‘ডেলি সারাটোগিয়ান ’, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
… বক্তৃতামঞ্চে তাহার পর আসিলেন হিন্দুস্থানের মান্দ্রাজ হইতে আগত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। ইনি ভারতের সর্বত্র প্রচার করিয়া বেড়ান। সমাজবিদ্যায় ইহার অনুরাগ আছে, এবং বক্তা হিসাবে ইনি বুদ্ধিমান্ চিত্তাকর্ষক। ভারতের মুসলমান রাজত্ব সম্বন্ধে ইনি বলিলেন।
অদ্যকার বক্তৃতাসূচীতে কয়েকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আছে, বিশেষতঃ হার্টফোর্ডের কর্ণেল জেকব গ্রীনের আলোচ্য ‘স্বর্ণ ও রৌপ্য—উভয় ধাতুর মুদ্রামান’। বিবে কানন্দ পুনরায় বক্তৃতা করিবেন। এইবার তাঁহার বিষয় হইবে—‘ভারতে রৌপ্যের ব্যবহার’।
০১. ভারতের ধর্ম ও রীতিনীতিসমূহ
গতকল্য বিকালবেলা আবহাওয়া খুব গরম থাকা সত্ত্বেও ‘থট্ অ্যাণ্ড ওয়ার্ক ক্লাব’-(‘চিন্তা ও কাজ সমিতি ‘) বেশ কিছু সভ্য-সভ্যা তাহাদের অতিথিগণ-সহ হিন্দুসন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানোন্দের১ বক্তৃতা শুনিবার জন্য ওয়েসলি হলে জড় হইয়াছিলেন। এই ভদ্রলোক এখন এই দেশে ভ্রমন করিতেছেন। বক্তৃতাটি ছিল একটি ঘরোয়া ভাষণ । প্রধান আলোচ্য বিষয় : ‘হিন্দুগণের ধর্ম -তাহাদের ধর্ম – তাহাদের ধর্মগ্রন্থ বেদে যেভাবে ব্যাখ্যাত’। বক্তা জাতিপ্রথা সম্বন্ধেও বলিয়াছিলেন।তাঁহার মতে জাতি একটি সামাজিক বিভাগমাত্র, উহা ধর্মের উপর নির্ভর করে না।
বক্তা ভারতীয় জণগণের দারিদ্র্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা ভারতবর্ষের আয়তন অনেক ক্ষুদ্র হইলেও তথাকার জনসংখ্যা হইল ২৭ কোটি আর ইহাদের মধ্যে তিন কোটি লোক গড়ে ৫০ সেণ্টেরও কম উপায় করে । দেশের কোন কোন অঞ্চলে মাসের পর মাস, এমন কি বৎসররের পর বৎসর ধরিয়া একপ্রকার গাছের ফুল সিদ্ধ করিয়া জীবনধারণ করে ।
কোন কোন জেলায় পরিবারের জোয়ান মরদরাই খায় ভাত, স্ত্রীলোক ও শিশুগণকে ভাতের ফেন দিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতে হয় । কোন বৎসর ধান না হইলে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভবী । অর্ধেক লোক একবেলা খাইয়া বাঁচে, অর্ধেক একবার কোনমতে খাইতে পাইলে পরের বারে কোথায় খাবার জুটিবে, তাহা জানেন না। স্বামী বিবে কিওন্দের মতে ভারতের অধিবাসিগণের প্রয়োজন অধিক ধর্ম বা উন্নততর কোন ধর্ম নয়, প্রয়োজন কর্মনিপুণতা । আমেরিকার অধিবাসিগণকে ভারতের লক্ষ লক্ষ দুঃস্থ এবং অনশনক্লিষ্ট জনগণের সাহায্য উন্মুখ করিবার আশাতেই তিনি এই দেশে আসিয়াছেন ।
বক্তা কিছুক্ষণ তাঁহার স্বদেশবাসিগণের অবস্থা এবং ধর্ম সম্বন্ধে বলেন । তাঁহার ভাষণের সময় মাঝে মাঝে সেন্ট্রাল ব্যাপটিস্ট চার্চের ডক্টর এফ.এ.গার্ডনার ও রেভারেন্ড এস.এফ.নব্স্ খুঁটিয়া খুঁটিয়া তাঁহাকে প্রশ্ন করেন । বক্তা উল্লেখ করেন, মিশনরীরা ভারতে অনেক দামী দামী কথা আওড়ান এবং শুরুতে অনেক হিতকর কল্পনাও তাঁহাদের ছিল, কিন্তু তাঁহারা কার্যক্ষেত্রে দেশের লোকের শ্রমশিল্প -সংক্রান্ত উন্নতির জন্য কিছুই করে নাই । তাঁহার মতে আমেরিকানদের কর্তব্য – ভারতে ধর্মপ্রচারের জন্য মিশনরীদের না পাঠাইয়া শ্রমশিল্পের শিক্ষা দিতে পারেন , এমন লোক পাঠানো।
