ভারতবর্ষে যে নানা প্রকারের কুসংস্কার আছে, বক্তা তাহা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলেন, ‘কোন্ জাতি কুসংস্কার হইতে মুক্ত?’ উপসংহারে বক্তা বলেনঃ প্রত্যেক জাতি ভগবানকে তাহাদের একচেটিয়া সম্পত্তি বলিয়া মনে করে। বস্তুতঃ প্রত্যেক জাতিরই ঈশ্বরের উপর দাবী আাছে। সৎপ্রবৃত্তি মাত্রই ঈশ্বরের প্রকাশ। কি প্রাচ্যে কি প্রতীচ্যে মানুষকে শিখিতে হইবে ‘ভগবানকে চাওয়া’। এই চাওয়াকে বক্তা, জলমগ্ন ব্যক্তি যে প্রাণপণ চেষ্টায় বাতাস চায়, তাহার সহিত তুলনা করেন। বাতাস তাহার চাই-ই, কারণ বাতাস ছাড়া সে বাঁচিতে পারিবে না। পাশ্চাত্যবাসী যখন এইভাবে ভগবানকে চাহিতে পারিবে, তখনই তাহারা ভারতে স্বাগত হইবে, কেননা প্রচারকেরা তখন আসিবেন যথার্থ ভগবদ্ভাব লইয়া, ভারত ঈশ্বরবিমুখ—এই ধারণা লইয়া নয়। তাঁহারা আসিবেন যথার্থ প্রেমের ভাব বহন করিয়া, কতকগুলি মতবাদের বোঝা লইয়া নয়।
২৫. মানুষের নিয়তি
[মেমফিস্ শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৭ জানুআরী প্রদত্ত ভাষণের চুম্বক। ১৮ জানুআরী ‘অ্যাপীল অ্যাভালাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত।]
শ্রোতৃসমাগম মোটের উপর ভালই হইয়াছিল। শহরের সেরা সাহিত্যরসিক ও সঙ্গীতামোদীরা, তথা আইন এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। বক্তা কোন কোন আমেরিকান বাগ্মী হইতে একটি বিষয়ে স্বতন্ত্র। গণিতের অধ্যাপক যেমন ছাত্রদের কাছে বীজগণিতের একটি প্রতিপাদ্য বিষয় ধাপে ধাপে বুঝাইয়া দেন, ইনিও তেমনি তাঁহার বিষয়বস্তু সুবিবেচনার সহিত ধীরে ধীরে উপস্থাপিত করেন। কানন্দ৭ নিজের ক্ষমতা এবং যাবতীয় প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে স্বীয় প্রতিপাদ্য বিষয়কে সফলভাবে সমর্থন করিবার সামর্থ্যের উপর পূর্ণবিশ্বাস রাখিয়া কথা বলেন। এমন কোন ভাবধারা তিনি জানেন না বা এমন কোন কিছু ঘোষণা করেন না, যাহাকে শেষ পর্যন্ত তিনি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্তে লইয়া যাইতে পারিবেন না। তাঁহার বক্তৃতার অনেক স্থলে ইঙ্গারসোলের৮ দর্শনের সহিত কিছু সাদৃশ্য আছে। তিনি মৃত্যুর পরে নরকে শাস্তিভোগে বিশ্বাস করেন না। খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা যেভাবে ঈশ্বরকে মানেন, সেইরূপ ঈশ্বরেও তাঁহার আস্থা নাই। মানুষের মনকে তিনি অমর বলেন না, কারণ উহা পরতন্ত্র। সকল প্রকার আবেষ্টন হইতে যাহা মুক্ত নয়, তাহা কখনও অমর হইতে পারে না।
কানন্দ বলেনঃ ভগবান্ একজন রাজা নন, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন এক কোণে বসিয়া মর্ত্যবাসী মানুষের কর্ম অনুযায়ী দণ্ড বা পুরস্কার বিধান করিতেছেন। এমন এক সময় আসিবে, যখন মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিবে এবং বলিবে—আমি ঈশ্বর, আমি তাঁর প্রাণের প্রাণ। আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, নিজেদের মৃত্যুহীন সত্তাই যখন ভগবান্, তখন তিনি অতি দূরে, এই শিক্ষা দিবার সার্থকতা কি?
