অন্যের নিকট হইতে তুমি নিজে যেরূপ আচরণ চাও, তুমিও তাহার প্রতি সেইরূপ আচরণ কর! ইহা এক ভীষণ বর্বরোচিত ক্রূর নীতি, কিন্তু বক্তা খ্রীষ্টধর্মের এই মতবাদের নিন্দা করিতে চান না, কেননা যাহারা ইহাতে সন্তুষ্ট, তাহারা ইহার সহিত নিজদিগকে বেশ মানাইয়া লইয়াছে, বুঝিতে হইবে। যে বিপুল জলধারাটি বহিয়া চলিয়াছে, উহাকে বহিতে দেওয়াই কর্তব্য। যিনি উহার গতিকে পরিবর্তিত করিতে চাইবেন, তিনি নির্বোধ। প্রকৃতিই প্রয়োজনমত সকল সমস্যার সমাধান করিয়া দিবেন। বিবে কানন্দ বেশ জোর দিয়াই বলেন যে, প্রেততত্ত্ববাদী বা অদৃষ্টবাদী—ইঁহারা সকলেই ভাল এবং খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীগণকে ধর্মান্তরিত করিবার তাঁহার কোন ইচ্ছা নাই। যাঁহারা খ্রীষ্টধর্ম অনুসরণ করিয়া চলিতেছেন, তাঁহারা বেশ ভালই করিতেছেন। তিনি যে হিন্দু, ইহাও উত্তম। তাঁহার দেশে বিভিন্ন স্তরের মেধাবিশিষ্ট লোকের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মমত প্রচলিত আছে। সবটা মিলিয়া একটি ধারাবাহিক আধ্যাত্মিক ক্রমোন্নতি লক্ষিত হয়। হিন্দুধর্ম আমিত্বকে বড় করে না। ইহার আকাঙ্ক্ষাসমূহ কখনও মানুষের অহমিকাকে জড়াইয়া নয়, ইহা কখনও পুরস্কারের আশা বা শাস্তির ভয় তুলিয়া ধরে না। হিন্দুধর্ম বলে, ব্যক্তি-মানব তাহার ‘অহং’কে বর্জন করিয়া অনন্তত্ব লাভ করিতে পারে।
মানুষকে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের জন্য প্রলোভিত করিবার রীতি—ভগবান্ স্বয়ং পৃথিবীর একটি মানবগোষ্ঠীর নিকট প্রকট হইয়া ইহা প্রবর্তন করিয়াছেন বলা হইয়া থাকে—বস্তুতঃ অতি নিষ্ঠুর এবং ভয়াবহরূপে দুর্নীতিজনক। ধর্মান্ধগণ খ্রীষ্টীয় মতবাদ যদি আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করে, তাহা হইলে উহা তাহাদের নৈতিক স্বভাবের উপর একটি লজ্জাকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে আত্মার অনন্ততা উপলব্ধির সময় পিছাইয়া যায়।
ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ১৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪
গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে বক্তৃতা-প্রসঙ্গে স্বামী বিবে কানন্দ বলেন যে, ভারতে ধর্ম বা সামাজিক নিয়মের বশে বিধবাদের কখনও জোর করিয়া জীবন্ত দাহ করা হয় নাই। এই ঘটনাগুলির সব ক্ষেত্রেই তাঁহারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। পূর্বে ভারতের একজন সম্রাট্ সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু ক্রমশঃ পরে উহা আবার প্রচলিত হয়। অবশেষে ইংরেজ সরকার উহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। সকল ধর্মেই একশ্রেণীর লোক আছে, যাহারা ধর্মোন্মাদ। ইহা খ্রীষ্টধর্মে যেমন, হিন্দুধর্মেও তেমনি। ভারতে এমন সব ধর্মোন্মাদ দেখা যায়, যাহারা তপশ্চরণের নামে দিনের পর দিন সর্বক্ষণ মাথার উপরে হাত তুলিয়া রাখে। দীর্ঘকাল ঐরূপ করিবার ফলে হাতটি ক্রমে অসাড় হইয়া যায় এবং আজীবন ঐ অবস্থায় থাকে। কেহ কেহ ব্রত গ্রহণ করে—একভাবে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবার। ক্রমে ইহাদের শরীরের নীচের দিকে সম্পূর্ণ অবশ হইয়া যায় এবং উহারা আর হাঁটিতে পারে না।
