হঠাৎ কালো হয়ে এল আকাশ। বিশাল ছায়া পড়ল সৈকতে।
ছায়াটা অনুসরণ করে চলল রিকিকে। এত জোরে ছুটেও কিছুতেই ওটার সঙ্গে পেরে উঠছে না সে।
এখনও রোদের মধ্যেই রয়েছে রিকি, তবে দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে আনছে। ছায়াটা। যেন ওকে গ্রাস করার জন্যে ছুটে আসছে।
দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে আসছে মুসার। বুঝতে পারল, ছায়াটা মেঘের নয়, হাজার · হাজার কালো প্রাণী সূর্যকে ঢেকে দিয়ে এই অবস্থা করেছে।
কালচে বেগুনী পাখা দুলিয়ে উড়ছে ওগুলো। ওড়ার তালে তালে ওঠানামা করছে মাথাগুলো। তীক্ষ্ণ চিৎকারে কান ঝালাপালা করছে।
বাদুড়ের ঝাক তাড়া করেছে রিকিকে।
হাজার হাজার বাদুড় ডানা ঝাঁপটে, প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, কালো চাদর তৈরি করে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। ছায়ায় ঢাকা পড়েছে সৈকত। ওদের তীক্ষ্ণ চিৎকার ঢেউয়ের গর্জনকেও ঢেকে দিয়েছে।
গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে রিকির। চোখ বুজে ফেলল সে। কিন্তু মুখটা খোলাই রইল আতঙ্কে।
থেমো না, রিকি! মুসা বলল। দৌড়াতে থাকো!
কিন্তু কুলাতে পারল না রিকি। ধরে ফেলল ওকে বাদুড়েরা। হুমড়ি খেয়ে বালিতে পড়ে গেল সে। রাতের অন্ধকারের মত ছেকে ধরল ওকে বাদুড়গুলো।
তারপর সব কালো।
ঝটকা দিয়ে বিছানায় উঠে বসল মুসা। নিজের ঘরে রয়েছে দেখে স্বস্তির। নিঃশ্বাস ফেলল। জানালা দিয়ে ভোরের ধূসর আলো ঢুকছে।
বিছানা থেকে যখন নেমে দাঁড়াল সে তখনও ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। চোখে লেগে রয়েছে দুঃস্বপ্নের রেশ।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জানালার দিকে এগোল সে। কানে বাজছে যেন। বাদুড়ের তীক্ষ্ণ চিৎকার। চোখের সামনে দেখছে বাদুড়ের মেঘ! বাদুড়ের ঝাক! সৈকতের বালিতে হুমড়ি খেয়ে পড়া রিকিকে কালো চাদরের মত ঢেকে দিয়েছে!
জানালার চৌকাঠে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যেন ভয়ঙ্কর সেই দুঃস্বপ্নের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা চালাল সে।
কিন্তু বাদুড় দেখল কেন?
স্বপ্ন বিশ্বাস করে না সে। ঘুমের মধ্যে তাহলে কি তার মগজ কোন জরুরী মেসেজ দিতে চেয়েছে? এত প্রাণী থাকতে নইলে বাদুড় কেন?
তবে কি ভ্যা…একটু দ্বিধা করে জোরে জোরে উচ্চারণই করে ফেলল সে: ভ্যাম্পায়ার!
