চলতে চলতে একবার ফিরে তাকাল জিনা। মুসা এখনও পেছন পেছন আসছে কিনা দেখল বোধহয়। জন একটিবারের জন্যেও ফিরল না।
ঠিকই সন্দেহ করেছি আমি! নিজেকে বলল মুসা। আমার ধারণাই ঠিক! পথের মোড়ে দুজনকে হারিয়ে যেতে দেখল।
কিন্তু কি করে প্রমাণ করবে জিনার কাছে? কিশোরকে খবর দেবে? যদি ওকে না পাওয়া যায়? পাওয়া গেলেও আসতে যদি দেরি করে ফেলে? বাঁচানো যাবে না জিনাকে।
বাঁচাতে হলে তাড়াতাড়ি কিছু করা দরকার।
কি করবে? কি করে বোঝাবে ওকে?
উপায়টা বিদ্যুৎ চমকের মত ঝিলিক দিয়ে উঠল মাথার মধ্যে। হ্যাঁ, এটাই। একমাত্র পথ! নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে জিনা।
.
১৪.
ক্যামেরা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? লিভিং রূম থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল মুসা। ও, বাবা, তুমি। দেখিইনি। খাপে ভরা ক্যামেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘরের মধ্যে এগিয়ে এল আবার। কখন এলে?
এই তো। কিসের ছবি তুলতে যাচ্ছ?
রাতে সৈকতে অনেক পাখি পড়ে, মিথ্যে কথা বলল মুসা। ভ্যাম্পায়ারের কথা বললে বাবাও হয়তো বিশ্বাস করবেন না। একশো একটা কথা বলা, লাগবে। বোঝানোর জন্যে। অত সময় নেই। দেখি, তোলা যায় নাকি?
হাতের পত্রিকাটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখলেন আমান। পাখি? রাতের বেলা? কি পাখি? সী-গাল ছাড়া আর তো কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
ওগুলোই তুলব। নানা রকম কাণ্ড করে রাতের বেলা। এমন ভাবে তাড়া। করে বেড়ায় একে অন্যকে
কিন্তু তার জন্যে তো মুভি ক্যামেরা দরকার। স্টিল ফটোগ্রাফে কি আর ধরা যাবে নাকি?
মুভি আর পাব কোথায় এখন। স্টিলই তুলব, বাবার সঙ্গে মিথ্যে বলতে খারাপ লাগছে মুসার। কিন্তু সত্যি বলার আপাতত কোন পথও দেখতে পাচ্ছে না। জিনাকে বিশ্বাস করাতে পারেনি, টনিকে পারেনি, বাবাকেও পারবে বলে মনে হয় না। বিশ্বাস না করে যদি মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে ভেবে ওকে আটকে দিতে চান, জিনার মহাসর্বনাশ ঘটে যাবে। এতবড় ঝুঁকি এখন কিছুতেই নিতে পারবে না সে।
ঠিক আছে, যা পারো তোলোগে, বললেন তিনি। কিন্তু এটা ব্যবহার করার কিছু নিয়ম আছে, নইলে ছবি ভাল ওঠে না। দাঁড়াও, দেখিয়ে দিচ্ছি, পত্রিকা রেখে উঠে এলেন আমান। রাতের বেলা এটা দিয়ে ছবি তুলতে গেলে ফোকাসিঙের দিকে নজর রাখতে হয়। দেখি, দাও, ঠিক করে দিই।
কার্নিভলে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে মুসা। কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো করলে সন্দেহ হবে বাবার। যা করতে চাইছে করুক। ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল
খাপ থেকে ক্যামেরাটা খুলে নিলেন আমান। কিভাবে সবচেয়ে ভাল ফোকাসিং হবে দেখিয়ে দিলেন। চোখের সামনে কোনভাবে ধরে কিভাবে শাটার টিপতে হবে তা-ও বুঝিয়ে দিলেন।
বাবাকে ধন্যবাদ দিয়ে গুড-নাইট বলে বেরিয়ে এল মুসা।
কানির্ভলে গিয়ে পুরো এক রোল ফিল জিনা আর জনের ওপর খরচ করার ইচ্ছে ওর। ও শুনেছে, ভূতের ছবি ওঠে না। প্রতিটি ছবিতেই যখন জিনা দেখবে ওর একলার ছবি আছে, আশেপাশের সব কিছুর ছবি আছে, কেবল জনের নেই, তখন মুসার কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। জনকে ভ্যাম্পায়ার প্রমাণ করার এটাই একমাত্র পথ।
অর্ধেক দৌড়ে অর্ধেক হেঁটে কার্নিভলে এসে পৌঁছল সে। শক্তিশালী স্পটলাইটের আলোর নিচে এসে দাঁড়াল। আশপাশের সমস্ত জায়গায় জিনা আর জনকে খুঁজতে লাগল ওর চোখ। চতুর্দিক থেকে কানে আসছে চিৎকার চেঁচামেচি, হই-হট্টগোল, হাসির শব্দ। হঠাৎ মনে পড়ল লীলার কথা। ও কোথায় এখন? সৈকতে? নতুন কোন শিকারের সন্ধানে ঘোরাফেরা করছে?
লীলার কথা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জিনাদের খুঁজতে লাগল সে। দুই হাতে ধরে রেখেছে ক্যামেরাটা। যেখানে যে অবস্থায় দেখবে ওদের, সেভাবেই তুলে ফেলবে। ফেরিস হুইলটার কাছে এল। জনতার ভিড়। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ওদের মধ্যে খুঁজল জিনা আর জনকে। হুইলে চড়ার জন্যে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল একদল ছেলেমেয়ে। ধাক্কা মারল মুসার গায়ে।
কাত হয়ে পড়তে পড়তে এক হাতে ক্যামেরা ধরে রেখে আরেক হাতে একটা খুঁটি আঁকড়ে পতন ঠেকাল মুসা। অল্পের জন্যে মাটিতে পড়ল না ক্যামেরাটা। বিড়বিড় করে বলল, উফ, পাগল হয়ে গেছে এক্কেবারে! ক্যামেরা এভাবে হাতে রাখার সাহস পেল না আর। যে রকম উত্তেজিত হয়ে আছে ছেলেমেয়েগুলো, কখন কি ঘটিয়ে বসে ঠিক নেই। খাপে ভরল আবার। তবে ঢাকনাটা না লাগিয়ে খোলাই রাখল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেল জিনা আর জনকে। ফেরিস হুইলটা থেকে একটু দূরে হাত ধরাধরি করে হাটছে।
তাড়াতাড়ি ক্যামেরা খুলে আনতে গিয়ে খাপের ফিতে হাতে পেঁচিয়ে ফেলল মুসা। উত্তেজনায় কাঁপছে। পাশ থেকে খাপটা চলে এল পেটের ওপর। গলার ফিতেতে টান লাগল। কোনমতে বের করে আনল ক্যামেরাটা।
সবে শাটারে টিপ দিচ্ছে, ক্যামেরার চোখ আটকে দিয়ে সামনে চলে এল একটা মেয়ে। শেষ মুহূর্তে মুসার দিকে তাকিয়ে সরি বলল। দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। শাটার টিপে ফেলেছে মুসা। প্রথম ছবিটা নষ্ট হলো।
দ্বিতীয়বার সুযোগ নেয়ার আগেই কয়েক গজ দূরে সরে গেল জিনারা। একটা রিফ্রেশমেন্ট বুদের কাছে গিয়ে সুযোগ মিলল আবার। কয়েক ফুটের মধ্যে চলে এল মুসা। ক্যামেরা তুলে শাটার টিপল। তারপর টিপেই চলল, একের পর এক।