সেই গো-পালক আবার গেয়ে চললঃ আমার শস্য কাটা হয়ে গেছে, খড়গুলি সব ঘরে আনা হয়েছে। নদী জলে পূর্ণ হয়ে উঠেছে, পথগুলি ভালই আছে। অতএব হে মেঘ, তুমি আজ ইচ্ছামত বর্ষণ কর।
… এইভাবে চলতে লাগল, অবশেষে সেই গো-পালক অনুতপ্ত এবং বিস্মিত হয়ে বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।
আবার সেই নাপিতের গল্প। তার চেয়ে সুন্দর আর কি হতে পারে?
একজন পবিত্র লোক আমার বাড়ীর ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি যে নাপিত—আমার বাড়ীর নিকট দিয়ে! আমি ছুটে গেলাম, তিনি ফিরে দাঁড়ালেন এবং অপেক্ষা করলেন। আমি বললাম, ‘প্রভু, আমি কি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ এবং তিনি বলিলেন, ‘হাঁ নিশ্চয়।’ তিনি আমার মত নাপিতকেও ‘হাঁ’ বললেন! তারপর আমি বললাম, ‘আমি কি আপনার অনুসরণ করব?’ তিনি বললেন, ‘করতে পার’। আমি যে সামান্য নাপিত আমাকেও তিনি কৃপা করলেন!
৩৪। বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রধান পার্থক্য এইঃ বৌদ্ধধর্ম বলছে—সমস্ত কিছু ভ্রম বলেই জেন; আবার হিন্দুধর্ম বলছে—জেন যে, এই ভ্রমের (মায়া) মধ্যে সত্য বিরাজ করছে। এটি কিভাবে হবে, হিন্দুধর্মে এ-বিষয়ে কোন কঠিন নিয়ম নেই। বৌদ্ধধর্মের অনুশাসনগুলিকে জীবনে প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন সন্ন্যাস-ধর্মের, কিন্তু হিন্দুধর্মের এই অনুশাসনগুলি জীবনের যে-কোন অবস্থাতেই অনুসরণ করা যেতে পারে। সব পথই সেই একসত্যে পৌঁছিবার পথ। এই ধর্মের শ্রেষ্ঠ এবং মহত্তম কথাগুলির একটি—একজন ব্যাধের (মাংস-বিক্রেতার) মুখ দিয়া বলান হয়েছে; একজন বিবাহিতা নারীর দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি একজন সন্ন্যাসীকে ঐ শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই ভাবে দেখা যায় যে বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসি-সঙ্ঘের ধর্মে পরিণত হয়েছে, কিন্তু হিন্দুধর্ম সন্ন্যাস-জীবনকে সর্বোচ্চ স্থান দিলেও জীবনের প্রাত্যহিক কর্তব্যপালনকে ঈশ্বর-লাভের অন্যতম পথ হিসাবে নির্দেশ করেছে।
৩৫। নারীদের সন্ন্যাস-জীবন-বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে স্বামীজী বললেনঃ তোমাদের জন্য কি কি নিয়ম হবে, তা স্থির কর; তারপর ভাবগুলিকে ফুটিয়ে তোল এবং পারলে তার মধ্যে একটু সর্বজনীনতা রাখ। কিন্তু স্মরণ রেখ যে, কোন সময়েই পৃথিবীতে এই আদর্শ জীবনে গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত এমন লোক আধ-ডজনের বেশী পাবে না। সম্প্রদায় গঠনের যেমন প্রয়োজন, তেমনি সম্প্রদায়গত ভাবের উপরে উঠারও প্রয়োজন। তোমাদের উপায় তোমাদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। আইন তৈরী কর কিন্তু আইন এমন ভাবে কর যে, লোকে যখন আইনের অনুশাসন ছাড়াই চলতে অভ্যস্ত হবে, তখন যেন তারা আইনগুলি দূরে ফেলে দিতে পারে। পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে পূর্ণ কর্তৃত্ব যুক্ত করার মধ্যেই আমাদের বৈশিষ্ট্য নিহিত। সন্ন্যাসী-জীবনাদর্শেও এ জিনিষটি করা যেতে পারে।
৩৬। দুটি ভিন্ন জাতির একত্র মিশ্রণের ফলেই তাদের মধ্যে থেকে একটি শক্তিশালী বিশিষ্ট জাতির উৎপত্তি হয়। এরা মিশ্রণ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে চায় এবং জাতির উৎপত্তি এখান থেকেই। এই আপেলের কথাই ধর। ভাল জাতের যেগুলি, সেগুলি মিশ্রণের দ্বারাই হয়েছে, কিন্তু একবার মিশ্রণ করার পর আমরা সেই জাতটা যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য চেষ্টা করি।
