দেখি, নতুন কাউকে ধরার চেষ্টা করতে হবে।
কাকে? পরিচিত কাউকে?
ঠিক করিনি এখনও। ভেবে দেখতে হবে।
*
সারাটা দিন কি করে কাটালে? উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে বালিয়াড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল টনি।
সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। ঘাসের ডগায় পানি লেগে আছে। হাঁটতে গেলে নাড়া লেগে পায়ে পড়ে পা ভেজে। মুসার মনে হলো, বোকামি হয়ে গেছে। শর্টস না পরে জিনস পরে আসা উচিত ছিল। বিড়বিড় করে বন্ধুর কথার জবাব দিল, কিছুই না।
আসলেই কিছু করেনি সে। বেশির ভাগ সময় লিভিং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেছে, পায়চারি করেছে, রিকির লাইটারটা বের করে হাতে নিয়ে দেখেছে, স্বপ্নের কথা ভেবেছে, জিনা ওর কথা না শুনে তাড়িয়ে দেয়ায় দুঃখ পেয়েছে।
লাইটারটা এখনও হাতেই আছে ওর। রাখতে ভাল লাগছে। বন্ধুর একমাত্র স্মৃতি।
বালি শুকিয়ে যাচ্ছে দেখো, কত তাড়াতাড়ি, স্যান্ডেলের ডগা দিয়ে খোঁচা দিল টনি, কি আশ্চর্য, তাই না? সারাটা দিন ধরে বৃষ্টি হলো, আর কত সহজেই না সেটা শুষে নিল বালি।
সাগরের দিকে তাকাল মুসা। সন্ধ্যার শুরুতে মেঘগুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে। রাতের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দিগন্তে ফ্যাকাসে চাঁদের চারপাশ ঘিরে পানির একটা নীলচে বৃত্ত তৈরি হয়েছে।
কি ভাবছ এত? মুসাকে জবাব দিতে না দেখে জিজ্ঞেস করল টনি।
টান দিয়ে একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাঁতে কাটতে শুরু করল মুসা।
কি, বলছ না যে? অ্যাই, মুসা?
কি বলব?
যা ভাবছ।
বললে বিশ্বাস করবে না। হয় হাসবে, নয়তো জিনার মত রেগে গিয়ে দর্শন শোনাতে শুরু করবে।
মানে?
স্বপ্ন দেখে একটা কথা মাথায় এসেছিল। জিনাকে বলতে গিয়েছিলাম। দূর দূর করে খেদিয়েছে আমাকে।
আমি ওরকম কিছু করব না। নিশ্চিন্তে বলে ফেলো।
তা-ও দ্বিধা করতে লাগল মুসা। টনির চাপাচাপিতে শেষে বলতে বাধ্য। হলো স্বপ্নের কথা, রিকি কিভাবে মারা গেছে, সেই সন্দেহের কথা। ভ্যাম্পায়ার ব্যাটের কথাই শুধু বলল সে। জনকে যে ভ্যাম্পায়ার ভাবছে এ কথা চেপে গেল।
নিজে হাসল না টনি, যেহেতু কথা দিয়েছে। তবে জিনার কথা বলল, হাসবেই তো। ছেলেমানুষের মত কথা বললে কে না হাসে।
তুমিও বললে ছেলেমানুষ! জানো, স্বপ্ন অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। অনেক আবিষ্কার, অনেক যুদ্ধ।
থামো, থামো, হাত তুলল টনি, ওসব আমি জানি। ওগুলো ছিল সব বাস্তব
এটা অবাস্তব, এই বলবে তো? কিন্তু টনি, ভুলে যেয়ো না, রিকির মৃত্যুটা বাস্তব।
কে ভুলে যাচ্ছে? রিকির মৃত্যুটা বাস্তব। আর বাস্তব কারণেই সেটা ঘটেছে, পানিতে ডুবে। তুমি কি ভেবেছ, জিনা আর আমি শুনলেই তোমার কথায় লাফিয়ে উঠব? ভ্যাম্পায়ারে রক্ত শুষে খেয়ে খেয়ে খতম করে দিয়েছে। রিকিকে-দারুণ এই আবিষ্কারের জন্যে তোমাকে বাহবা দিতে থাকব, পিঠ চাপড়াব?
টনির দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। আহত স্বরে বলল, জিনাকে আমি বলতে গিয়ে বোকামি করে ফেলেছি, এটা ঠিক। সেই দুঃখ ভোলার জন্যে কারও ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলাম, সে তুমি। কিন্তু তুমিও যে এভাবে হাসাহাসি শুরু করবে…
হাসি মুছে গেল টনির মুখ থেকে। তাড়াতাড়ি বলল, সরি। তোমাকে দুঃখ দেয়ার জন্যে বলিনি কিন্তু।
মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দে মুখ তুলে তাকাল মুসা। দুটো বাদুড় উড়ে চলেছে বালিয়াড়ির দিকে।
বিজ্ঞানের ক্লাসে স্যার বলেছেন, বাদুড় খুব ভাল প্রাণী, ঘাসের ডগা চিবাচ্ছে টনি, কথা স্পষ্ট হলো না। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্যে ওদের প্রয়োজন আছে। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ওরা আমাদের উপকার করে। বাদুড়ের মল দিয়েও ভাল সার হয়।
ওই সার তুমি গিয়ে জমিনে ফেলোগে! তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। আর জাহান্নামে যাক তোমার বিজ্ঞানের ক্লাস।
রাগ করল না টনি। তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। রিকির– কথাটাও মন থেকে সরাতে পারছি না। বেচারা! তা ছাড়া জিনার সঙ্গে ওই অপরিচিত লোকটার খাতির..
বাদ দাও ওসব কথা, হাত নেড়ে বলল মুসা। নিজের কর্কশ স্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল। ভাল্লাগছে না শুনতে!
কোন কথা বলেই আর জমানো যাবে না বুঝতে পেরে টনি বলল, তারচেয়ে চলো প্রিন্সেসে চলে যাই। মন ভাল হবে। যাবে?
মাথা নাড়ল মুসা, না। তুমি যাও। আমি বরং হাঁটাহাঁটি করে মগজটাকে সাফ করা যায় নাকি দেখি।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল টনি। ঠিক আছে, মন ভাল করার চেষ্টা করতে থাকো তুমি। আমি গেলাম।
জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল সে। কিছুদূর গিয়ে মুসার দিকে ফিরে হাত নাড়ল একবার।
বালিয়াড়ির দিকে হাঁটতে থাকল মুসা। চিন্তায় ভারী হয়ে আছে মন। সামনে কতগুলো ছেলেমেয়েকে জটলা করতে দেখে আর সেদিকে এগোল না। ঘুরে গেল পাহাড়টার দিকে। রাতের পরিষ্কার আকাশের পটভূমিতে বিশাল একটা স্তম্ভের মত লাগছে পাথরের কালো চূড়াটা।
জিনার কথা ভাবল। সকালে হয়তো ওর মেজাজ খারাপ ছিল। সেজন্যে কোন কথা শুনতে চায়নি। আবার কি যাবে ওকে বোঝাতে?
নাহ, যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। গিয়ে কোন লাভ নেই। ওর কথা শুনবে না জিনা।
কিন্তু ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই হবে। জন যে ভ্যাম্পায়ার এ বিশ্বাসটা মনে বদ্ধমূল হচ্ছে ক্রমেই। ওর খপ্পর থেকে জিনাকে সরিয়ে আনতে না পারলে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যাবে জিনা।