আহ, থামো না! রাগে শক্ত হয়ে গেছে জিনার শরীর। দয়া করে তোমার বকবকানি থামাও।
কিন্তু, জিনা…
থামো! গর্জে উঠল জিনা।
থমকে গেল মুসা। ভুলটা কি বলল সে? ওর কথা কেন শুনতে চাইছে না। জিনা? বিশ্বাস করুক বা না করুক, কথা তো শুনবে!
মুসা, তোমার বয়েস বেড়েছে। আগের ছোট্ট খোকাটি আর নেই তুমি যে সব সময় ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে থাকবে। এখন আর ওসব মানায় না, তামাটে চোখে রাগে যেন আগুন জ্বলছে জিনার। মুসার কাছে ওর এই আচরণ রীতিমত অস্বাভাবিক লাগল। বড় হও, জিনা বলছে। তোমার এত ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু মারা গেল, আর তুমি বসে বসে হরর ছবির গল্প তৈরি করছ!
না, তা করছি না… চিৎকার করে উঠল মুসাও।
কিন্তু তাকে কথা শেষ করতে দিল না জিনা। দেখো, জীবনটা কাহিনী নয়, বাস্তব।
আশ্চর্য! কবে এত বড় হয়ে গেল জিনা? রকি বীচ থেকে আসার সময়ও তো এরকম ছিল না। স্যান্ডি হোলোতে এসে মাত্র কদিনে…।
জীবনটা যে কাহিনী নয়, আমি জানি, তর্ক করতে গেল মুসা, কিন্তু…
রিকি আমাদের বন্ধু ছিল, চোখের কোণে পানি এসে গেছে জিনার। ওর মৃত্যুতে তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে, আমারও হচ্ছে। মেনে নেয়া কঠিন। কিন্তু এটাই বাস্তব। চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করল না জিনা। অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। কিভাবে মারা গেছে ও, ঠিক করে বলতে পারছে না কেউ। পানিতে ডুবে মরেছে, এ কথাটা মানতে না চাইলে না মানো, তাই বলে ভ্যাম্পায়ারের গল্প! ওই ছেলেমানুষী গল্প দয়া করে আমাকে শোনানোর। চেষ্টা কোরো না আর।
লেকচার তো একখান ভালই দিয়ে দিলে। কিন্তু, জিনা… থেমে গেল। মুসা। আর কি বলবে? তাকিয়ে আছে জিনার গলার দাগ দুটোর দিকে।
জন একটা ভ্যাম্পায়ার! বিড়বিড় করে বলে ফেলল নিজেকেই। জিনাকে শোনানোর জন্যে বলেনি।
কিন্তু শুনে ফেলল জিনা। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে জ্বলন্ত চোখে। তাকাল। কি বললে? পাগল হয়ে গেছ তুমি। যাও এখান থেকে। আমার। সামনে থেকে সরো। তোমাকে সহ্য করতে পারছি না।
ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জিনা। গটমট করে রওনা হলো ঘরে ঢোকার জন্যে।
মুসাও ঢুকতে গেল। দরজার কাছ থেকে তাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিল জিনা। না, আসার দরকার নেই। যাও! আর কোনদিন আসবে না এখানে। তোমার মুখও দেখতে চাই না।
ভেতরে ঢুকে গেল জিনা। কেরিআন্টি বোধহয় নেই এখন ওঘরে, কিংবা ওদের কথা শুনতে পাননি, তাই কোন রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। নেমে এল ডেক থেকে। ক্লান্ত, চিন্তিত ভঙ্গিতে ফিরে চলল। সামনে দিয়ে দৌড়ে পার হয়ে গেল দুটো খরগোশ। দেখলই না যেন সে।
