ভ্রমাত্মক কোন বিষয় সম্বন্ধে এইটুকু স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যক্ষানুভূতি তখনই প্রমাণস্বরূপ গৃহীত হতে পারে, যদি প্রত্যক্ষ অনুভব যে যন্ত্রের মাধ্যমে হয়েছে সেই যন্ত্রটি, অনুভবের পদ্ধতি এবং স্থায়িত্ব-কালের পরিমাপ বিশুদ্ধ হয়। শরীরিক রোগ বা কোনরূপ ভাবপ্রবণতা এই পর্যবেক্ষণকে ভ্রমপূর্ণ করতে পারে। অতএব প্রত্যক্ষ জ্ঞান সিদ্ধান্তে পৌঁছিবার একটি উপায় মাত্র। সুতরাং সব রকম মানবিক জ্ঞান, যাহা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে, তা অনিশ্চিত এবং ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত সাক্ষী কে? বিষয়টি যার প্রত্যক্ষ-গোচর হয়েছে। বেদসমূহ সত্য, কেননা এইগুলি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণের বা আপ্তপুরুষগণের প্রত্যক্ষজ্ঞানের সাক্ষ্য-বিবরণ; কিন্তু এই প্রত্যক্ষ অনুভবের শক্তি কি কোন ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতায় সীমাবদ্ধ? না। ঋষি, আর্য এবং ম্লেচ্ছ সবারই সমভাবে এই জ্ঞান হতে পারে। নব্য ন্যায়ের অভিমত এই যে, এইরূপ আপ্তপুরুষের বাক্য প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অন্তর্গত, উপমা বা হেত্বাভাস যথার্থ অনুমানের সহায়ক নয়। সুতরাং প্রকৃত প্রমাণ বলতে আমরা দুটি জিনিষ পাই—প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং অনুমান।
একদল লোক আছে, যাহারা বহিঃপ্রকৃতির বিকাশকেই প্রাধান্য দেয়, আবার অপরদল অন্তঃপ্রকৃতির বিকাশকে। কোন্টি আগে—ডিমের আগে পাখী, না পাখীর আগে ডিম? পাত্রাধার তৈল, না তৈলাধার পাত্র? এই সমস্যার কোন মীমাংসা নেই। ছেড়ে দাও এ-সব। মায়া থেকে বেরিয়ে এস।
৩০। জগৎ না থাকলেই বা আমার কি? আমার মতে তাহলে তো খুব চমৎকার হবে! কিন্তু বাস্তবিক যা কিছু আমার প্রতিবন্ধক, সে-সবই শেষে আমার সহিত মিলিত হবে। আমি কি তাঁর (কালীর) সৈনিক নই?
৩১। হাঁ, একজন বিরাট পুরুষের অনুপ্রেরণাতেই আমার জীবন পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু তাতে কি? প্রেরণা জিনিষটা এই পৃথিবীতে কোন একজনের মাধ্যমে আসেনি। এটা সত্য যে, আমি বিশ্বাস করি—শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রত্যাদিষ্ট (দ্রষ্টা) পুরুষ ছিলেন, সুতরাং আমি নিজেও তাহলে প্রত্যাদিষ্ট হব এবং তোমরাও, তোমাদের শিষ্যেরাও হবে, তারপর তাদের শিষ্যেরাও। এইভাবে বরাবর চলতে থাকবে। তোমরা কি দেখছ না যে, নির্বাচিত কয়েকজনকে উদ্বুদ্ধ করার যুগ আর নেই। এতে ভালই হোক বা মন্দই হোক, সে দিন চলে গেছে, আর কখনও আসবে না। ভবিষ্যতে সত্য পৃথিবীতে অবারিত থাকবে।
