বক্তা অনেকক্ষণ ধরিয়া তাঁহার দেশবাসীর ধর্ম ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয় বলেন । সেন্ট্রাল ব্যাপটিস্ট চার্চে ডক্টর এফ. এ. গার্ডনার এবং রেভারেন্ড এস.এফ.নব্স্ বক্তাকে ঘন ঘন খুঁটিনাটি প্রশ্ন করেন । বক্তা বলেন মিশনরীরা ভারতবর্ষে সুন্দর সুন্দর মতবাদ প্রচার করেন, গোড়াতে তাঁহাদের উদ্দেশ্যও ছিল ভাল ,কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেশের লোকের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তাঁহারা কিছুই করেন নাই । বক্তার মতে আমেরিকানদের উচিত ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতে মিশনরী না পাঠাইয়া ভারতবাসীকে শিল্পবিঞ্জান শিখাইবার জন্য কাহাকেও পাঠানো ।
ভারতে স্ত্রী এবং পুরুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছুক্ষণ বলিবার সময় বক্তা বলেন, পতিরা পত্মীর কাছে কখনও মিথ্যা বলে না
এবং পত্মীর উপর অত্যাচারও করে না । তিনি আরও অনেক দোষের উল্লেখ করেন , যাহা হইতে ভারতের পতিরা মুক্ত ।
বক্তাকে জিঞ্জাসা করা হয় যে , এ-কথা সত্য কিনা , দৈব্যদুর্বিপাকের সময় ভারতের জনগণ খ্রীষ্টান মিশনরীদের নিকট সাহায্য পাইয়া থাকে এবং কারিগরীশিক্ষার জন্য তাঁহারা স্কুলও চালান । উত্তরে বক্তা বলেন , কখন কখন মিশনরীরা এই ধরনের কাজ করেন বটে, তবে তাহাতে তাঁহাদের কোন কৃতিত্ব নাই,কেন-না এরূপ সময়ে লোককে খ্রীষ্টধর্মে প্রভাবান্বিত করিবার চেষ্টা বাধ্য হইয়া তাঁহাদিগকে বন্ধ রাখিতে হয়,কারণ আইনতঃ উহা নিষিদ্ধ ।
ভারতের নারীগণের দুর্দাশার কারণ নির্ণয় করিতে গিয়া বক্তা বলেন,হিন্দুরা স্ত্রীজাতিকে এত শ্রদ্ধা করে যে , তাঁহাদিগকে তাহারা বাড়ির বাহিরে আনিবার পক্ষপাতি নয়। গৃহাভ্যন্তরে নারী পরিবারের সকলের সম্মান লাভ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীলোকের সহমৃতা হইবার প্রাচীন প্রথার ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে বক্তা বলেন,পতির উপর পত্নীর এত গভীর ভালোবাসা থাকে যে, তাহাঁকে ছাড়িয়া জীবন-ধারণ করা পত্মীর পক্ষে অসম্ভব। একদিন উভয়ে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন ,মূত্যুর পরও সেই সংযোগ তাহাদের ছিন্ন হইবার নয়।
প্রতিমাপূজা সম্বন্ধে বক্তা বলেন ,তিনি খ্রীষ্টানদের জিঞ্জাসা করিয়াছিলেন, উপাসনার সময় তাঁহারা কি চিন্তা করেন? কেহ কেহ বলিয়াছেন, তাঁহারা গীর্জার কথা ভাবেন, কেহ কেহ বা ঈশ্বরের চিন্তা করেন। বেশ কথা। তাঁহার দেশে লোকে ভগবানের মূর্তির কথা ভাবে। দরিদ্র জনগণের জন্য মূর্তিপূজা প্রয়োজন। বক্তা বলেন , প্রাচীনকালে ভারতীয় ধর্মের প্রথম অভ্যুদয়ের সময়ে নারীরা আধ্যাত্মিক প্রতিভা এবং মানসিক শক্তির জন্য প্রসিদ্ধা ছিলেন। তবে বক্তা স্বীকার করেন, আধুনিক কালে তাঁহাদের অবনতি ঘটিয়াছে। খাওয়া-পর গল্প গুজব এবং অপরের কূৎসা -প্রচার ছাড়া অন্য কিছুচিন্তা তাঁহাদের নাই।
বক্তা স্বদেশে তাঁহার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে বলেন ,একদল সন্ন্যাসীকে তিনি সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া দেশে কারিগরী শিক্ষাপ্রচারের উপযোগী করিয়া তুলিবেন । ইহা দ্বারা জনগণের অবস্থার উন্নতি হইবে।