না, ভূতের কথা ভাবছে না সে। ভ্যাম্পায়ার ব্যাটের কথা ভাবছে। ছোট্ট দ্বীপটা থেকে রাতের বেলা ঝাঁকে ঝাকে বাদুড় উড়ে আসতে দেখেছে। বেশির ভাগই নিরীহ ফলখেকো বাদুড়। তবে বড় বাদুড়ের সঙ্গে ছোট আকারের ভ্যাম্পায়ার ব্যাট বাস করাও অসম্ভব নয় ওই নির্জন দ্বীপে।
রক্তচোষা ওই ভয়ঙ্কর বাদুড়গুলোই কি হত্যা করেছে রিকিকে? অসম্ভব নয়। রাতের বেলা সৈকতের নির্জন জায়গায় চলে যেত রিকি। নিজের অজান্তেই ভ্যাম্পায়ারের শিকার হত। চুপচাপ এসে তার শরীর থেকে রক্ত খেয়ে চলে যেত ওগুলো। সেজন্যে দুর্বল বোধ করত, সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করত না। আমাজানের জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ার ধরতে গিয়ে ওই বাদুড় সম্পর্কে বিরাট অভিজ্ঞতা হয়েছে মুসার। জানে, কি রকম নিঃশব্দে এসে গায়ে বসে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। রক্ত খেয়ে চলে যায়। জানা না থাকলে, আর সজাগ এবং ওগুলোর ব্যাপারে পুরোপুরি সতর্ক না থাকলে কিছু টেরই পাওয়া যায় না।
যতই ভাবল, রিকির রহস্যময় মৃত্যুর আর কোন কারণই খুঁজে পেল না মুসা। সব খুনেরই মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকে। এ খুনের কোন মোটিভ পায়নি পুলিশ। তারমানে ভ্যাম্পায়ার। রক্ত খেয়ে খেয়ে শেষ করে দিয়েছে রিকিকে। এটাই মোটিভ। এবং জোরাল মোটিভ।
স্বপ্ন একটা বিরাট উপকার করেছে তার। সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছে।
পুরোপুরি সজাগ হয়ে গেছে মুসা। ঘুমের লেশমাত্র নেই আর চোখে। কুচকানো টেনিস শর্টসটা তাড়াতাড়ি পরে নিল। মাথায় গলিয়ে গায়ে টেনে দিল। আগের দিনের ব্যবহার করা টি-শার্ট। রওনা দিল দরজার দিকে। দাঁত ব্রাশ করার কিংবা মুখ ধোয়ারও প্রয়োজন মনে করল-না।
রান্নাঘর দিয়ে ছুটে বেরোনোর সময় নাস্তার টেবিল থেকে ডাক দিলেন তার বাবা, এই…
কিন্তু ততক্ষণে স্ক্রীনডোরের বাইরে চলে এসেছে সে। পরে কথা বলব, বলে ছেড়ে দিল পাল্লাটা। লাফ দিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল জিনাদের বাড়ির দিকে।
ধূসর রঙ আকাশের। বাতাস ভেজা ভেজা, কনকনে ঠাণ্ডা। বালি ভেজা। তারমানে আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল।
বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায়নি সে। বাইরের কোন শব্দই তার কানে ঢুকতে দেয়নি ভয়াবহ ওই দুঃস্বপ্ন। প্রথমে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন। তারপর বাদুড়ের বাঁশির মত তীক্ষ্ণ চিৎকার।
ভ্যাম্পায়ার ব্যাট!
জিনাকে গিয়ে বলতে হবে। বলবে, সত্যটা জেনে গেছে সে।
ঝলমলে রোদ ছিল, আকাশটা নীলও ছিল; তারপরেও রিকির মৃত্যুর পর গত চারটা দিন কেমন যেন ধূসর, বিষণ্ণ কুয়াশায় ঢেকে দিয়েছিল সব কিছু। মনটা ভীষণ খারাপ ছিল বলেই মুসার কাছে দিনগুলো এ রকম লেগেছে।
ঘটনার ছবিগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসছে তার মনে, কেবল চিৎকার আর শব্দগুলো গেঁথে রয়েছে স্পষ্ট–রিকির বাবা-মায়ের বুকভাঙা কান্না, পুলিশের ভারী ও চাঁপা কন্ঠ, সৈকতে বেড়াতে আসা ছেলেমেয়েদের চমকে চমকে ওঠা, ভীত কথাবার্তা।
গত চারদিনে জিনার সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছে তার। জিনা অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তার সঙ্গে। রিকির মৃত্যু রহস্য নিয়ে আলোচনাটা মোটেও জমেনি।