৮৮। আজকাল আমাদের দেশে এমন অনেক আছেন, যাঁহারা শাস্ত্রের অর্থ ঠিক ঠিক বুঝিতে পারেন না। তাঁহারা শুধু ব্রহ্ম, মায়া, প্রকৃতি প্রভৃতি শব্দ শিখিয়া ঐগুলির দ্বারা মাথার মধ্যে গোলমাল বাধাইয়া তুলিয়াছেন। শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম এবং উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়া তাঁহারা কেবল শব্দ লইয়া মারামারি করেন। শাস্ত্র যদি সমস্ত লোককে সকল অবস্থায় সকল সময়ে সাহায্য করিতে না পারে, তবে সে শাস্ত্রের কি প্রয়োজন? শাস্ত্র যদি কেবল সন্ন্যাসীর জীবনের পথপ্রদর্শক হয়, যদি গার্হস্থ্য জীবনের কোন কাজে না আসে, তবে এই একদেশদর্শী শাস্ত্রে গৃহস্থের কি প্রয়োজন? যাঁহারা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইয়াছেন, শাস্ত্র যদি কেবল তাঁহাদের জন্যই হয়, শাস্ত্র যদি কর্ম-চঞ্চল পৃথিবীতে দৈনিক শ্রম, রোগ, শোক, দারিদ্র্যের মধ্যে, অনুশোচনাময় হতাশ হৃদয়ে, নিপীড়িতের আত্মগ্লানিতে, যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতার মধ্যে, লোভে, ক্রোধে, সুখে, বিজয়ের আনন্দে, পরাজয়ের অন্ধকারে এবং অবশেষে মৃত্যুর ভয়াবহ মুহূর্তে মানুষকে আশার আলো জ্বালাইবার উপায় দেখাইতে না পারে, তবে দুর্বল মানুষের কাছে এই শাস্ত্রের কোন প্রয়োজন নাই। তাহা হইলে শাস্ত্রের শাস্ত্রত্বই নষ্ট হইয়া যাইবে।
৮৯। ভোগের মধ্য দিয়াই কালে যোগ আসিবে। কিন্তু হায়, আমাদের দেশবাসীর ভাগ্য এমনি যে, যোগ আয়ত্ত করার কথা দূরে থাকুক, তাহারা সামান্য ভোগও পায় না। সর্বপ্রকার অপমান সহ্য করিয়া অতি কষ্টে তাহারা জীবনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মাত্র মিটাইতে সমর্থ হয়; তাহাও আবার সকলে পারে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমন দূরবস্থাও আমাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাইয়া আমাদিগকে আশু কর্তব্যের প্রতি সচেতন করিতে পারে না।
৯০। তোমাদের অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য তোমরা যতই আন্দোলন কর না কেন, স্মরণ রাখিও, যতদিন না তীব্র জাতীয় সম্মানবোধ জাগাইয়া আমরা সত্যসত্যই নিজেদের উন্নত করিতে পারিতেছি, ততদিন এই সুযোগ ও অধিকার লাভের আশা ‘আলনাস্কারের দিবাস্বপ্নে’র তুল্য।
৯১। যখন কোন বংশ কোন প্রতিভাবান্ বা বিশেষ বিভূতিমান্ ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন, তখন সেই বংশে যা কিছু শ্রেষ্ঠ এবং সমধিক সৃজনশীল প্রতিভা থাকে, তাহা যেন ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপুষ্টির জন্য নিঃশেষে তাঁহারই দিকে আকৃষ্ট হয়। এই কারণে আমরা দেখি, ঐ বংশে পরবর্তী কালে যাঁহারা জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহারা হয় নির্বোধ অথবা অতি সাধারণ- বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্র এবং কালে ঐ বংশ বহুক্ষেত্রেই নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়।
৯২। এই জীবনে যদি মুক্তিলাভ না হয়, তবে পরবর্তী এক বা বহু জীবনে যে মুক্তিলাভ ঘটিবে, তাহার প্রমাণ কি?
