বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে টেনে দিল দরজাটা। ভোরের শীতল বাতাস শিশিরে ভেজা। একসারি কটেজের পাশ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। সাগরের দিক থেকে আসছে নোনা শুঁটকির গন্ধ।
সৈকতের কিনারে এসে পানিকে একপাশে রেখে গতি বাড়িয়ে দিল সে। কালচে-ধূসর আকাশের ছায়া পড়েছে পানিতে। কালির মত কালো লাগছে পানি। ওকে এগোতে দেখে চারদিকে দৌড়ে সরে যাচ্ছে সী গাল। বেশি কাছাকাছি হলে তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে আকাশে উঠে পড়ছে।
নির্জন সৈকত। কেউ বেরোয়নি এত ভোরে। শরীর চর্চা যারা করে, অথবা বহুমূত্র কিংবা রক্তচাপের রোগী, তারাও নয়। সে একা।
ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকা দিগন্তরেখার কাছে একটা জাহাজের কালো অবয়ব চোখে পড়ছে। কোন ধরনের বার্জ হবে। এই আলোয় কেমন বিকৃত হয়ে গেছে আকৃতিটা, ছায়ার মত কাঁপছে। বাস্তব লাগছে না। মনে হচ্ছে ভূতুড়ে জাহাজ।
গতি কমিয়ে দিল মুসা। তবে দৌড়ানো বন্ধ করার কোন ইচ্ছে নেই। এগিয়ে চলল দৃঢ়পায়ে। একটা অগ্নিকুণ্ডের পাশ কাটিয়ে এল। পুরোপুরি নেভেনি ওটা। কালো ছাইয়ের ভেতরে এখনও ধিকিধিকি আগুন। পোড়া একটা কাঠ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল সাগরে, ঢেউ আবার সেটা ফিরিয়ে এনে ফেলে রেখেছে সৈকতে। বালিতে মরে পড়ে আছে দুটো স্টারফিশ।
নোনা পানির কণা এনে চোখেমুখে ফেলছে বাতাস। ভেজা বালিতে মচমচ শব্দ তুলছে ওর জুতো। ধূসর রঙকে হালকা পর্দার মত সরিয়ে দিয়ে উঁকি দিতে আরম্ভ করেছে ভোরের রক্তলাল আকাশ। সেই রঙ প্রতিফলিত হচ্ছে সাগরেও।
দারুণ সুন্দর। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছে মুসা। ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে। চোখ তুলে তাকালেই সামনে দেখা যাচ্ছে বালিয়াড়ির ওপারে কালচে পাহাড়ের চূড়াটা।
যতই এগোচ্ছে সেদিকে, পায়ের নিচে নুড়ির পরিমাণ বাড়ছে। বালি কম। মাটি শক্ত। পাহাড়ের ছায়া থেকে ঠেলে বেরিয়ে থাকা ডকটাও চোখে পড়ছে। এখন।
আরও এগোতে ডকের কাছে পানিতে কি যেন একটা ভাসতে দেখা গেল।
কোন ধরনের ছোট নৌকা? দূর থেকে ভালমত বোঝা যাচ্ছে না।
পানিতে লাল রোদের ঝিলিমিলি। স্পষ্ট হচ্ছে জিনিসটা। একটা নৌকার পাশে ডুবছে, ভাসছে।
তিমির বাচ্চা নাকি? তীরের কাছে এসে অল্প পানিতে আটকা পড়েছে? নাকি মরে যাওয়া বড় কোন মাছ?
ডকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। দৌড়ে আসার কারণে হাঁপাচ্ছে। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জিনিসটা কি দেখার জন্যে এগিয়ে গেল।
কয়েক পা গিয়েই যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গলার কাছে আটকে আসতে লাগল দম।
পানিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। দুই হাত দুই পাশে ছড়ানো। ভঙ্গিটা মোটেও স্বাভাবিক না।
কোন চিন্তাভাবনা না করেই পানিতে নেমে পড়ল মুসা। গোড়ালি ডুবে গেল ঠাণ্ডা পানিতে। উত্তেজনায় জুতো খোলার কথাও মনে ছিল না। ভিজে গেছে। এখন আর খুলেও লাভ নেই। মানুষটার কোমর ধরে টান দিল। বেশ ভারী। মুখের দিকে না তাকিয়েই কাঁধে তুলে নিল। বয়ে নিল, এল তীরে। শুইয়ে দিল বালিতে।
প্রায় নগ্ন দেহটা কাটাকুটিতে ভরা। ডকের কাছের ধারাল পাথরে ক্রমাগত বাড়ি খেয়ে খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে। একটা কাটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে না।
মুখ দেখার জন্যে চিত করে শুইয়েই চিৎকার করে উঠল মুসা।
রিকি!
দ্রুত একবার পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হয়ে গেল, মারা গেছে রিকি।
ডুবল কি করে? সাঁতার তো ভালই জানত। নাকি ভাটার সময় নেমেছিল পানিতে, স্রোতে টেনে নিয়ে গেছে? জোয়ারের সময় আবার ফেলে গেছে। সৈকতে?
রিকি মৃত! নিজের অজান্তেই হাঁটু ভাজ হয়ে গেল মুসার। পা ছড়িয়ে বসে পড়ল বালিতে। বুজে এল চোখ।
ওর চেয়ে কোন অংশেই খারাপ সাঁতারু ছিল না রিকি। ডোবার কথা নয়, যদি তীব্র ভাটার সময় না নেমে থাকে। কিন্তু রাতের বেলা নামতে গেল কেন সে?
কেন, রিকি, কেন নামলে? চোখ খুলে আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা। চোখে লাগছে কমলা রঙের রোদ। আবার মুদে ফেলল চোখ।
কতক্ষণ একভাবে বসে ছিল সে, বলতে পারবে না। মানুষের কথা শুনে দ্বিতীয়বার চোখ মেলল। এগিয়ে আসতে দেখল দুজন জেলেকে।
.
০৯.
চার রাত পর। আবার ঘুম আসছে না মুসার। বিছানায় গড়াগড়ি করছে। ছটফট করছে। চাদরটা এলোমেলো। বালিশগুলো মেঝেতে। অনেক চেষ্টায় তন্দ্রামত যা-ও বা এল, দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল।
রিকিকে দেখল সে।
অনেক বড় একটা সৈকত। ঝলমলে রোদে বালিকে লাগছে সোনালি। বড় বড় ঢেউ মাথা উঁচু করে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলেদুলে এসে আছড়ে পড়ছে। সৈকতে। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে মাথায় করে বয়ে আনা সাদা মুকুট।
খালিপায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির হলো রিকি। পরনে কালো রঙের সাঁতারের পোশাক। পানির কিনার ধরে দ্রুতপায়ে দৌড়াচ্ছে। কোন শব্দ হচ্ছে না। নিঃশব্দে উড়ে চলেছে যেন বালির ওপর দিয়ে।
তাকে ধরার জন্যে দৌড় দিল মুসা। ফিরে তাকাল না রিকি। মুসাকে কাছে যেতে দিল না। মুসা এগোলে সে-ও গতি বাড়িয়ে দিয়ে সরে যায়।
রোদে আলোকিত সৈকতেও রিকির মুখটা স্পষ্ট নয়। ছায়ায় ঢেকে রয়েছে, যেন।
প্লীজ, রিকি, সামনে ঝুঁকে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছে মুসা, একটু দাঁড়াও। তোমার চেহারাটা দেখতে দাও।
তার অনুরোধেই যেন ফিরে তাকাল রিকি।
চমকে গেল মুসা।
আতঙ্কে বিকৃত হয়ে গেছে রিকির মুখ। ঠেলে বেরোনো চোখ। মুখটা হাঁ হয়ে আছে চিৎকারের ভঙ্গিতে।