রান্নাঘরে নেমে এল সে। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে জিনাদের নম্বরে ফোন করল। অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। রিঙ হচ্ছে। একবার। দুবার।
রিঙ হয়েই চলেছে।
ধরল না। তারমানে কেউ বাড়ি নেই।
জিনা, প্লীজ! চিৎকার করে অনুরোধ করল সে। ধরো! কথা আছে। তোমার সঙ্গে!
কাউন্টারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। কানে রিসিভার ঠেকানো। ওপাশে বেজেই চলেছে ফোন।
জিনা, প্লীজ!
কিন্তু কেউ ধরল না তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে।
.
১৩.
দ্রুত নাস্তা সেরে নিয়ে আবার জিদের বাড়িতে ফোন করল মুসা। জবাব পেল না।
অনেকটা শক্তি ফিরে পেয়েছে শরীরে। জিনাকে শহরে খুঁজতে চলল সে।
খুব গরম একটা দিন। নব্বইয়ের ঘরে তাপমাত্রা। এই অঞ্চলের জন্যে গরমটা বেশি। শহরে আসতে আসতেই ক্লান্ত হয়ে গেল মুসা। মেইন স্ট্রীটের। আশপাশে সব জায়গায় খুঁজে কোথাও না পেয়ে সৈকতে রওনা হলো।
ওখানেও পাওয়া গেল না তাকে।
বাড়িতে ফিরে এসে সারাটা দিন কাটিয়ে দিল কাউচে শুয়ে। কয়েক মিনিট পর পরই উঠে জিনাদের বাড়িতে ফোন করল। রিঙের পর রিঙ হতে থাকল, কিন্তু কারও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কেউ ধরল না ফোন।
বিকেলে আবার শহরে গেল সে। জিনাকে খোঁজার জন্যে।
আই, মুসা,সী-ব্রিজ রোড ধরে যাওয়ার সময় কানে এল একটা পরিচিত
ফিরে তাকাল সে।
প্রায় দৌড়ে এল টনি। তারপর, কি খবর?
ভাল, গতি না কমিয়েই জবাব দিল মুসা।
গাছের আড়ালে নেমে যাচ্ছে সূর্য। কিন্তু গরম এখনও বেশ। বাতাসের আর্দ্রতাও বেশি। চামড়া চুলকাচ্ছে মুসার। শরীরটা লাগছে বিশ মন ওজন।
সৈকতে খুঁজে এলাম তোমাকে, মুসার সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে টনি। যা গরম পড়েছে, ভাবলাম ওখানেই থাকবে। এখানে আশা করিনি।
তুমিও এখানে থাকবে ভাবিনি, শুকনো গলায় মুসা বলল। আর্কেডের এয়ারকন্ডিশনের ঠাণ্ডা ফেলে সৈকতে গেলে কি বুঝে?
যেতাম না, হাসতে হাসতে বলল টনি। কি যেন খারাপ হয়ে গেছে। ওদের। মেরামত করছে।
টনি, আমার শরীরটা ভাল নেই, আগের রাতের পুরো ঘটনাটা বলল না মুসা। বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সময় নষ্ট না করে জিনাকে খুঁজে বের করতে হবে। কি ঘোর বিপদে রয়েছে সে, বোঝানো দরকার। টনির সঙ্গে দেখা না হওয়াটাই এখন ভাল ছিল।
হ্যাঁ, তোমাকে দেখে অসুস্থই লাগছে।
কি রকম?
মুখ শুকনো। বিধ্বস্ত। আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হাসি হাসল, ভ্যাম্পায়ার নাকি?
দাঁড়িয়ে গেল মুসা, কি বলতে চাও?
মানে, কাল যে বললে…আবার ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল নাকি? কি যেন নাম, লীলা–তোমার রক্তও খেয়েছে নাকি?