দুর্দৈবের সময় খ্রীষ্টান মিশনরীদের কাছে লোকে সাহায্য পায় এবং মিশনরীরা হাতেনাতে শিক্ষাদানের স্কুলও যে খোলেন, ইহা সত্য কিনা , জিঞ্জাসা করিলে বক্তা বলেন, কখনও কখনও তাঁহারা এরূপ করেন বটে, কিন্তু ইহাতে তাঁহাদের কোন কৃতিত্ব নাই, কেন-না ঐরূপ সময় লোককে ধর্মান্তরিত করিবার চেষ্টা আইনতঃ নিষিদ্ধ বলিয়া ঐ চেষ্টা স্বভাবতই তাঁহাদিগকে বন্ধ রাখিতে হয়।
ভারতের স্ত্রী জাতির অনুন্নত অবস্থার কারণ – বক্তার মতে – হিন্দুদের নারীর প্রতি অত্যধিক সম্মান । নারীকে ঘরের বাহিরে যাইতে না দেওয়াই ঐ সম্মান অনুকূল মনে করা হইত । নারী সর্বসাধারণের সংস্পর্শ হইতে দূরে গৃহভ্যন্তরে শ্রদ্ধা ও পূজা লাভ করিতেন । স্বামীর সহিত চিতায় সহমরণ-প্রথার ব্যাখ্যায় বক্তা বলেন,পত্নী পতিকে এত ভালবাসিতেন যে, তাঁহাকে ছাড়িয়া থাকা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বিবাহে তাহারা এক হইয়াছিলেন , মৃত্যুতেও তাঁহাদের এক হওয়া চাই।
বক্তা কে প্রতিমা পূজা এবং জগন্নাথের রথের সম্মুখে স্বেচ্ছায় পড়িয়া মৃত্যুবরণ সম্বন্ধে জিঞ্জাসা করা হইলে তিনি বলেন ,রথের ঐ ব্যাপারে হিন্দুদিগকে দোষ দেওয়া উচিত নয় , কেন না উহা কতকগুলি ধর্মোন্মাদ এবং কুষ্ঠরোগাক্রান্তলোকের কাজ।
বক্তা স্বদেশে তাঁহার কর্মপদ্ধতির বিষয়ে বলেন, তিনি সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া দেশের শিল্পবিঞ্জান-শিক্ষণের কাজে লাগাইবেন, যাহাতে জনগণ প্রয়োজনীয় কার্যকারী শিক্ষালাভ করিয়া নিজেদের অবস্থার উন্নতি করিতে পারে।
আজ বিকালে বিবেকানোন্দের ১৬৬নং নর্থ স্ট্রীটে মিসেস উড্স-এর বাগানে ভারতবর্ষের শিশুদের সম্বন্ধে বলিবেন। যে কোন বালক বালিকা বা তরুণারাও ইচ্ছা করিলে আসিতে পারেন। বিবেকানোন্দের চেহারা বেশ চমৎকার, রঙ কিছু ময়লা,কিন্তু প্রিয়দর্শন । কোমরে দড়ি দিয়া বাঁধা পীতাভ লাল রঙ-এর একটি আলখাল্লা তিনি পরিয়াছিলেন। মাথায় হলুদ রঙ-এর পাগড়ি। সন্ন্যাসী বলিয়া তাহার কোন জাতি নাই, সকলের সঙ্গেই তিনি পানাহার করিতে পারেন ।
‘ডেলি গেজেট’, ২৯শে অগস্ট,১৮৯৩
ভারতবর্ষ হইতে আগত রাজা২ স্বানী বিবি রানন্দ গতকল ওয়েস্লি চার্চে সালেমের ‘থট্ অ্যাণ্ড ওয়ার্ক ক্লাব ‘-এর অতিথিরূপে বক্তৃতা দিয়াছেন । বহুসংখ্যাক ভদ্রমহোদয় ও মহিলা উপস্থিত ছিলেন এবং সম্ভান্ত সন্ন্যাসীর সহিত আমেরিকান রীতিতে করমর্দন করিয়াছিলেন । তাঁর পরিধানে ছিল একটি কমলালেবু রঙের আলখাল্লা , উহার কটি বন্ধটি লাল । তিনি একটি পাগড়িও পড়িয়াছিলেন । পাগড়ির প্রান্ত একদিকে ঝুলিয়া পড়িয়াছিল । উহা তিনি রূমালের কাজে লাগাইতেছিলেন । তাঁহার পায়ে ছিল কংগ্রেস জুতা ।