ফোকাস ঠিক করে আরও কাছে থেকে তোলার জন্যে এগিয়ে এল সে। আলো ঠিক আছে নাকি দেখল। তারপর আবার জিনা আর জনকে ফ্রেমে আটকে শাটার টিপতে লাগল।
মুখ তুলল জিনা।
ঝট করে বুদের আড়ালে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল মুসা।
দেখে ফেলল নাকি?
আস্তে করে মাথাটা আবার বাড়িয়ে দিয়ে দেয়ালের ওপরে তুলে সাবধানে। উঁকি দিল।
না, দেখেনি। জনের দিকে ফিরেছে আবার জিনা। কথা বলছে।
আরও সতর্ক হয়ে গেল মুসা। কোনমতেই জনের চোখে পড়া চলবে না। জন দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাবে মুসার উদ্দেশ্য। তারপর কি যে ঘটাবে। খোদাই জানে! ভ্যাম্পায়ারদের ভয়াবহ ক্ষমতার কথা কল্পনা করে এত লোকজন আর আলোর মধ্যেও গায়ে কাঁটা দিল ওর।
দুজনের পেছনে লেগেই রইল সে। ছবি যা তোলা হয়েছে, তাতেই কাজ হয়ে যাবে, তবু আরও ভাল ছবি তোলার অপেক্ষায় রইল সে। পিছে পিছে ঘুরতে লাগল ওদের।
ফেরিস হুইলে চড়ল দুজনে। মেটাল কারে পাশাপাশি বসল, খুব কাছাকাছি, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে।
জুম লেন্স অ্যাডজাস্ট করে ক্যামেরার চোখ দুজনের দিকে তুলে শাটার টিপে দিল মুসা।
নিশ্চয় ছবিটা ভাল উঠেছে। কিন্তু থামল না মুসা। পুরো একটা রোলই শেষ করবে। কোন খুঁত রাখতে চায় না। বেশি ছবি হলে জিনাকে বিশ্বাস। করানো সহজ হবে।
ফেরিস হুইল থেকে নামার পরও ওদের পিছে লেগে রইল সে। গেম বুদগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটছে দুজনে। চওড়া গলিপথের অন্যপাশে বুদের আড়ালে থেকে ওদের অনুসরণ করে চলল সে। সুযোগ পেলেই ক্যামেরা তুলে শাটার টেপে।
ফিল্মে অল্প কয়েকটা শট বাকি থাকতে গলি থেকে বেরিয়ে এল।
ভিড়ের মধ্যে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে তাকাল জিনা। মুসাকে দেখে ফেলল। না চেনার ভান করল। জনের একটা হাত তুলে নিয়ে চোখ ফেরাল অন্য দিকে।
জিনা কিছু বলল না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। বলল না বলেই জনের চোখে পড়ল না।
বেশিক্ষণ আর থাকবে না দুজনের এই খাতির। জন ভ্যাম্পায়ার-এটা বোঝার পর কি প্রতিক্রিয়া হবে জিনার, কি করবে, কল্পনায় দৃশ্যটা দেখে মুচকি হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।
আর ওদের অলক্ষে ছবি তোলা যাবে না। দরকারও নেই। অনেক তুলেছে। ক্যামেরাটা খাপে ভরল মুসা।
আসল কাজ হয়ে গেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ছবিগুলো ডেভেলপ করতে হবে। জিনাকে দেখাতে হবে।
খাপটা পেটের সঙ্গে চেপে ধরে দৌড় দিল সে। না ধরলে বাড়ি লাগে। কার্নিভলের মাঠ থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে, এই সময় ওর নাম ধরে ডাকল কে যেন। টনিই হবে।
কিন্তু থামল না মুসা। ফিরেও তাকাল না।
সারি সারি গাড়ির ফাঁক-ফোকর দিয়ে পার্কিং লটটা প্রায় দৌড়ে পেরোল সে। মেইন রোডে বেরিয়ে ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল। ফিল্ম ডেভেলপ করার দোকানটা রয়েছে এক ব্লক দূরে, ডিউন লেনের মোড়ে। বড় বড় হরফে বিজ্ঞাপন করে রেখেছে ওরা: এক ঘণ্টার মধ্যে ছবি দিয়ে দেয়া হয়।
ছবি পেতে এক ঘণ্টা! তারপর আর বড় জোর এক ঘণ্টা। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জিনাকে বোঝাতে সক্ষম হবে সে, জন একটা ভ্যাম্পায়ার।
মেইন রোড পেরিয়ে অন্যপাশের ফুটপাথে উঠল মুসা। উত্তেজনায় ধাক্কা। মেরে বসতে লাগল এর ওর গায়ে। পরোয়াই করল না। কনুইয়ের গুতোয়। ভিড় সরিয়ে পথ করে নিয়ে ছুটে চলল। একটাই লক্ষ্য–ক্যামেরার দোকান।
মাঝবয়েসী এক লোক কোন্ আইসক্রীম খাচ্ছিল। মুসার ধাক্কা লেগে হাত থেকে পড়ে গেল আইসক্রীম। ছুটতে ছুটতেই সরি বলল মুসা। লোকটার জবাব শোনার অপেক্ষা করল না। ক্যাঙারুর মত লাফাতে লাফাতে চলেছে ডিউন লেনের দিকে।
কাছাকাছি পৌঁছে আবার রাস্তা পেরোতে হবে। ট্র্যাফিক লাইটের দিকে তাকাল না। দিল দৌড়। সামনে পড়ল নীল রঙের একটা স্টেশন ওয়াগন। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল ড্রাইভার। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কি যেন বলল।
ফিরেও তাকাল না মুসা।
ওর কানে বাজছে কেবল এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টার মধ্যে হাতে এসে যাবে ছবিগুলো। জন যে ভ্যাম্পায়ার, তার জোরাল প্রমাণ।
দোকানটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। কোনদিকে না তাকিয়ে দরজার নব চেপে ধরে টান দিল।
কিছুই ঘটল না। নব ঘুরল না। দরজাও খুলল না।
বন্ধ হয়ে গেছে দোকান। অন্ধকার। বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার।
১৫.
পরদিন সকাল আটটায় ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কথাটাই মনে পড়ল–ফিল্ম।
ডেভেলপ করতে হবে। জিনাকে দেখাতে হবে। ভ্যাম্পায়ারের বিরুদ্ধে প্রমাণ।
জিনাকে বাঁচাতে হবে।
কাপড় পরে, ঢকঢক করে এক গ্লাস কমলার রস খেয়ে, বাবা-মা ঘুম থেকে ওঠার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। দৌড়ে চলল শহরের দিকে। একটা হাত প্যান্টের পকেটে ঢোকানো। শক্ত করে ধরে রেখেছে ফিল্ম ভরা প্লাস্টিকের কৌটাটা।
রাতের বেলা কোন এক সময় সাগর থেকে ভেসে এসেছে কুয়াশা। ছড়িয়ে পড়েছে ডাঙার ওপর। তার মধ্যে দিয়ে ছুটছে মুসা। শহরের কিনারে যখন পৌঁছল, সামান্য হালকা হলো কুয়াশা। কিছু কিছু জায়গা থেকে সরেও গেল। তবে আকাশে মেঘ, আছে। ধূসর, থমথমে হয়ে আছে। বাতাস ঠাণ্ডা। বাড়িঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশা যেন আটকে রয়েছে।
মেইন রোডে উঠল সে। এত সকালে লোকজন নেই। স্যান্ডি হোলোর অন্যান্য দোকানপাটের মতই ছবি ডেভেলপের দোকানটাও দশটার আগে খোলে না।