না। এমনিতেই শরীর খারাপ। জ্বরটর হবে। ভাইরাস।
হাসিটা মুছে গেল টনির মুখ থেকে। মিথ্যে বলছ কেন, মুসা? সত্যি সত্যি বলো তো, কি হয়েছে তোমার?
জবাব না দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল মুসা।
পিছে পিছে চলল টনি। শেষ হয়ে এল কটেজের সারি। সামনে ঘাসে ঢাকা মাঠ, যেটার ওপাশে শহর। দিনের আলো নিভে আসছে দ্রুত। যেন হ্যারিকেনের চাবির মত চাবি ঘুরিয়ে ক্রমে কমিয়ে দেয়া হচ্ছে আলোটা। দিগন্তে নেমে যাওয়া সূর্য বেগুনী আকাশে প্রচুর লাল রঙ গুলে দিয়েছে।
রাতে কার্নিভলে যাবে? জিজ্ঞেস করল টনি। আমার কয়েকজন বন্ধু প্রথমে যাবে আর্কেডে। অন্ধকার হয়ে গেলে তখন যাবে কার্নিভলে।
দেখি, কোন আগ্রহ দেখাল না মুসা। জিনাকে চোখে পড়তে চিৎকার করে উঠল, আই, জিনা!
কয়েক গজ সামনে মাথা নিচু করে হাঁটছে জিনা। যেন কোন জিনিস খুঁজতে খুঁজতে চলেছে রাস্তায়।
জিনা! গলা আরও চড়িয়ে দিয়ে ডাকল মুসা।
মুসার মনোযোগ এখন ওর দিকে নেই বুঝে, পরে দেখা হবে বলে এগিয়ে গেল টনি। জিনার পাশ কাটানোর সময়, কেমন আছ, জিনা? বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই হেঁটে চলে গেল।
মুসাও দৌড়ে গেল জিনার দিকে। এই, জিনা, শোনো!
থামল জিনা। মুখ তুলে তাকাল। হাসি নেই মুখে। গম্ভীর। অ। তুমি।
বড়ই শীতল আচরণ। কেয়ারও করল না মুসা। ওসব দেখার সময় নেই। এখন। জিনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। বোঝাতে হবে কি ঘটছে।
অধৈর্য ভঙ্গিতে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল জিনা। ম্লান আলোতেও ফ্যাকাসে লাগছে চেহারা। চোখে ক্লান্তির ছাপ। গলার দাগ দুটো দেখা যাচ্ছে।
কথা আছে তোমার সঙ্গে, হাঁপাতে হাপাতে বলল মুসা। আমি সকাল থেকেই
হাত নেড়ে মুসার কথা যেন ঝেড়ে ফেলে দিল জিনা। আমার সময় নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে জনের সঙ্গে দেখা করার কথা…
ওর ব্যাপারেই কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে, প্রায় চিৎকার করে উঠল মুসা। নিজেকে দেখেছ আয়নায়? গলার দাগ দুটো দেখেছ?
দেখো, মুসা, মুহূর্তে রাগ চড়ে গেল জিনার। আবার সেই এক প্যাচাল শুরু কোরো না, মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
এক মিনিট, জিনা, অনুরোধের সুরে বলল মুসা। হাত রাখল জিনার কাঁধে। মাত্র একটা মিনিট ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনো।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চিন্তা করল জিনা। বেশ, ঠিক এক মিনিট। কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের কথা যদি বলতে চাও, শুনব না।
জিনা, আমি ভ্যাম্পায়ারের কথাই বলতে চাই, মরিয়া হয়ে বলল মুসা। নিজের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। জন একটা ভ্যাম্পায়ার। আমি জেনে গেছি। লীলাও তাই। ওরা দুজনেই ভ্যাম্পায়ার।
গুড-বাই, মুসা, শীতল কণ্ঠে বলল জিনা। চোখ ওপরে তুলে, দুই হাত নেড়ে মুসাকে বিদেয় হতে ইঙ্গিত করল।