৩২। সমস্ত পৃথিবীকে উপনিষদের যুগে উন্নীত করতে হবে—এই রকম চিন্তা করে বুদ্ধ এক মস্ত ভুল করেছিলেন। মানুষের স্বার্থ-চিন্তা সব নষ্ট করেছিল। এ-বিষয়ে কৃষ্ণ ছিলেন বিজ্ঞতর, কারণ, তিনি রাজনীতিজ্ঞ পুরুষ। কিন্তু বুদ্ধ কোন আপসের পক্ষপাতী ছিলেন না। আপস করার জন্য এর আগে কত অবতারের শিক্ষা নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁরা লোক-স্বীকৃতি পাননি, অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বুদ্ধ যদি মুহূর্তের জন্যও আপস করতেন, তবে তাঁর জীবিতকালেই সারা এশিয়াতে তিনি ঈশ্বর বলে পূজিত হতেন। তাঁর উত্তর ছিল কেবল এই—বুদ্ধত্ব একটি অবস্থা-প্রাপ্তি মাত্র কোন ব্যক্তিবিশেষ নয়। বস্তুতঃ দেহধারীদের মধ্যে তাঁকেই একমাত্র প্রকৃত জ্ঞানী বলা যায়।
৩৩। পাশ্চাত্যে লোকে স্বামীজীকে বলেছিল, বুদ্ধের মহত্ত্ব আরও হৃদয়গ্রাহী হত, যদি তিনি ক্রুশবিদ্ধ হতেন। এটাকে তিনি রোমক বর্ররতা বলে অভিহিত করেছিলেন এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কর্মের প্রতি যে আসক্তি, তা হল খুব নিম্নস্তরের এবং পশুসুলভ। এই কারণেই জগতে মহাকাব্যের সমাদর সব সময়ে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ ভারতে এমন এক মিল্টন জন্মগ্রহণ করেননি, যিনি মানুষকে সোজাসুজি গভীর অতল গহ্বরে নিয়ে গিয়ে ফেলবেন। ব্রাউনিং-এর একটি লাইন বরং তার স্থানে দিলে ভাল হয়। গল্পটির মহাকাব্যিক চমৎকারিত্বই রোমানদের নিকট হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটাই রোমানদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্মকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার বললেনঃ হাঁ, হাঁ, তোমরা পাশ্চাত্যেরা কাজ চাও। জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির মধ্যেও যে-কাব্য রয়েছে, তা তোমরা এখনও অনুভব করতে পারনি। সেই যে অল্পবয়স্কা মা তার মৃত পুত্রকে নিয়ে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়েছিল, সেই গল্পের চেয়ে চমৎকার গল্প আর কি হতে পারে? অথবা সেই ছাগশিশুর ঘটনাটি? দেখ, মহান্ ত্যাগ যে জিনিষ, তা ভারতে কিছু নূতন নয়। কিন্তু পরিনির্বাণের পর, এখানেও যে একটি কাব্য আছে, তা লক্ষ্য কর।
সেটা ছিল বর্ষার রাত। তিনি বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির মধ্যে সেই গো-পালকের কুঁড়েঘরে চালার নীচে দেওয়াল ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছেন। ক্রমে বৃষ্টি জোরে এল এবং বাতাসও বেড়ে উঠল। ভিতর থেকে জানালা দিয়ে সেই গো-পালককে একজনকে দেখতে পেয়ে চিন্তা করতে লাগল—হাঃ হাঃ কাষায়ধারী, ঐখানেই থাক। ঐ স্থানই তোমার উপযুক্ত। তারপর সে গান ধরলঃ
আমার গরুগুলো সব গোয়ালে আছে, আগুন ভালভাবেই জ্বলচ্ছে। আমার স্ত্রী নিরাপদে রয়েছে এবং শিশুরা সুন্দর ঘুমোচ্ছে। অতএব ওহে মেঘ, তুমি আজ রাতে যত ইচ্ছা বর্ষণ করতে পার।
বুদ্ধও বাইরে দাঁড়িয়ে এর উত্তর দিয়ে বললেনঃ আমার মন সংযত, আমার ইন্দ্রিয়বর্গ সংহৃত করেছি এবং আমার হৃদয় সুদৃঢ়। অতএব হে সংসার-মেঘ, তুমি আজ যত ইচ্ছা বর্ষণ করতে পার।