্ঠ। ঢিবঢিব বাড়ি মারতে আরম্ভ করেছে হৃৎপিণ্ডটা।
আমার কিছু করার ছিল না, হাত উল্টে হতাশ ভঙ্গি করল লোকটা। মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। গীয়ার। নিউটনস কোভে আমাদের অন্য দোকানে ফোন করে দিয়েছি নতুন পার্টস দিয়ে যাওয়ার জন্যে।