গত কয়েকদিনে বার বার কিশোর আর রবিনের অভাব অনুভব করেছে মুসা, বিশেষ করে কিশোরের। এখন ওর এখানে থাকার বড় দরকার ছিল। টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। রবিনকে পাওয়া গেছে। ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। তবে ঠিকমত হাটাচলা করতে সময় লাগবে। আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন ডাক্তার। ইয়ার্ডে পাওয়া যায়নি কিশোরকে। দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন বোরিস জানিয়েছে, রাশেদ পাশার সঙ্গে বাইরে গেছে সে, পুরানো মাল আনতে, কখন ফিরবে কোন ঠিক নেই। হতাশ হয়ে লাইন কেটে দিয়েছে মুসা।
জিনার সঙ্গে আলোচনা জমাতে না পেরে সরে চলে এসেছিল মুসা। ভেবে অবাক হচ্ছিল, কি হয়েছিল রিকির? এত রাতে সাগরে নেমেছিল কেন? মারা গেল কেন? ওই অবেলায় শুধু শুধু সাঁতার কাটতে নেমেছিল রিকি, এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না মুসা।
টাউন করোনার এটাকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু রায় দিয়েই খালাস। কিন্তু মুসা। এত সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না ব্যাপারটা। বুঝতেও পারছিল না। কিভাবে মারা গেছে রিকি।
তবে এখন জানে। স্বপ্ন তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে।
সেই জবাবটা জিনাকেও জানাতে চলেছে সে।
গ্রীষ্মবাসগুলোর পেছন দিয়ে এগোচ্ছে। সাদা সাদা কটেজগুলোর আঙিনায় চওড়া সানডেক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চেয়ার। একটা করে বড় ছাতা আর তার। নিচে টেবিল রয়েছে প্রতিটি আঙিনায়। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে জিনাকে চোখে পড়ল।
লাফ দিয়ে ডেকে উঠল মুসা। জিনার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে চলে এল পেছনের দরজার কাছে।
অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল টেবিলে বসা জিনা। কেরিআন্টি এঁটো থালা-বাসন পরিষ্কার করছেন।
দৌড়ে আসার পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে মুসা। নাস্তা করেছ? জানতে চাইলেন কেরিআন্টি। টেবিলে রাখা প্যানকেকের থালাটা দেখালেন তিনি।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে খাবারের দিকে এগোল না মুসা। জিনাকে দেখছে। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে আসা ধূসর আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে। ওর মুখ। জিনা, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
নীরবে উঠে দাঁড়াল জিনা। এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
ওর পিছু পিছু ডেকে বেরিয়ে এল মুসা। কথাটা জানানোর জন্যে অস্থির। সাগর থেকে বয়ে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। আকাশের ভারী মেঘ অনেক নিচে নেমে এসেছে।
ডেকের রেলিঙে হেলান দিয়ে গাছপালার দিকে তাকিয়ে রইল জিনা। ওর পাশে এসে দাঁড়াল মুসা। শার্টের নিচের অংশটা ওপরে টেনে তুলে সেটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল।
গন্ধ হয়ে গেছে শার্টটায়। নাক কুঁচকাল। তাড়াহুড়ায় আলমারি থেকে থোয়া শার্ট বের করে পরার কথা মনে ছিল না, আগের দিনেরটাই পরে চলে এসেছে। এ নিয়ে মাথা ঘামাল না।
কেমন কাটছে তোমার? মেঘলা আকাশের নিচে গাছপালার কালো মাথার দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জিত স্বরেই যেন জিজ্ঞেস করল জিনা।
ভাল না।
আমারও না।
তোমাকে কয়েকটা জরুরী কথা বলতে এসেছি, জিনা, ভূমিকা শুরু করল মুসা। অস্বস্তি বোধ করছে। ও যা বলবে, সেটা যদি বিশ্বাস না করে জিনা? হাসাহাসি করে?
আমার ঘুম পাচ্ছে। তাজা বাতাসেই বোধহয়।
জিনা, আমি কি বলছি, শুনছ? রিকি কিভাবে মারা গেছে, জেনে ফেলেছি।
চোখের পাতা সরু করে ফেলল জিনা। রক্ত সরে গিয়ে আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা। কিভাবে মারা গেছে, সেটা আমিও জানি, মুসা। পানিতে ডুবে।
জিনা, শোনো, প্লীজ, অধৈর্য ভঙ্গিতে নিজের শার্টের ঝুল ধরে একটানে প্রায় হাঁটুর কাছে নামিয়ে দিল মুসা। প্লীজ, জিনা!
জবাব দিল না জিনা। মুসার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
জবাবটা স্বপ্নের মধ্যে পেয়েছি আমি, গলা কাঁপছে মুসার। কিন্তু আমি জানি, এটাই সত্যি।
এবারও কোন কথা বলল না জিনা। তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।
ভ্যাম্পায়ারে খুন করেছে রিকিকে।
তাই! এক পা পিছিয়ে গেল জিনা। এমন করে দুহাত তুলে ধরল, যেন। মুসার কথার অস্ত্র থেকে আত্মরক্ষা করতে চায়।
ভ্যাম্পায়ার! জোর দিয়ে বলল মুসা। সৈকতের ওপর দিয়ে হাজার হাজার বাদুড় উড়ে যেতে দেখি রোজ। বেশির ভাগই ফলখেকো বাদুড়। আমার বিশ্বাস, ফলখেকোগুলো যেখান থেকে আসে, সেখানে ভ্যাম্পায়ার ব্যাটও আছে। রিকিকে…
মুসা, থামো। এ সব রসিকতা এখন ভাল্লাগছে না আমার, আঁঝাল কণ্ঠে। বলল জিনা। দুই হাত আড়াআড়ি করে রাখল বুকের ওপর।
জিনাকে বোঝাতে গিয়ে ওর গলার দিকে চোখ পড়তে থমকে গেল মুসা। খাইছে বলে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
নানা রকম ভাবনা খেলে যেতে শুরু করল মাথায়। অদ্ভুত সব ভাবনা। সেগুলো বলতে গেলে পাগল বলবে লোকে।
উল্টোপাল্টা দেখছি নাকি আমি?-ভাবল সে। ওগুলো মশার কামড়?
জনের কথা মনে পড়ল তার। জন! এমন কি হতে পারে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট নয়, আসল ভ্যাম্পায়ারের কবলেই পড়েছে জিনা? জন কি ড্রাকুলার মত মানুষরূপী সত্যিকারের রক্তচোষা ভূত?
মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে! আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি! ভাবতে লাগল মুসা।
স্বপ্নে কি দেখেছি আমি, শোনো, আবার যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরেই কথা বলতে লাগল মুসা। মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে চিন্তাগুলো। বাদুড়ের তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল রিকি, আর বাদুড়গুলো…
থামো, মুসা! ফেটে পড়ল জিনা। বললাম তো, ভাল্লাগছে না আমার!
কিন্তু আমি যা বলছি, ঠিকই বলছি! জিনার রাগের পরোয়া করল না মুসা। বোঝার চেষ্টা করো, জিনা। ওই বাদুড়গুলোই যত নষ্টের মূল। রিকি…ওর গলায় এত বেশি কাটাকুটি ছিল, তার মধ্যেও…