হিন্দু দার্শনিক এবং পুরোহিত স্বামী বিবে কানন্দ গত রাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ ‘মানুষের দেবত্ব’ সম্বন্ধে বলিয়া তাঁহার বক্তৃতা বা ধর্মব্যাখ্যান-মালার উপসংহার করিয়াছেন। আবহাওয়া খারাপ থাকা সত্ত্বেও প্রাচ্যদেশীয় এই ভ্রাতার (এই নামেই তাঁহাকে অভিহিত করা তিনি পছন্দ করেন) বক্তৃতামঞ্চে আসিবার আধ ঘণ্টা পূর্বেই সমগ্র গীর্জাটি দরজা পর্যন্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর ভিড়ে ভরিয়া যায়। তাঁহাদের মধ্যে সকল শ্রেণীর ও বৃত্তির লোকই ছিলেন—আইনজীবী, বিচারক, খ্রীষ্ট্রীয় ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী, একজন য়াহুদী ধর্মযাজক এবং মহিলাদের তো কথাই নাই। মহিলারা বার বার উপস্থিত হইয়া এবং প্রখর মনোযোগ সহকারে তাঁহার ভাষণ শুনিয়া এই শ্যামবর্ণ আগন্তুককে তাঁহাদের ভূরি ভূরি প্রশংসাবাদ অর্পণ করিবার সুস্পষ্ট প্রবণতা প্রমাণ করিয়াছেন। বক্তা ভদ্রলোকদিগের বসিবার ঘরে বসিয়া আলাপ আলোচনায় যেমন সকলকে আকর্ষণ করিতে পারেন, সাধারণ বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইয়াও সেইরূপ পারেন।
গতরাত্রের বক্তৃতা পূর্বেকারগুলি হইতে কম বর্ণনামূলক ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ বিবে কানন্দ মানবীয় এবং ঐশ্বরিক ব্যাপার লইয়া তত্ত্ববিদ্যার একটি আস্তরণ বুনিয়া চলেন। তাঁহার কথাগুলি এত যুক্তিসঙ্গত যে, বিজ্ঞানকে তিনি সাধারণ বুদ্ধির মত সরল করিয়া তুলেন। ন্যায়গর্ভ ভাষণটি যেন প্রাচ্য গন্ধদ্রব্য দ্বারা সুবাসিত তাঁহার স্বদেশে হাতে-বোনা এবং অতি চমৎকার নানা রঙের একটি বস্ত্রের মতই সুন্দর, উজ্জ্বল, চিত্তাকর্ষক এবং আনন্দদায়ী। শিল্পী যেমন তাঁহার চিত্রে নিপুণভাবে নানা রঙ ব্যবহার করেন, এই শ্যামবর্ণ ভদ্রলোকও তাঁহার ভাষণে সেইরূপ কাব্যময় উপমা প্রয়োগ করেন। যেখানে যেটি মানায় ঠিক সেখানে সেইটি তিনি বসাইয়া যান। উহার প্রতিক্রিয়া কিছু অদ্ভুত ঠেকিলেও উহার একটি আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। চলচ্চিত্রের মত পর পর দ্রুত তাঁহার যুক্তিপ্রতিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলি উপস্থিত হইতেছিল, আর এই কুশলী বক্তার শ্রমও মাঝে মাঝে শ্রোতৃবৃন্দের উৎসাহপূর্ণ করতালি দ্বারা সার্থকতা লাভ করিতেছিল।
বক্তৃতার পূর্বে ঘোষণা হয় যে, বক্তার নিকট অনেকগুলি প্রশ্ন আনা হইয়াছে। ইহাদের কতকগুলির উত্তর তিনি ব্যক্তিগতভাবে আলাদা দেওয়াই ভাল মনে করেন। তবে তিনটি প্রশ্ন তিনি বাছিয়া রাখিয়াছেন, ঐগুলির প্রত্যুত্তর বক্তৃতামঞ্চ হইতেই দিবেন। প্রশ্নগুলি এইঃ
(১) ভারতের লোকেরা কি তাহাদের শিশু-সন্তানদের কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করে?
(২) জগন্নাথের রথের চাকার নীচে পড়িয়া কি তাহারা মৃত্যুবরণ করে?