বৃষ্টি শুরু হলো। প্রথমে বড় বড় ফোঁটায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অঝোরে ঝরতে শুরু করল।
মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হাঁটছে মুসা। বৃষ্টিতে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। দুশ্চিন্তায় বৃষ্টির চেয়ে অনেক ভারী হয়ে আছে যেন মগজ।
পানি আর কাদায় জুতো পড়ে ছপছপ শব্দ তুলছে। ওর তারের মত চুলগুলোকে নরম করতে পারছে না পানি, লেপ্টে দিতে পারছে না। তবে শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে লেগে গেছে গায়ের সঙ্গে।
ভাবতে ভাবতে চলেছে সে। জিনা ঠিকই বলেছে, ছেলেমানুষী, উদ্ভট চিন্তা। ভ্যাম্পায়ারের কথা কি করে ভাবতে পারল? কিশোর হলে এরকম ভূতুড়ে ভাবনা কক্ষনো ভাবত না। ভ্যাম্পায়ারের কথা না ভেবে বাস্তব কিছু আবিষ্কার করত।
কিন্তু ভ্যাম্পায়ার ভূত অবাস্তব হলেও ভ্যাম্পায়ার বাদুড় তো বাস্তব। ওরা রক্ত খেয়ে রিকিকে…
তাহলে জিনার গলায় দাগ কেন? ভ্যাম্পায়ার ব্যাট রক্ত খেলে ওরকম দাগ রেখে যায় না।
মাথাটা আবার গরম হয়ে যাচ্ছে। একপাশের গাছগুলোর দিকে মুঠো তুলে আঁকাল সে, যেন শাসাল ওগুলোকে। বৃষ্টি আর বাতাসে নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে গাছের মাথা।
ঘাড় বেয়ে বৃষ্টির পানি অঝোরে ঝরে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে পিঠ। শীত লাগল ওর। গায়ে কাটা দিল।
আবার ভাবতে লাগল ভ্যাম্পায়ারের ভাবনা। জিনার গলার দাগ দুটো নিয়ে ভাবল। কাকে সন্দেহ করবে? জনকে? না ভ্যাম্পায়ার ব্যাটকে?
.
১০.
নীলচে আলোর বিকেলে গভীর ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠল জন। কফিনের ভেতরে হাত নাড়ানোর জায়গা নেই, তার মধ্যেই আড়মোড়া ভাঙল কোনমতে। ডালার বড় বড় ফুটোগুলো দিয়ে আলো আসছে। তবে এত কম, বোঝা যায় বাইরে দিনের আলো শেষ।
বড় করে হাই তুলে ডালায় ঠেলা দিল সে। কাচকোচ আওয়াজ তুলে ওপরে উঠে গেল ডালাটা। উঠে বসে চারপাশে তাকাল। তারপর বেরিয়ে এল কফিন থেকে।
হালকা স্যান্ডেলের শব্দে ফিরে তাকাল সে। ওপাশের ঘর থেকে দরজা দিয়ে এ ঘরে ঢুকল লীলা। কি খবর? ঘুম তাহলে ভাঙল।
তুমি এত আগে জেগেছ কেন?
খিদে। বড় খিদে। সহ্য করতে পারছি না। পেটে খিদে নিয়ে কি ঘুম আসে?
কি আর করা। সহ্য করতেই হবে। আগেই তো বলা হয়েছে আমাদের, এ রকমই ঘটবে…
তা হয়েছে। নাম লিখিয়েছি পিশাচের খাতায়। এখন যে বাঁচি না!
আর কোন উপায় নেই, চালিয়ে যেতেই হবে। একবার যখন ফাঁদে পা দিয়েছি, আর মুক্তি নেই। এখন বেরোতে গেলে কাউন্ট ড্রাকুলার বিশ্বাস হারাব। আর তার বিশ্বাস হারালে কি যে ঘটে, সে তো নিজের চোখেই দেখেছ। বেশি ভাবনাচিন্তা না করে তৈরি হয়ে নাও। বেরোতে হবে। শিকার তো একটাকে দিয়েছ শেষ করে। আজ কি করবে?