.
১২.
সেরাতেও রিকিকে স্বপ্ন দেখল মুসা। তাকে সাবধান করে দিতে এসেছিল রিকি। কি করে মারা গেছে, ইনিয়ে-বিনিয়ে জানাল। রক্ত শুষে খেয়ে তাকে শেষ করে দিয়ে সাগরে ফেলে দিয়েছে। গলার ফুটো দুটো দেখাল। ভ্যাম্পায়ারের কাছ থেকে সাবধান থাকতে বলল।
রিকি মিলিয়ে যেতেই একদল ভ্যাম্পায়ারকে আসতে দেখল মুসা। তাড়া। করল ওকে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে আর কোন উপায় না দেখে শেষে সাগরে ঝাঁপ দিল সে। টান দিয়ে মাঝসাগরে ভাসিয়ে নিল ওকে স্রোত। প্রচণ্ড ঢেউ ঝাঁকাতে শুরু করল। বহুদূর থেকে ডাক শোনা যেতে লাগল, এই মুসা, মুসা!
ঘুম ভেঙে গেল মুসার। দেখে ঢেউয়ে নয়, কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিচ্ছেন তার বাবা। কি ব্যাপার? ওঠো। আজ এত দেরি কেন?
অনেক রাতে শুয়েছি, চোখ ডলতে ডলতে জবাব দিল মুসা। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন বাবা। সোনালি রোদ এসে পড়েছে মেঝেতে।
দশটা তো বাজে, টেবিল-ঘড়িটার দিকে হাত তুললেন মিস্টার আমান। ওঠো। আমরা সব কাপড়-চোপড় পরে রেডি। জলদি উঠে কাপড় পরে নাও। পিয়ারে যাওয়ার সময় নাস্তা খেয়ে নিয়ো।
খাইছে! ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বিছানার বাইরে মেঝেতে পা রাখল মুসা। চোখের পাতা আধবোজা করে বাবার দিকে তাকাল, এখনও পুরো খুলতে পারছে না। কোথায় যেন যাওয়ার কথা আমাদের?
ভুলে গেছ? সমুদ্রে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা না? ডক্টর বেনসনের বোটে করে? ছেলের কাধ ধরে আবার ঝাঁকি দিলেন আমান। বসে, আছ কেন? জলদি করো।
কাঁধ ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে রওনা হলেন তিনি।
আমি পারব না, বাবা, বলেই ধপ করে আবার বালিশের ওপর পড়ল মুসা।
দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন আমান। উদ্বেগ ফুটেছে চেহারায়। কি ব্যাপার? শরীর খারাপ?
হ্যাঁ, বলেই তাড়াতাড়ি শুধরে নিল মুসা, না।…জানি না। বুঝতে পারছি না।
হয়েছে কি তোমার? দুপা এগিয়ে এলেন আমান। জ্বর-টর নাকি?
ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, বালিশ থেকে মাথা তুলল না মুসা। অসুস্থ হইনি। এখনও। তবে মনে হয় হব। জীবাণু ঢুকে গেছে।
মুখটাও তো কেমন সাদা সাদা লাগছে। বোটে করে ভোলা সাগরে ঘুরে এলে ঠিক হয়ে যাবে। চলো। ওঠো।
না, বাবা, আমি পারব না। তোমরা যাও। আমি শুয়ে থাকি। ঘুমিয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন আমান। ঘড়ির দিকে তাকালেন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সত্যি যাবে না?
না। ডক্টর বেনসনকে বোলো, আমার জন্যেই দেরি হয়ে গেছে তোমাদের। তিনি কিছু মনে করবেন না।
আনমনে মাথা ঝাঁকালেন আমান। আরেকবার দ্বিধা করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে আবার এগোলেন দরজার দিকে। দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরলেন। এখনও ভেবে দেখো। পরে কিন্তু পস্তাবে। ছিপ দিয়ে বড় মাছ ধরার সুযোগ সব সময় আসে না।
পস্তালেও কিছু করার নেই, বাবা। আমি জোর পাচ্ছি না।
মাথা ঝাঁকিয়ে কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতেই যেন বেরিয়ে গেলেন আমান। কয়েক মিনিট পর সদর দরজা লাগানোর শব্দ কানে এল মুসার। আরও কয়েক মিনিট পর গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ।
কিছুক্ষণ একভাবে পড়ে থাকার পর আস্তে মাথাটা সোজা করল মুসা। ভীষণ ভারী লাগছে। গতরাতের কথা মনে পড়ল। লীলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার সময় একটা বিচিত্র গন্ধ ঢুকেছিল নাকে। বো করে উঠেছিল মাথাটা। তারপর থেকে আর সুস্থ বোধ করেনি।
আরও মনে পড়ল, লীলা পাহাড়ের দিকে চলে গেলে সে-ও পেছন পেছন গিয়েছিল। ও কোথায় যায় দেখার জন্যে। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর এমনই মাথা ঘোরা শুরু হলো, হাটা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়েই থাকতে পারছিল না আর। বসে পড়েছিল। তারপর আর মনে নেই। এক সময় দেখে, বালির ওপর চিত হয়ে পড়ে আছে। ওপরে খোলা আকাশ। আশেপাশে একদম নির্জন। লীলাও ছিল না। উঠে টলতে টলতে কোনমতে বাড়ি ফিরে এসেছে।
বিছানা থেকে নেমে বাথরূমে চলল। পা টলছে। পেটে মোচড় দিচ্ছে। আগের রাতের মত বেহুশ হয়ে যাবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।
বাথরূমে ঢুকে সিঙ্কের ওপর মুখ নামাল। হড়হড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল পেটে যা ছিল।
ওয়াক ওয়াক আর হেঁচকি দিতে দিতে পেট ব্যথা হয়ে গেল, গলা চিরে গেল। পেটে আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। মনে হচ্ছে নাড়ীভুড়ি সব গিট বেঁধে গেছে। বনবন করে মাথা ঘুরছে। কপালে ঠাণ্ডা ঘাম। বাথরূমের ঠাণ্ডা। মেঝেতে বসে পড়ল সে।
কয়েক মিনিট পর গিট বাঁধা অবস্থাটা সামান্য কমল। চোখের সামনে বাথরূমের দেয়াল ঘোরাও বন্ধ হয়েছে।
জিনাকে সাবধান করতে হবে। বোঝাতেই হবে ওকে কি মস্ত বিপদে পড়েছে সে। জনের কথা বলতে হবে।
হঠাৎ কি মনে হতে তাড়াতাড়ি উঠে বেসিনের আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজের গলায় দেখল দাগ আছে কিনা।
নেই!
আহ, বাঁচল! কিন্তু তাহলে মাথা ঘুরল কেন? বেহুশ হলো কেন? মিষ্টি গন্ধটার কথা মনে পড়ল। এরকম গন্ধ ছড়িয়েই কি মানুষকে মাতাল করে ভ্যাম্পায়ার ভূত? অবশ করে দেয় শরীর? যাতে নিরাপদে রক্ত পান করতে পারে?
তারমানে সে বেঁচে গেছে কোনভাবে। হয়তো চলে যাওয়ার পর কোন কারণে আর ফিরে আসেনি লীলা। রক্ত খায়নি। তাহলে গলায় দাঁতের দাগ থাকতই।
দাঁত ব্রাশ করল সে। চোখেমুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটে দিল। একটা বেদিং স্যুট পরে নিল তাড়াতাড়ি। হাত-পা কাঁপছে এখনও। তবে ভ্যাম্পায়ারে রক্ত খেয়ে কাহিল করে রেখে যাওয়ার ভয়টা কেটেছে।