যে পণ্ডিত সন্ন্যাসীটি এই শহরে কিছুদিন হইল আসিয়াছেন , তিনি রবিবারসন্ধ্যা ৭/৩০এঈস্ট চার্চ -এ বক্তৃতা করিবেন। স্বামী (রেভারেণ্ড) বিবা কানন্দ গত রবিবার সন্ধ্যায় অ্যানিস্কোয়াম শহরে এপিস্কোপাল গির্জায় ভাষন দিয়াছিলেন । ঐ র্গিজার পাদরী এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইট তাঁহাকে আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছিলেন । অধ্যাপক রাইট এই অগন্তুক সন্ন্যাসীকে খুব সমাদর করিতেছেন ।
সোমবার রাত্রে ইনি সারাটোগায় যাইবেন । ওখানে সমাজবিদ্যা সমিতিতে বক্তৃতা দিবেন । পরে শিকাগোর আগামী ধর্মসম্মেলনে তাঁহার বক্তৃতা করিবার কথা । ভারতে যাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত , তাঁহাদের মতো বিবা কানন্দও প্রাঞ্জল এবং শুদ্ধ ইংরাজী বলিতে পারেন । গত শুক্রুবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি ভারতীয় শিশুদের খেলাধূলা, স্কূল এবং চালচলন সম্বন্ধে যে সরলভাবে কথাবার্তা বলিয়াছিলেন , তাহা খুব উপকারী এবং চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল । একটি ছোট মেয়ে যখন বলিতেছিল যে , তাহার শিক্ষকা একবার তাহার আঙুল জোরে চুষিতে থাকায় আঁঙুটি প্রায় ভাঙিবার উপক্রম হইয়াছিল, তখন বিবা কানন্দের দরদী হৃদয় বিচলিত হইয়া উঠয়াছিল । * * * স্বদেশে সকল সন্ন্যাসীর ন্যয় তাঁহাকেও সত্য ,শুচিতা ও সৌভ্রাত্রের ধর্ম প্রাচর করিয়া বেড়াইতে হয় বলিয়া মহৎ কল্যানকর যাহা,তাঁহা তাহার দৃষ্টি এরায় না ,আবার যদি কোথাও বিষম কোন অন্যায় ঘটে , তাঁহাও তাহার নজরে আসে । এই সন্ন্যসী অন্যধর্মাবলম্বীর প্রতি অত্যন্ত উদার , কাহারও সহিত মতে মিল না হইলেও তাঁহার সম্বন্ধে সদয় কথাই ইহার মুখ দিয়া বাহির হয় ।
‘ডেলি গেজেট’, ৫ই সেপ্টম্বর,১৮৯৩’
ভারতের হইতে আগত রাজা স্বানী বিবি রানন্দ রবিবার সন্ধ্যায় ঈস্ট চার্চ-এ ভারতবর্সর ধর্ম এবং দরিদ্র জনগন সম্বন্ধ বক্তৃতা করিয়াছেন ।যদিও শ্রোতৃসংখ্যা ভালই ছিল , তবুও বিষয়টির গুরুত্ব এবং বক্তার আর্কষণের বিবেচণায় আরও বেশী লোক হওয়া উচিত ছিল । সন্ন্যাসী তাঁহার দেশী পোশাক পরিয়াছিলেন এবং প্রায় চল্লিশ মিনিট বলিয়াছিলেন। তাহার মতে আজিকার
ভারতবর্ষ পঞ্চাশ বৎসর আগেকার ভারত নয় । ভারতবর্ষে গিয়া এখন মিশনরীদের ধর্মপ্রচারের কোন প্রয়োজন নাই । গুরুতর প্রয়োজন এখন লোককে কারিগরী এবং সামাজিক শিক্ষাদান । ধর্ম বলিতে যাহা কিছু আবশ্যক, তাহা হিন্দুদের আছে । হিন্দুধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। সন্ন্যাসী খুব মধূরভাষী। শ্রোতৃমণ্ডলীর মনোযোগ তিনি বেশ ধরিয়া রাখিয়াছিলেন ।
‘ডেলি সারাটোগিয়ান’, ৬ই সেপ্টম্বর,১৮৯৩’
* * * বক্তৃতামঞ্চে তাহার পর আসিলেন হিন্দুস্থানের মাদ্রাজ হইতে আগত সন্ন্যাসী বিবে কানন্দ। ইনি ভারতের সর্বত্র প্রচার করিয়া বেড়ান। সমাজবিদ্যায় ইহার অনুরাগ আছে ,এবং বক্তা হিসাবে ইনি বুদ্ধিমান্ চিত্তাকর্ষক ।ভারতের মুসলমান রাজত্ব সম্বন্ধে ইনি বলেলেন ।