তোমাদের ধর্মে যে আদিম পাপের কথা আছে উহা শুনিয়া বিভ্রান্ত হইও না, কেননা তোমাদের ধর্ম আদিম নিষ্পাপ অবস্থার কথাও বলে। আদমের যখন অধঃপতন ঘটিল, তখন উহা তো তাঁহার পূর্বেকার নির্মল স্বভাব হইতেই। (শ্রোতৃবৃন্দের হর্ষধ্বনি) পবিত্রতাই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, আর সকল ধর্মাচরণের লক্ষ্য হইল উহা ফিরিয়া পাওয়া। প্রত্যেক মানুষ শুদ্ধস্বরূপ, প্রত্যেক মানুষ সৎ। আপত্তি উঠিতে পারে, কোন কোন মানুষ পশুতুল্য কেন? উত্তরে বলি, যাহাকে তুমি পশুতুল্য বলিতেছ, সে ধূলামাটিমাখা হীরকখণ্ডের মত। ধূলা ঝাড়িয়া ফেল, যে হীরা সেই হীরা দেখিতে পাইবে—যেন কখনও ধূলিলিপ্ত হয় নাই, এমন স্বচ্ছ। আমাদের স্বীকার করিতেই হইবে যে, প্রত্যেক আত্মা একটি বৃহৎ হীরকখণ্ড।
আমাদের মানুষ-ভ্রাতাকে পাপী বলার চেয়ে নীচতা আর নাই। একবার একটি সিংহী একটি ভেড়ার পালে পড়িয়া একটি মেষকে নিহত করে। সিংহীটি ছিল আসন্নপ্রসবা। লাফ দিবার ফলে তাহার শাবকটি ভূমিষ্ঠ হইল, কিন্তু লম্ফন-জনিত ক্লান্তিতে সিংহী মারা গেল। সিংহশিশুকে দেখিয়া একটি মেষমাতা উহাকে স্তন্য পান করাইতে থাকে। সিংহশাবক মেষের দলে ঘাস খাইয়া বাড়িতে লাগিল। একদিন একটি বৃদ্ধ সিংহ ঐ সিংহ-মেষকে দেখিতে পাইয়া ভেড়ার দল হইতে উহাকে সরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সিংহ-মেষ ছুটিয়া পলাইয়া গেল। বৃদ্ধ সিংহ অপেক্ষা করিতে লাগিল এবং পরে উহাকে ধরিয়া ফেলিল। তখন সে উহাকে একটি স্বচ্ছ জলাশয়ের ধারে লইয়া গিয়া বলিল, ‘তুমি ভেড়া নও, সিংহ—এই জলের মধ্যে নিজের আকৃতি দেখ।’ সিংহ-মেষও জলে প্রতিবিম্বিত নিজের চেহারা দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ‘আমি সিংহ, ভেড়া নই।’ আসুন, আমরা নিজেদের মেষ না ভাবিয়া সিংহ ভাবি। আসুন, আমরা মেষের মত ‘ব্যা ব্যা’ করা এবং ঘাস খাওয়া পরিত্যাগ করি।
আমেরিকায় আমার চার মাস কাটিল। ম্যাসাচুসেট্স্ রাজ্যে আমি একটি চরিত্র-সংশোধক জেল দেখিতে গিয়াছিলাম। জেলের অধ্যক্ষকে জানিতে দেওয়া হয় না—কোন্ কয়েদীর কি অপরাধ। কয়েদীদের প্রত্যেকের উপর যেন সহৃদয়তার একটি আচ্ছাদনী ফেলিয়া দেওয়া হয়। আর একটি শহরের কথা জানি, যেখানে বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা সম্পাদিত তিনটি সংবাদপত্রে প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইতেছে যে, অপরাধীদের কঠিন সাজা হওয়া প্রয়োজন। আবার ওখানকার অন্য একটি কাগজের মতে দণ্ড অপেক্ষা ক্ষমাই সুসঙ্গত। একটি কাগজের সম্পাদক পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন, যে-সব কয়েদীকে কঠোর সাজা দেওয়া হয়, তাহাদিগের শতকরা মাত্র পঞ্চাশ জন সৎপথে ফিরিয়া আসে; পক্ষান্তরে যাহারা মৃদুভাবে দণ্ডিত, তাহাদের ভিতর শতকরা নব্বই জন কারামুক্তির পর সদ্বৃত্তি অবলম্বন করে।