অতঃপর বক্তৃতার প্রকৃত বিষয়ে আসিয়া বিবে কানন্দ প্রথমে মানব-জীবনের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করেন। শরীর বাহিরের খোসা মাত্র; মনও একটি ক্রিয়াশীল বস্তুবিশেষ, ইহার কাজ খুব ত্বরিত এবং রহস্যময়; একমাত্র আত্মাই সুস্পষ্ট ব্যক্তি-সত্তা। আত্মার অন্তরস্বরূপের জ্ঞান হইলে মুক্তিলাভ হয়। আমরা যাহাকে ‘পরিত্রাণ’ বলি হিন্দুরা উহাকে বলেন ‘মুক্তি’। বেশ বলবান্ যুক্তিসহায়ে বক্তা প্রমাণ করেন যে, প্রত্যেক আত্মাই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন। আত্মা যদি কোন কিছুর অধীন হইত, তাহা হইলে উহা কখনও অমরত্ব লাভ করিতে পারিত না। কোন ব্যক্তি কিভাবে আত্মার স্বাধীনতা ও অমরত্বের প্রত্যাক্ষানুভূতি লাভ করিতে পারে, তাহার উদাহরণস্বরূপ বক্তা তাঁহার দেশের একটি উপকথা বর্ণনা করেন।
আসন্নপ্রসবা এক সিংহী একটি মেষের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবার সময় বাচ্চা প্রসব করিয়া ফেলে এবং পরে মারা যায়। সিংহশাবকটিকে তখন এক মেষী স্তন্য পান করাইয়া বাঁচায়। শাবকটি মেষের দলে বাড়িতে থাকে। নিজেকে সে মেষ বলিয়া মনে করিত এবং আচরণও ঠিক মেষের ন্যায়ই করিত। একদিন আর একটি সিংহ আসিয়া তাহাকে দেখিতে পায় এবং তাহাকে একটি জলাশয়ের নিকট লইয়া যায়। জলে সে নিজের প্রতিবিম্ব অপর সিংহের মত দেখিয়া বুঝিল—সে মেষ নয়, সিংহ। তখন সে সিংহের ন্যায় গর্জন করিয়া উঠিল। আমাদের অনেকেরই দশা ঐ ভ্রান্ত সিংহ-মেষের ন্যায়।
নিজদিগকে ‘পাপী’ মনে করিয়া আমরা কোণে লুকাইয়া থাকি এবং যত প্রকারে সম্ভব হীন আচরণ করিয়া চলি। নিজেদের আত্মার পূর্ণতা ও দেবত্ব আমরা দেখিতে পাই না। নরনারীর যে ‘আমি’, উহাই আত্মা। আত্মা যদি প্রকৃতপক্ষে মুক্ত, তাহা হইলে অনন্ত পূর্ণ স্বরূপ হইতে ব্যষ্টিগত বিচ্ছিন্নতা আসিল কিরূপে?—হ্রদের জলে সূর্যের যেমন আলাদা আলাদা অসংখ্য প্রতিবিম্ব পড়ে, ঠিক সেই ভাবে। সূর্য এক, কিন্তু প্রতিবিম্ব-সূর্য বহু। মানবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ এক, কিন্তু নানা দেহে প্রতিবিম্ব-আত্মা বহু। বিম্ব-স্বরূপ পরমাত্মার অব্যাহত স্বাধীনতাকে উপলব্ধি করা যায়। আত্মার কোন লিঙ্গ নাই। স্ত্রী-পুরুষ-ভেদ দেহেই। এই প্রসঙ্গে বক্তা সুইডনবর্গের দর্শন ও ধর্মের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করেন। হিন্দু বিশ্বাসসমূহের সহিত এই আধুনিক সাধু মহাপুরুষের আধ্যাত্মিক ভাবধারার সম্বন্ধ খুবই স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। মনে হইতেছিল সুইডনবর্গ যেন প্রাচীন এক হিন্দু ঋষির ইওরোপীয় উত্তরাধিকারী—যিনি এক সনাতন সত্যকে বর্তমান কালের পোষাক পরাইয়া উপস্থাপিত করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ফরাসী দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক (বালজাক?) তাঁহার ‘পূর্ণ আত্মা’র উদ্দীপনাময় প্রসঙ্গের মধ্যে এই ধরনের