জিনা, শোনো! প্লীজ!
না! শুনব না! চিৎকার করে উঠল জিনা। যাও তুমি!
কাল রাতে রিকি আমাকে বলেছে…
ঝটকা দিয়ে মুসার দিকে মুখ ফেরাল জিনা, কি বললে!
কাল রাতে, রিকি আমাকে বলল…
কোথায় দেখা হলো ওর সঙ্গে!
স্বপ্নে
মুসা, তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার, অনেকটা মোলায়েম হয়ে গেল জিনার কণ্ঠ। সহানুভূতির সুর। রিকির জন্যে আমাদের সবারই কষ্ট…কিন্তু তোমার বেলায় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে…তোমার মগজে কিছু ঘটে গেছে। তোমার চিকিৎসা দরকার।
না, আমার কোন কিছুর দরকার নেই, হতাশা চাপা দিতে পারল না মুসা। আমি জানি আমি ঠিক আছি, জিনা। আমার কথা শুনলে পাগলামিই মনে
হা, পাগলই হয়ে গেছ তুমি, মুসার চোখে চোখ রেখে বলল জিনা। সেটা নিজে তুমি বুঝতে পারছ না।
আমি জানি আমি পাগল হইনি! দয়া করে আমার কথা কি একটু শুনবে?
এখন পারব না। আমি এখন একটা জিনিস খুঁজছি।
কি জিনিস খুঁজছ?
মাথা নিচু করে আবার হাঁটতে শুরু করল জিনা। মনে হলো কিছু হারিয়েছে রাস্তায়। স্যান্ডেলের ঘষায় খসখস শব্দ হচ্ছে। চঞ্চল হয়ে খোঁজাখুঁজি করছে চোখ জোড়া। মুসার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল, একটা রূপার ক্রুশ। কাল রাতে জনের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। তখন কোনভাবে গলা থেকে পড়ে গেছে ওটা।
ক্রুশ! তোমার গলায় ক্রুশ! তাজ্জব হয়ে গেল মুসা। তুমি আবার ধর্ম পালন শুরু করলে কবে থেকে? গির্জায় যাও?
ধর্ম পালন না করলে কি ক্রুশ গলায় পরা যায় না? গত জন্মদিনে আমার এক নানা দিয়েছিলেন। আসলে ওটা একটা লকেট। ক্রুশের মত করে তৈরি। মাঝখানে একটা পাথর বসানো।
তোমার নানা কি পাদ্রী নাকি?
কি করে বুঝলে?
নাতনীকে ক্রুশের মত লকেট উপহার দেন যিনি, তিনি ওরকমই কিছু হবেন, এটা আন্দাজ করতে জ্যোতিষ হওয়া লাগে না। কিন্তু কাল পরতে গিয়েছিলে কেন?
মা সুটকেস থেকে জিনিসপত্র বের করছিল। ওটা দেখে হঠাৎ পরতে ইচ্ছে করল। নিয়ে নিলাম। হারিয়ে ফেলব কল্পনাই করিনি। খুঁজে এখন বের করতেই হবে। নইলে খুব কষ্ট পাবে মা। রেগে যাবে।
রূপার ক্রুশ! অন্ধকারে যেন আশার আলো দেখতে পেল মুসা। শুনেছে, ভূতেরা নাকি ক্রুশকে ভয় করে। ভ্যাম্পায়ারেরা তো যমের মত ভয় করে।
জন দেখেছে নাকি ওটা? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মুসা। দেখে কি করল? তোমার গলায় দেখে সরে গেল না? ফেলে দিতে বলল না? কুঁকড়ে গিয়েছিল?
জবাব দিল না জিনা।
ওর সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। মুখ দেখে অনুমানের চেষ্টা করল, জন কি করেছিল।
এ রকম পাগলের মত করছ কেন তুমি, বলো তো? ভুরু কুঁচকে ফেলেছে জিনা। সত্যি কথাটা শুনবে? ক্রুশটা ওকে দেখিয়েছি। ও পছন্দ করেছে।
চোখ অন্যদিকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেনি?
না। মোটেও ভয় পায়নি। বরং চেনের হুক একবার খুলে গিয়েছিল। সে ওটা আটকে দিতে সাহায্য করেছে আমাকে।
পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দুজনে। তারপর রুক্ষকণ্ঠে জিনা বলল, এতেই প্রমাণ হয়ে গেল তোমার ধারণা ভুল।
না, কিছুই প্রমাণ হলো না, নাছোড়বান্দার মত জিনার পিছে পিছে হাঁটতে লাগল মুসা। ভিন্নভাবে জিনাকে বোঝানোর চেষ্টা চালাল, এখনও তোমার ক্লান্ত লাগে? সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়?
তোমার ওই বোকার মত প্রশ্নের কোন জবাব আর আমি দেব না, মুসার দিকে ফিরেও তাকাল না জিনা।
হাল ছাড়ল না মুসা, দিনের বেলা কখনও দেখা হয়েছে জনের সঙ্গে দেখা না করার ছুতো দেখায়নি-বলেনি দিনে জরুরী কাজ থাকে বলে আসতে পারে না? ও যেখানে কাজ করে সে-জায়গাটা চেনো? একবারও তোমার মনে হয়নি সেরাতে আমরা যখন পিজ্জা খাচ্ছিলাম, কেন সে মুখে তুলতেও রাজি হয়নি?
রাগে ঝাঁকি দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জিনা। মুঠো হয়ে গেছে দুই হাত। মুসা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
যা জিজ্ঞেস করছি, জবাব দাও, জিনা!
তুমি এখন বিদেয় হলে আমি খুশি হব।
না, বিদেয় হব না। যতক্ষণ না তুমি আমার কথা শুনছ, আমি যাব না।
মুসা, দোহাই লাগে তোমার! চিৎকার করে উঠল জিনা, যাও এখন! বিরক্ত কোরো না! আমার অসহ্য লাগছে!
গেল না মুসা। বরং জিনাকে শান্ত করার জন্যে ওর কাঁধে হাত রাখতে গেল।
ঝটকা দিয়ে সরে গেল জিনা।
জনের আগমনটা টেরই পায়নি মুসা। যখন দেখল, নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, খাইছে!
জনের পরনে কালো জিনস, গায়ে লম্বা হাতাওয়ালা কালো পুলওভার। এত গরমের মধ্যে এই পোশাক পরে না সাধারণত কেউ।
কি হয়েছে? মুসার দিকে তেড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইল সে।
ভয়ে বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হলো মুসার। পেটে খামচি দিয়ে ধরার মত অনুভূতি। ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল হাত-পা।
না, কিছু হয়নি, জিনা বলল।
এক পা পিছিয়ে এল মুসা। দুহাত ঝুলে পড়েছে দুই পাশে। জনের চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি যেন, গরম লোহার চোখা শিকের মত ঢুকে যাচ্ছে তার মগজের মধ্যে।
বললাম তো কিছু হয়নি, জন যে রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলল জিনা। এমনি কথা বলছিলাম আমরা।
জিনার দিকে ফিরল জন। মুহূর্তে বদলে গেল মুখের ভঙ্গি। হাসল। সেই এমনি কথাটা আমাকে নিয়েই হচ্ছিল। মুসাকে আমার নাম বলতে শুনলাম।
হ্যাঁ, ভুল শোনোনি, জনের হাত ধরল জিনা। টান দিল।
পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল দুজনে। চলে যাচ্ছে।
কিছুই করার নেই আর মুসার। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। জনের জ্বলন্ত দৃষ্টি যেন এখনও বিদ্ধ করছে ওকে।