গুরুকুল হইতে প্রত্যাবর্তনের পর ছাত্রেরা বিবাহ করিয়া সংসারী হইতে পারিত। সংসারের দায়িত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই এবং উভয়েরই নিজস্ব অধিকার ছিল। ক্ষত্রিয়দের ক্ষেত্রে কন্যা অনেক সময় নিজের পতি নিজেই মনোনয়ন করিত; কিন্তু অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই পিতামাতাই ঐ ব্যবস্থা করিতেন। বর্তমানকালে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য অনবরত চেষ্টা চলিতেছে। হিন্দুদের বিবাহ-অনুষ্ঠানটি বড় সুন্দর। বর এবং কন্যা পরস্পর পরস্পরের হৃদয় স্পর্শ করিয়া ভগবান্ এবং সমবেত সকলকে সাক্ষী মানিয়া শপথ করে যে, একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিবে। বিবাহ না করা পর্যন্ত কেহ পুরোহিত হইতে পারে না। প্রকাশ্য ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিবার সময় পুরুষের সহিত তাহার পত্নীও যায়। হিন্দুরা এই পাঁচটিকে কেন্দ্র করিয়া মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, যথা—দেবতা পিতৃপুরুষ দরিদ্র, ইতর প্রাণী এবং ঋষি বা শাস্ত্র। হিন্দুগৃহস্থের বাড়ীতে যতক্ষণ সামান্য কিছুও থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত অতিথিকে ফিরিয়া যাইতে হয় না। অতিথির পরিতৃপ্তিপূর্বক ভোজন শেষ হইলে গৃহের শিশুরা খায়, তারপর তাহাদের পিতা এবং সর্বশেষে জননী। হিন্দুরা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দরিদ্র জাতি; কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় ছাড়া কখনও কেহ ক্ষুধায় মারা যায় না। সভ্যতা এক বিরাট কীর্তি। তুলনাস্বরূপ বলা হয় যে, ইংলণ্ডে যদি প্রতি চারিশত ব্যক্তির মধ্যে একজন মদ্যপায়ী থাকে তো ভারতে ঐ অনুপাতে প্রতি দশ লক্ষে একজন। বক্তা মৃত ব্যক্তির শবদাহ-অনুষ্ঠানের একটি বর্ণনা দেন। কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্র ছাড়া এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোন প্রকাশ্য প্রচার করা হয় না। পনর দিন উপবাসের পর মৃতের আত্মীয়েরা পূর্বপুরুষদের নামে দরিদ্রদিগকে অর্থাদি দান করেন অথবা জনহিতকর কোন প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। নৈতিক আদর্শের দিক্ দিয়া হিন্দুরা অন্যান্য সকল জাতি অপেক্ষা প্রভূত উন্নততর।
১৪. হিন্দু দর্শন
ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ১৬ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪
মানরা যখন জেরুজালেম ধ্বংস করে, তখন বহু সহস্র য়াহুদী ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস করে। আরবগণ কর্তৃক স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া বহু সহস্র পারসীকও ভারতে আশ্রয় পায়, কেহই নিপীড়িত হয় নাই। হিন্দুরা বিশ্বাস করে—সকল ধর্মই সত্য। তবে তাহাদের ধর্ম অপর ধর্মসমূহ অপেক্ষা প্রাচীনতর। ইংরেজ মিশনরীদের প্রথম দলটিকে ইংরেজ সরকার যখন জাহাজ হইতে ভারতে নামিতে বাধা দেন, তখন একজন হিন্দুই তাঁহাদের হইয়া দরবার করিয়া তাঁহাদিগকে নামিতে সাহায্য করেন। যাহা সব কিছু মানিয়া লয়, তাহাই তো ধর্মবিশ্বাস। বক্তা অন্ধের হস্তী দর্শনের সহিত ধর্মমতের তুলনা করেন। এক একজন অন্ধ হাতীর দেহের এক একটি অংশ স্পর্শ দ্বারা অনুভব করিয়া হাতী কি রকম, তাহার সিদ্ধান্ত করিয়া বসিয়াছিল। নিজের অভিজ্ঞতার দিক্ দিয়া প্রত্যেকের উক্তিই সত্য হইলেও হাতীর সামগ্রিক বর্ণনা তো কোনটি হইতেই পাওয়া যায় নাই। হিন্দু দার্শনিকরা বলেন, ‘সত্য হইতে সত্যে, নিম্নতর সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে।’ সব মানুষ কোন এক সময় একই রীতিতে চিন্তা করিবে, ইহা যাঁহারা আশা করেন তাঁহারা অলস স্বপ্ন দেখিতেছেন মাত্র। এরূপ অবস্থা উপস্থিত হইলে ধর্মের মৃত্যু ঘটিবে। প্রত্যেক ধর্মই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হইয়া পড়ে, আর প্রত্যেকটি দল দাবী করে যে, উহাই সত্য এবং অপরেরা ভ্রান্ত। বৌদ্ধধর্মে অপর মতাবলম্বীদের উপর নিপীড়ন অবিদিত। বৌদ্ধধর্মই প্রথম নানা দেশে প্রচারক পাঠায় এবং বলিতে পারে যে, লক্ষ লক্ষ লোককে এক বিন্দু রক্তপাত না করিয়া স্বমতে আনিয়াছে। নানা দোষ এবং কুসংস্কার সত্ত্বেও হিন্দুরা কখনও অন্যের উপর অত্যাচার করে নাই। বক্তা জানিতে চান, নানা খ্রীষ্টান দেশের সর্বত্র যে-সর্ব অসাম্য রহিয়াছে, খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা ঐগুলি অনুমোদন করেন কিভাবে?
১৫. অলৌকিক ঘটনা
ইভনিং নিউজ, ১৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪
‘আমি আমার ধর্মের প্রমাণস্বরূপ কোন অলৌকিক ঘটনা দেখাইব—নিউজ-পত্রিকার এই অনুরোধ আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়।’—এই কাগজের জনৈক প্রতিনিধি বিবে কানন্দকে ঐ-বিষয়ক সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি দেখাইলে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রথমতঃ আমি অলৌকিক ঘটনা লইয়া কাজ করি না, আর দ্বিতীয়তঃ আমি যে হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত, উহা অলৌকিক ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। অলৌকিক ঘটনা বলিয়া কিছু আমরা মানি না। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের এলাকার বাহিরে আশ্চর্য অনেক কিছু ঘটিয়া থাকে সত্য, কিন্তু ঐগুলি কোন-না-কোন নিয়মের অধীন। আমাদের ধর্মের সহিত ঐগুলির কোন সম্পর্ক নাই। যে-সব আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ ভারতবর্ষে করা হয় বলিয়া বৈদেশিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়, ঐগুলির অধিকাংশই হইল হাতের চাল বা সম্মোহন-বিদ্যার প্রভাবজনিত চোখের ভ্রম। যথার্থ জ্ঞানী পুরুষেরা কখনও ঐ-সব করেন না। তাঁহারা কখনও পয়সার জন্য হাটে বাজারে এই-সব তুকতাক দেখাইয়া দেশময় ঘুরিয়া বেড়ান না। যাঁহারা যথার্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজিজ্ঞাসু এবং শুধু বালসুলভ কৌতূহলাক্রান্ত নয়, তাঁহারা ঐ-সকল জ্ঞানী-পুরুষের দেখা পান এবং তাঁহাদিগকে চিনিতে পারেন।
১৬. মানুষের দেবত্ব
ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ১৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