চিন্তাধারাকে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন মনে করিয়াছেন। প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই পরিপূর্ণতা বিদ্যমান। তাহার শারীরিক সত্তার অন্ধকার গুহাগুলির ভিতর উহা যেন শুইয়া আছে। যদি বল, ভগবান্ তাঁহার পূর্ণতার কিছু অংশ মানুষকে দেন বলিয়াই মানুষ সৎ হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, পরম দেবতা ভগবানের পূর্ণতা হইতে পৃথিবীর মানুষকে প্রদত্ত ততটা অংশ বাদ গেল। বিজ্ঞানের অব্যর্থ নিয়ম হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক ব্যষ্টি আত্মার মধ্যে পূর্ণতা নিহিত, আর এই পূর্ণতাকে লাভ করার নামই মুক্তি—ব্যক্তিগত অনন্ততার উপলব্ধি। প্রকৃতি, ঈশ্বর, ধর্ম—তিনই তখন এক।
সব ধর্মই ভাল। এক গ্লাস জলের মধ্যে যে বাতাসের বুদ্বুদটি আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে, উহা চেষ্টা করে বাহিরের অনন্ত বায়ুর সহিত যুক্ত হইতে। বাতাসের বুদ্বুদটি যদি তেল, ভিনিগার বা এইরূপ অন্যান্য বিভিন্ন ঘনত্ব বিশিষ্ট তরল পদার্থে আটক পড়ে, তাহা হইলে উহার মুক্তির চেষ্টা তরল পদার্থটির ঘনত্ব অনুযায়ী কম বেশী ব্যাহত হয়। জীবাত্মাও সেইরূপ বিভিন্ন দেহের মধ্য দিয়া উহার স্বকীয় অনন্ততা লাভের জন্য প্রয়াস করিয়া চলিয়াছে। আচার-ব্যবহার, পারিপার্শ্বিক ও বংশগত বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুর প্রভাব—এই-সব দিক্ বিচার করিয়া কোন এক মানবগোষ্ঠীর পক্ষে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম হয়তো সর্বাপেক্ষা উপযোগী। অনুরূপ কারণে আর একটি ধর্ম অপর এক মানবগোষ্ঠীর পক্ষে প্রশস্ত। বক্তার সিদ্ধান্তগুলির চুম্বক বোধ করি এই যে, যাহা কিছু আছে, সবই উত্তম। কোন একটি জাতির ধর্মকে হঠাৎ পরিবর্তন করিতে যাওয়া যেন—আল্পস্ পর্বত হইতে প্রবহমানা একটি নদীকে দেখিয়া কেন উহা তাহার বর্তমান পথটি লইয়াছে, সেই বিষয়ে সমালোচনা করা। আর এক ব্যক্তি হয়তো অভিমত প্রকাশ করিলেন যে, হিমালয় হইতে নিঃসৃতা একটি খরস্রোতা নদী হাজার হাজার বৎসর যে-পথে বহিয়া চলিয়াছে, ঐ পথ উহার পক্ষে স্বল্পতম এবং সুষ্ঠুতম পথ নয়।
খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী ঈশ্বরকে আমাদের পৃথিবীর ঊর্ধ্বে কোথাও উপবিষ্ট একজন ব্যক্তি বলিয়া কল্পনা করেন। কাজেই যে-স্বর্গে সোনার রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে নীচের মর্ত্যলোকের দিকে তাকাইয়া স্বর্গ-মর্ত্যের পার্থক্য বুঝা যায় না, এমন স্বর্গে তিনি স্বস্তিবোধ করিতে পারেন না। যাহাকে খ্রীষ্টানরা আচরণের ‘স্বর্ণোজ্জ্বল নীতি’৬ বলিয়া থাকেন, উহার পরিবর্তে হিন্দুরা এই নীতিতে বিশ্বাস করেন যে, যাহা কিছু ‘অহং’শূন্য তাহাই ভাল; এবং ‘আমিত্ব’-মাত্রই খারাপ, আর এই বিশ্বাস দ্বারা যথাকালে মানুষ তাহার আত্মার অনন্ত স্বরূপ ও মুক্তি লাভ করিতে পারিবে। বিবে কানন্দ বলেন, তথাকথিত ‘সোনার নীতি’টি কী ভয়ানক অমার্জিত! সর্বদাই ‘আমি, আমি’।