(৩) মৃত স্বামীর সহিত কি তাহারা জীবিত বিধবাকেও জোর করিয়া দাহ করে?
বিদেশে একজন আমেরিকানকে নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায় রেড-ইণ্ডিয়ানরা দৌড়াদৌড়ি করে কিনা—এই বিষয়ে, অথবা আমেরিকা সম্বন্ধে ইওরোপে এখনও পর্যন্ত প্রচলিত এই ধরনের আজগুবি খবর সম্বন্ধে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহা হইলে তিনি যেভাবে ঐ-সব প্রশ্নের উত্তর দিবেন, বক্তা বিবে কানন্দ প্রথম প্রশ্নটির জবাব সেই ভাবেই দিলেন। অর্থাৎ প্রশ্নটি এতই আজগুবী যে, উহার কোন গুরুত্বপূর্ণ উত্তর নিষ্প্রয়োজন। কোন কোন সরল কিন্তু অজ্ঞ লোক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, হিন্দুরা শুধু স্ত্রী-শিশুই কেন কুমীরদের মুখে দেয়?—ইহার উত্তরে বিবে কানন্দ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, উহার কারণ বোধ করি এই যে, স্ত্রী-শিশুদের মাংস বেশী নরম আর ঐ আজব দেশের নদীতে যে-সব হিংস্র জলজন্তু থাকে, তাহারা ঐরূপ মাংস সহজে হজম করিতে পারে। জগন্নাথ-সংক্রান্ত প্রশ্নটি সম্বন্ধে বক্তা ঐ তীর্থস্থানের দীর্ঘকাল প্রচলিত রথযাত্রা ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেন এবং বলেন যে, খুব সম্ভবতঃ কখনও কোন কোন অত্যুৎসাহী ভক্ত রথসংলগ্ন দড়িটি ধরিতে এবং টানিতে গিয়া পা পিছলাইয়া চাকার নীচে পড়িয়া মারা গিয়া থাকিবে। এইরূপ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার অতিরঞ্জিত বর্ণনা হইতে পরে নানা বিকৃত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে এবং ঐ-সব শুনিয়া অন্য দেশের সহৃদয় লোক আতঙ্কে শিহরিয়া উঠেন।
হিন্দুরা জীবিত বিধবাদের অগ্নিসাৎ করে—বিবে কানন্দ ইহা অস্বীকার করেন। তবে ইহা সত্য যে, কখনও কখনও কোন বিধবা নিজে স্বেচ্ছায় অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়াছেন। এরূপ যখন ঘটিয়াছে, তখন পুরোহিত এবং সাধুসন্তেরা তাঁহাদিগকে ঐ কার্য হইতে বিরত থাকিতে পীড়াপীড়ি করিয়াছেন; কেননা ইঁহারা সকলেই আত্মহত্যার বিরোধী।
সকলের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও যদি পতিব্রতা বিধবা স্বামীর সহিত সহমৃতা হইবার জন্য জিদ করিতেন, তাহা হইলে তাঁহাকে একটি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিতে হইত। তিনি অগ্নিশিখায় প্রথমে হাত ঢুকাইয়া দিতেন। যদি হাত পুড়িয়া যাইত, তাহা হইলে তাঁহার স্বামীর সহিত সহমরণের ইচ্ছায় আর বাধা দেওয়া হইত না। কিন্তু ভারতই তো একমাত্র দেশ নয়, যেখানে প্রেমিকা নারী প্রেমাস্পদের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় তাঁহার সহিত অমৃতলোকে অনুগমন করিয়াছেন। এই ধরনের মৃত্যুবরণ প্রত্যেক দেশেই হইয়াছে। যে-কোন দেশে ইহা এক প্রকার অস্বাভাবিক ধর্মোন্মত্ততা। অন্যত্র যেরূপ, ভারতেও উহা ঐরূপই অস্বাভাবিক। বক্তা পুনরায় বলেন, ‘না, ভারতবাসী নারীদের পুড়াইয়া মারে না। পাশ্চাত্যদেশের মত তাহারা কখনও ডাইনীদেরও দগ্ধ করে নাই।’