সব ধর্মই সত্য। মানুষ নৈতিকতা অনুশীলন করে, কোন দৈবাদেশের জন্য নয়, উহা ভাল বলিয়াই করে। হিন্দুরা ধর্মান্তরিত-করণে বিশ্বাস করে না। বক্তা বলেন, উহা অপচেষ্টা। অধিকাংশ ধর্মের পিছনে কত ঐতিহ্য, শিক্ষাদীক্ষা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা রহিয়াছে। অতএব কোন এক ধর্মপ্রচারকের পক্ষে অন্য ধর্মাবলম্বী কাহারও ধর্মবিশ্বাসসমূহকে ভুল বলিয়া ঘোষণা করা কী নির্বুদ্ধিতা! ইহা যেন কোন এশিয়াবাসীর আমেরিকায় আসিয়া মিসিসিপি নদীর গতিপথ দেখিবার পর ঐ নদীকে ডাকিয়া বলা, ‘তুমি সম্পূর্ণ ভুল পথে প্রবাহিত হইতেছ। তোমাকে উৎপত্তি-স্থানে ফিরিয়া নূতন করিয়া যাত্রা শুরু করিতে হইবে।’ আবার আমেরিকাবাসী কেহ যদি আল্পস্ পর্বতে গিয়া জার্মান সাগরে পড়িতেছে এমন কোন নদীকে বলে যে, তাহার গতিপথ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা এবং ইহার একমাত্র প্রতিকার হইল নূতন নির্দেশ অনুসারে প্রবাহিত হওয়া—তাহা হইলে উহাও একই প্রকার নির্বুদ্ধিতা হইবে। বক্তা বলেন যে, খ্রীষ্টানরা যাহাকে ‘সোনার নিয়ম’ বলেন, উহা মাতা বসুন্ধরার মতই পুরাতন। নৈতিকতার যাবতীয় বিধানেরই উৎপত্তি এই নিয়মটির মধ্যেই খুঁজিয়া পাওয়া যায়। মানুষ তো স্বার্থপরতার একটি পুঁটলি বিশেষ।
বক্তা বলেন যে, পাপীরা নরকাগ্নিতে অনন্তকাল শাস্তি ভোগ করিবে—এই মতবাদ সম্পূর্ণ অর্থহীন। দুঃখ রহিয়াছে, ইহা যখন জানা কথা, তখন পূর্ণ সুখ কি করিয়া সম্ভব? বক্তা কোন কোন তথাকথিত ধার্মিক ব্যক্তির প্রার্থনা করিবার রীতিকে বিদ্রূপ করেন। তিনি বলেন যে, হিন্দু চোখ বুজিয়া অন্তরাত্মার উপাসনা করে, কিন্তু কোন কোন খ্রীষ্টানকে প্রার্থনার সময় তিনি কোন একটি দিকে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়াছেন, যেন স্বর্গের সিংহাসনে উপবিষ্ট ভগবানকে তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন! ধর্মের ব্যাপারে দুটি চরম হইল—ধর্মান্ধ এবং নাস্তিক। যে নাস্তিক, তাহার কিছু ভাল দিক্ আছে, কিন্তু ধর্মান্ধের বাঁচিয়া থাকা শুধু তাহার ক্ষুদ্র ‘আমি’টার জন্যই। জনৈক অজ্ঞাত ব্যক্তি বক্তাকে যীশুর হৃদয়ের একটি ছবি পাঠাইয়াছেন। এইজন্য তাঁহাকে তিনি ধন্যবাদ দিতেছেন, তবে তাঁহার মতে, ইহা গোঁড়ামির অভিব্যক্তি। ধর্মান্ধকে কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা চলে না। তাহারা একটি অভিনব বস্তুবিশেষ।
১৭. ভগবৎপ্রেম
ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ২১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