৯৩। আগ্রার তাজমহল দেখিতে গিয়া তিনি মন্তব্য করিলেনঃ ইহার যে-কোন এক-টুকরা মার্বেলকে নিংড়াইলে ইহা হইতে বিন্দু বিন্দু রাজকীয় প্রেম ও দুঃখ ক্ষরিত হইবে। তিনি আরও বলিলেনঃ ইহার অন্তর্ভাগের এক বর্গ ইঞ্চি পরিমিত স্থানের সৌন্দর্য ঠিক ঠিক উপভোগ করিতেই ছয় মাস লাগিবে।
৯৪। ভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ঘাটিত হইলে প্রমাণিত হইবে যে, যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে, তেমনি ললিতকলার ক্ষেত্রেও ভারত সমস্ত পৃথিবীর আদি গুরু।
৯৫। স্থাপত্য-সম্পর্কে আলোচনা-প্রসঙ্গে তিনি বলিলেনঃ লোকে বলে কলিকাতা প্রাসাদপুরী। কিন্তু বাড়ীগুলি দেখিলে মনে হয় যেন কতকগুলি বাক্সকে উপর উপর সাজাইয়া রাখা হইয়াছে। এগুলি কোন বিশেষ ভাবের দ্যোতক নয়। প্রকৃত হিন্দু স্থাপত্য রাজপুতানায় এখনও অনেক দেখা যায়। কোন ধর্মশালার দিকে তাকাইলে মনে হইবে, উহা যেন মুক্ত বাহু প্রসারিত করিয়া যাত্রীকে আহ্বান জানাইতেছে—তাহারা সেখানে আশ্রয় ও আতিথেয়তা লাভ করিতে পারে। উহার ভিতরে ও বাহিরে দেবতার সান্নিধ্য অনুভব করিবে। গ্রাম্য কুটীর দেখিলেও তৎক্ষণাৎ উহার বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে এবং বুঝিতে পারিবে যে, সমস্ত কুটীরটিই মালিকের নিজস্ব আদর্শ এবং প্রকৃতির দ্যোতক। ইতালী ব্যতীত অন্য কোন দেশে আমি এই জাতীয় ভাবব্যঞ্জক স্থাপত্যশিল্প দেখি নাই।
উক্তি-সঞ্চয়ন—২
১। স্বামীজীকে প্রশ্ন করা হইল, ‘বুদ্ধের মত কি এই যে, বহুত্ব সত্য এবং একত্ব (আত্মা) মিথ্যা? আর হিন্দু (বেদ) মতে তো একত্বই সত্য, বহুত্ব মিথ্যা।’ স্বামীজী বলিলেনঃ হ্যাঁ, এবং এর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং আমি যাহা যোগ করেছি, তা এই যে, একই নিত্য বস্তু একই মনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে অনুভূত হয়ে এক ও বহুরূপে প্রতিভাত হয়।
২। একবার এক শিষ্যকে বলিলেনঃ মনে রাখিও জীবাত্মারই বিকাশের জন্য প্রকৃতি, প্রকৃতির জন্য জীবাত্মা নয়—ইহাই ভারতের শাশ্বত বাণী।
৩। পৃথিবী আজ চায় এমন কুড়িজন নরনারী, যাহারা সামনের ঐ পথে সাহসভরে দাঁড়াইয়া বলিতে পারে যে, ভগবান্ ব্যতীত তাহাদের অন্য কোন সম্বল নাই। কে আসিবে? কেন, ইহাতে ভয় কি? যদি এটি সত্য হয়, তবে আর কিসের প্রয়োজন? আর যদি এটি সত্য না হয়, তবে আমাদের বাঁচিয়া কি লাভ?
৪। আহা, পরমাত্মার স্বরূপ যিনি জানিয়াছেন, তাঁহার কাজ কতই না শান্ত! বাস্তবিকপক্ষে লোকের দৃষ্টি খুলিয়া দেওয়া ছাড়া তাঁহাদের অন্য কিছু করণীয় থাকে না। আর যাহা কিছু, তাহা আপনিই হইতে থাকে।