আনমনে ভাবতে ভাবতে পাহাড়টার দিকে এগিয়ে চলল সে। গভীর চিন্তায় ডুবে না থাকলে আরও আগে দেখতে পেত। চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়াল। কাপুনি শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে।
একটা উঁচু বালির ঢিবিতে পড়ে আছে কালোমত কি যেন। নিথর।
খাইছে! কি ওটা? আবার লাশ!
১১.
আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে নিচু, ছায়ায় ঢাকা বালিয়াড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। ঘুরে দৌড় দিতে ইচ্ছে করছে। জিনিসটা কি দেখার কৌতূহলও দমন করতে পারছে না।
ভয় আর কৌতূহলের লড়াই চলল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। কৌতূহলের জয় হলো। পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করল সে। কাছে পৌঁছে দেখল মানুষই, তবে মৃত নয়। কালো আঁটসাঁট পোশাক পরা মেয়েটা বসে আছে বালিয়াড়ির ওপর, দুই পা জড় করে, হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে।
লীলা! ডাকল সে।
জবাব দিল না মেয়েটা।
লীলা? জোরে ডাক দিয়ে আরেক পা আগে বাড়ল মুসা। ভয় কাটেনি এখনও। পা কাঁপছে।
তবু সাড়া দিল না মেয়েটা।
বালিয়াড়ির একেবারে কাছে এসে আবার ডাক দিল মুসা, এই, লীলা!
অবশেষে মুখ তুলল লীলা। আবছা অন্ধকারেও চকচক করছে তার গালের পানি। কাঁদছিল।
সরি, এক পা পিছিয়ে গেল মুসা। বিব্রতকর অবস্থা। কি করে সামাল। দেবে বুঝতে পারছে না। আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে আবার বলল, সরি!
ওর দিকে তাকিয়ে কয়েকবার চোখ মিটমিট করল লীলা। চিনতে অনেক সময় লাগল। দ্বিধান্বিত মনে হলো ওকে। যেন নিজের গভীর বেদনা, গভীর ভাবনায় হারিয়ে ছিল, বাইরের কারও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
হাসল। জোর করে দুই হাত তুলে ডলে ডলে মুছল চোখের পানি। গালের পানি মুছল।
ও, তুমি! চিনতে পারিনি, থেমে থেমে বলল নীলা। নিজের হাত দুটো তুলে রেখেছে মুসা। ওগুলোকে নিয়ে কি করবে, যেন দ্বিধায় পড়ে গেছে। অবশেষে দুই পাশে ঝুলিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমার কি হয়েছে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লীলা। জানি না। খালি কান্না পাচ্ছে।
রিকির জন্যে? বলেই থমকে গেল। প্রশ্নটা বোকার মত হয়ে গেল না তো! মানে, আমি বলতে চাইছি…।
রিকির জন্যেই, লীলা বলল। সৈকতে, শহরে, যেখানেই যাই, মনে হয় এই বুঝি সামনে পড়ল রিকি। এই বুঝি ডেকে উঠল হাই করে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না ও নেই। ওর এ ধরনের কিছু ঘটবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। কাউকে এ ভাবে মরতে দেখিনি তো। লাশই দেখিনি কখনও।
বুঝতে পারছি, লীলার দিক থেকে আস্তে করে পানির দিকে মুখ ফেরাল মুসা। আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না। খুব খারাপ লাগছে আমারও। ও আমার বন্ধু ছিল।
জবাব দিল না লীলা। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়াল। কাপড়ে লেগে যাওয়া বালি ঝাড়ল। ধীর পায়ে নেমে এসে দাঁড়াল মুসার সামনে। এত কাছে, ওর নিঃশ্বাস পড়তে লাগল মুসার মুখে।
বন্ধু হিসেবে ও যে কি ছিল তোমার কাছে, সে তো বুঝতেই পারছি। আমার সঙ্গে মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়, তাতেই যে কষ্টটা লাগছে, আবার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল লীলার। গাল বেয়ে গড়াতে লাগল। সহ্য করতে পারছি না।
হ্যাঁ, ও খুব ভাল মানুষ ছিল, লীলার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। মুসা। সম্মোহন করে ফেলা হচ্ছে যেন তাকে।
চারপাশ থেকে ওদের ঘিরে বইছে সাগরের হাওয়া।
হাত তুলল লীলা। এলোমেলো চুল সরাল মুখের ওপর থেকে। একটু বেশিক্ষণই হাতটা উঠে রইল ওর আর মুসার মুখের মাঝখানে। একটা মিষ্টি গন্ধ ঢুকল মুসার নাকে। কিসের বুঝতে পারল না সে। পারফিউমের গন্ধই হবে হয়তো।
মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল মুসার। এমন লাগছে কেন? আগের রাতে ভাল ঘুম হয়নি। সারাদিনে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেছে। হয়তো সেজন্যেই খারাপ লাগছে।
কাল রাতে কেন যে সাঁতার কাটতে নেমেছিল রিকি বুঝলাম না, জোর করে লীলার চোখ থেকে চোখ সরাল মুসা।
আমিও না।
ও কিন্তু খুব শান্তশিষ্ট ছিল, মাথার ঘোর লাগা ভাবটা ঝাড়া দিয়ে সরানোর। চেষ্টা করতে লাগল মুসা। রাত দুপুরে হঠাৎ এরকম একটা কাণ্ড করার মত স্বভাব ছিল না।
সেটা ওর সঙ্গে কয়েকদিনের পরিচয়েই বুঝেছিলাম, মুসার মাথা ছাড়িয়ে বহুদূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল লীলা। নির্জন সৈকতটা দেখছে। অবাক লেগেছে। সেজন্যেই। কাল রাতে আমাকে কটেজে পৌঁছে দিয়ে যখন বলল সে স্কিনডাইভ করতে যাচ্ছে, বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি ভেবেছি বাড়ি ফিরে যাবে।
অবাক কাণ্ড! মাথা ঘুরছে মুসার।
সকালে যখন শুনলাম খবরটা… কথা আটকে গেল লীলার। শব্দ করে কেঁদে উঠল।
সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ওর কাঁধে হাত রাখল, মুসা। কেপে উঠল লীলা। কয়েকটা সেকেন্ড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে মুখ তুলে তাকাল। জোর করে হাসি ফোঁটাল মুখে। সরি!…কি করব? কিছুতেই থামাতে পারছি না। ঘটনাটার পর তোমাকেই প্রথম পেলাম, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারছি।
মুসার হাতটা ধরল সে। আরও এগিয়ে এল।
অস্বস্তি বোধ করছে মুসা।
ওর গলার দিকে তাকাচ্ছে লীলা। চোখে চোখ রাখল আবার।
মুসার অস্বস্তি বাড়ছে। সরে যাওয়ার কথা ভাবছে।
সেটা বুঝতে পারল বোধহয় লীলা। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ওর চোখে চোখে চেয়ে রইল। দ্বিধা করছে। কোন একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। যেন। আচমকা হাতটা ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। কোন কথা না বলে ঘুরে লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়াতে শুরু করল পাহাড়ের দিকে।
কি ভেবে মুসাও পিছু নিল তার।