৪৫। শুক হলেন আদর্শ পরমহংস। মানুষের মধ্যে তিনিই সেই অনন্ত সচ্চিদানন্দ-সাগরের এক গণ্ডূষ জল পান করেছিলেন। অধিকাংশ সাধকই তীর থেকে এই সাগরের গর্জন শুনে মারা যান, কয়েকজন মাত্র এর দর্শন পান এবং আরও স্বল্প সংখ্যক এর স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি এই অমৃত-সাগর থেকে পান করেছিলেন!
৪৬। ত্যাগকে বাদ দিয়ে যে-ভক্তি তার অর্থ কি? এটি অত্যন্ত অনিষ্টকর।
৪৭। আমরা সুখ বা দুঃখ কোনটিই চাই না—এ-দুটির মধ্য দিয়ে আমরা সেই বস্তুর খোঁজ করছি, যা এই দুইয়ের ঊর্ধ্বে।
৪৮। শঙ্করাচার্য বেদের মধ্যে যে একটি ছন্দ-মাধুর্য, একটি জাতীয় জীবনের সুরপ্রবাহ আছে, তা ধরতে পেরেছিলেন। বাস্তবিকই আমার সব সময়ই মনে হয় যে, তিনি যখন বালক ছিলেন, তখন আমার মত তাঁরও একটা অন্তর্দৃষ্টি হয়েছিল এবং এই দৃষ্টি দ্বারাই তিনি সেই সুপ্রাচীন সঙ্গীত-ধারাকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। যাই হোক, তাঁর সারা জীবনের কার্যাবলী বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এটি বেদ ও উপনিষদের মাধুর্যের ছন্দিত স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই নয়।
৪৯। যদিও মায়ের ভালবাসা কোন কোন দিক্ দিয়ে মহত্তর, তথাপি পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে ভালবাসা, তা যেন ঠিক পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার সম্পর্কের মত। আদর্শকে এত বেশী জীবন্ত করে তুলতে ভালবাসার মত কিছুই নেই। ভালবাসার ফলে একজনের কল্পনার ছবি অপর জনের মধ্যে বাস্তব হয়ে ওঠে। এই ভালবাসা তার প্রিয়কে রূপান্তরিত করে ফেলে।
৫০। সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে সিংহাসনে বসে সম্পদ্, যশ, স্ত্রীপুত্রাদিকে তুচ্ছজ্ঞান করে জনকের মত হওয়া কি এতই সহজ? পাশ্চাত্যে একের পর এক অনেকেই আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা ঐ অবস্থা লাভ করেছেন, আমি কেবল বলছি যে, এমন বিরাট পুরুষগণ ভারতে তো জন্মগ্রহণ করেন না!
৫১। এই কথা তোমরাও ভুলো না এবং তোমাদের ছেলেমেয়েদেরও শিক্ষা দিতে ভুলো না যে, একটি জোনাকি পোকা ও জ্বলন্ত সূর্যের মধ্যে, একটি ছোট ডোবা ও অসীম সমুদ্রের মধ্যে এবং একটা সর্ষের বীজ ও মেরুপর্বতের মধ্যে যে তফাত, গৃহী ও সন্ন্যাসীর মধ্যে ঠিক সেই রকম তফাত।
৫২। সব কিছুই ভয়ান্বিত, ত্যাগই কেবল নির্ভয়। যে সব সাধু জাল (ঠকবাজ) বা যারা জীবনে আদর্শ-রক্ষায় অসমর্থ হয়েছে, তারাও প্রশংসনীয়, যেহেতু আদর্শের সঙ্গে তাদের সম্যক্ পরিচয় হয়েছে, এবং এ দ্বারা তারা অপর সকলের সাফল্যলাভে কিছুটা সহায়ক।আমরা যেন আমাদের আদর্শ কখনও না ভুলি! রম্তা সাধু বহতা পানি—যে-নদীতে স্রোত আছে সে-নদী পবিত্র থাকে, তেমনি যে-সাধু বিচরণশীল, তিনিও পবিত্র।
৫৩। সন্ন্যাসীর টাকার কথা ভাবা ও টাকা পাওয়ার চেষ্টা করা আত্মহত্যার সামিল!
৫৪। মহম্মদ বা বুদ্ধ মহান্ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু এতে আমার কি? এর দ্বারা আমার কি কিছু ভাল বা মন্দ হবে? আমাদের নিজেদের তাগিদে এবং নিজেদের দায়িত্বেই নিজদিগকে ভাল হতে হবে।
৫৫। এ দেশে তোমরাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হারাবার ভয়ে খুবই ভীত। কিন্তু ব্যক্তিত্ব বলতে যা বুঝায়, তা তোমাদের এখনও হয়নি। তোমরা যখন তোমাদের নিজ নিজ প্রকৃতি জানতে পারবে, তখনই তোমরা যথার্থ ব্যক্তিত্ব লাভ করবে, তার আগে নয়। আর একটা কথা সব সময় এদেশে শুনছি যে, আমাদের সব সময়ে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। তোমরা কি জান না যে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যা উন্নতি হয়েছে, সবই প্রকৃতিকে জয় করেই হয়েছে? আমাদের কোনরূপ উন্নতি করতে হলে প্রতি পদক্ষেপে প্রকৃতিকে প্রতিরোধ করতে হবে।
৫৬। ভারতবর্ষে লোকে আমায় সাধারণের মধ্যে অদ্বৈত বেদান্ত শিক্ষা না দেওয়ার জন্য বলে, কিন্তু আমি বলি যে, একটি শিশুকেও এই জিনিষটা বুঝিয়ে দিতে পারি। উচ্চ আধ্যাত্মিক সত্যগুলির শিক্ষা একেবারে প্রথম হইতেই দেওয়া উচিত।
৫৭। যত কম পড়বে, তত মঙ্গল। গীতা এবং বেদান্তের উপর যে-সব ভাল ভাল গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলি পড়। কেবল এইগুলি হলেই চলবে। বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি সবটাই ভুলে ভরা। চিন্তা করতে শেখবার আগেই মনটা নানা বিষয়ের সংবাদে পূর্ণ হয়ে উঠে। মনকে কেমন করে সংযত করতে হয়, সেই শিক্ষাই প্রথম দেওয়া উচিত। আমাকে যদি আবার নূতন করে শিখতে হয় এবং এই বিষয়ে আমার যদি কোন মতামত দেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তবে, আমি প্রথমে আমার মনকেই আয়ত্তে আনার চেষ্টা করব এবং তারপর প্রয়োজন বোধ করলে অন্য কোন বিষয় শিখব। কোন বিষয় শিখতে লোকের অনেক দিন লেগে যায়, তার কারণ হল তারা ইচ্ছামত মনকে সন্নিবিষ্ট করতে পারে না।
৫৮। দুঃসময় যদি আসে, তবে হয়েছে কি? ঘড়ির দোলন আবার অন্যদিকে ফিরে আসবে। কিন্তু এটাও খুব একটা ভাল কিছু নয়। যা করতে হবে, তা হল একে একেবারে থামিয়া দেওয়া।