৩৭। মেয়েদের শিক্ষার কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেনঃ দেবতাদের পূজায় তোমাদের জন্য মূর্তি অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এই মূর্তিগুলির পরিবর্তন তোমরা করতে পার। কালীমূর্তি যে সর্বদা একই রকম থাকবে, তার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁকে বিভিন্ন নূতন ভাবে যাতে আঁকা যায়, এ বিষয়ে চিন্তা করার জন্য মেয়েদের তোমরা উৎসাহিত কর। সরস্বতীর এক-শ রকম বিভিন্ন ভাব কল্পনা হোক। তাদের ভাবগুলিকে অবলম্বন করে তারা ছবি আঁকুক, ছোট পট-মূর্তি তৈরী করুক এবং রঙের কাজ করুক।
মন্দিরের ভিতর বেদীর সবচেয়ে নীচের ধাপে যে কলসীটা, তা যেন সব সময় জলে পূর্ণ থাকে এবং তামিল দেশে যে মাখনের প্রদীপ, সেগুলি সব সময় জ্বেলে রাখা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে যদি বরাবরের জন্যে উপাসনাদির ব্যবস্থা রাখতে পার, তবে হিন্দুভাবের দিক্ থেকে আর বেশী কিছু করার থাকবে না। কিন্তু যে অনুষ্ঠানগুলি পালন করবে, সেগুলি যেন বৈদিক হয়। একটি বৈদিক মতের বেদী থাকবে, যাতে পূজার সময় বৈদিক (যজ্ঞের) অগ্নি জ্বালা হবে। এ-রকম একটি ধর্মানুষ্ঠান ভারতের সব লোকেরই শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবে।
সব রকম জন্তু-জানোয়ার যোগাড় কর। গরু থেকে আরম্ভ করলে ভাল হয়, কিন্তু তার সঙ্গে বেড়াল পাখী এবং অন্যান্য জন্তুগুলিও রেখ। ঐগুলিকে খাওয়ান, যত্ন করা প্রভৃতি কাজ ছেলেমেয়েদের করতে দাও।
তারপর জ্ঞানযজ্ঞ। এটি সবচেয়ে সুন্দর জিনিষ। তোমরা কি জান যে, প্রত্যেক বই-ই ভারতে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়—কেবল বেদই নয়, ইংরেজী ও মুসলমানদের বইগুলিও সবই পবিত্র।
প্রাচীন শিল্পকলার পুনঃপ্রবর্তন কর। জমান দুধ দিয়ে ফলের বিভিন্ন খাবার কিভাবে প্রস্তুত করা যায়, মেয়েদের সে-সব শেখাও। শৌখিন রান্নাবান্না শেলাই-এর কাজ শেখাও। তারা ছবি আঁকা, ফটোর কাজ, কাগজ কেটে বিভিন্ন রকমের জিনিষ তৈরী করা, সোনা রুপোর উপর সুন্দর সুন্দর কাজ করা ইত্যাদি শিখুক। লক্ষ্য রাখ—তারা প্রত্যেকেই এমন কিছু শিখুক, যাতে প্রয়োজন হলে তাদের জীবিকা তারা অর্জন করতে পারে।
মানুষকে কখনও ভুলো না। সেবার দৃষ্টি নিয়ে মানুষকে পূজা করার ভাবটা ভারতে সূক্ষ্মাকারে বর্তমান, কিন্তু এটা কোন দিনই বিশিষ্ট মর্যাদা পায়নি। তোমার ছাত্রেরা এ-বিষয়ে চেষ্টা করুক। এদের বিষয়ে কবিতা রচনা কর, শিল্প সৃষ্টি কর। হাঁ, প্রত্যহ স্নানের পর খাওয়ার আগে কেউ যদি ভিখারীদের পায়ে গিয়ে পূজা করে, তবে তার হাত এবং মাথা দুটিরই আশ্চর্য-রকম শিক্ষা হবে। আবার কখনও কিছুদিন ছোট শিশুদের বা তোমাদের ছাত্রদেরও হয়তো পূজা করলে অথবা কারও নিকট থেকে শিশুদের চেয়ে এনে তাদের খাওয়ালে, পরিচর্যা করলে। মাতাজী১ আমায় যা বলেছিলেন, তা কি?—স্বামীজী, আমি অসহায়, কিন্তু এই যে পবিত্রাত্মা এরা, এদের যে পূজা করি, এরাই আমায় মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে। দেখ, তাঁর ভাব হল যে, একটি কুমারীর মধ্য দিয়ে তিনি উমারই সেবা করছেন। এই ভাবদৃষ্টি এবং তা দিয়ে একটি বিদ্যালয়ের পত্তন করা খুবই আশ্চর্যের বিষয়।