আমার যথার্থ স্বরূপ সকল বিধির বাহিরে। দাসত্ব ও প্রকৃতির সহিত সমভাবাপন্ন হও, এবং তুমি নিয়মানুগ হইয়া চল, নিয়মের বশবর্তী হইয়াই তুমি সুখী হইবে। কিন্তু যতই তুমি প্রকৃতি ও উহার নির্দেশকে মানিয়া চলিবে, ততই বদ্ধ হইবে। যতই তুমি অজ্ঞতার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া চলিবে, ততই তুমি বিশ্বের সব কিছুর অধীন হইবে। প্রকৃতির সহিত এই সামঞ্জস্য, এই নিয়মানুগামিতাই কি মানুষের যথার্থ স্বরূপ ও নিয়তির সহিত সঙ্গতিসম্পন্ন? কোন খনিজ পদার্থ কখনও বিধি বা নিয়মের সহিত বিবাদ করিয়াছে? কোন বৃক্ষ অথবা চারাগাছ কখনও কোন নিয়ম লঙ্ঘন করিয়াছে? এই টেবিলটি প্রকৃতি ও নিয়ম মানিয়া চলে; কিন্তু ইহা সর্বদা টেবিলই থাকিয়া যায়, ইহা অপেক্ষা ভাল হয় না। মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে আরম্ভ করে। সে অনেক ভুল করে, অনেক কষ্ট পায়। কিন্তু পরিণামে সে প্রকৃতিকে জয় করে এবং নিজের মুক্তি উপলব্ধি করে। যখন সে মুক্ত হয়, তখন প্রকৃতি তাহার দাস হয়।
বন্ধন সম্বন্ধে আত্মার সচেতন এবং শক্তিপ্রকাশে সচেষ্ট হওয়াকেই ‘জীবন’ বলে। এই সংগ্রামে সফলতাকেই বলে ক্রমবিকাশ। সর্বপ্রকার দাসত্ব দূর করিয়া পরিণামে জয়লাভ করাকেই ‘মুক্তি’, ‘মোক্ষ’ বা ‘নির্বাণ’ বলে। বিশ্বে সবই মুক্তির জন্য সংগ্রাম করিতেছে। যখন আমি প্রকৃতি, নাম-রূপ ও দেশ-কাল-নিমিত্ত দ্বারা বদ্ধ, তখন আমার যথার্থ স্বরূপ জানি না। কিন্তু এই দাসত্বেও আমার যথার্থ স্বরূপ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয় না। আমি বন্ধনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি; বন্ধনগুলি একে একে ভাঙিয়া যায়, এবং আমার স্বাভাবিক মহত্ত্ব সম্বন্ধে সচেতন হই। তারপরই আসে পূর্ণ মুক্তি। আমার স্বরূপ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ চৈতন্য লাভ করি—জানি যে, আমি অনন্ত আত্মা, প্রকৃতির প্রভু, কিন্তু প্রকৃতির দাস নই। সকল ভেদ ও সমবায়ের অতীত, দেশ কাল ও নিমিত্তের অতীত ‘আমি সেই আত্মা, আমি সেই ব্রহ্ম।’
৪৩. ধর্মীয় ঐক্যের মহাসম্মেলন
[‘চিকাগো সাণ্ডে হেরল্ড’ (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩) পত্রিকায় প্রকাশিত বক্তৃতার রিপোর্ট]
এই ধর্ম-মহাসম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির সাধারণ সিদ্ধান্ত এই যে, মানবজাতির সৌভ্রাত্রই বহু-আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য। স্বভাবসিদ্ধ অবস্থারূপে এই ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হইয়াছে, কারণ আমরা সকলেই এক ঈশ্বরের সন্তান। অনেক ধর্মসম্প্রদায় ঈশ্বরের অর্থাৎ সাকার ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। যদি আমরা ঐ-সকল ধর্মসম্প্রদায়কে আমল দিতে ইচ্ছা না করি—এবং তাহা হইলে আমাদের সৌভ্রাত্র সর্বজনীন হইবে না—সমগ্র মানবজাতিকে আলিঙ্গন করিবার মত প্রশস্ত মিলনভূমি আমাদের থাকিবে। এই মহাসম্মেলনে বলা হইয়াছে যে, মানবজাতির হিতসাধন করা আমাদের কর্তব্য, কারণ মন্দ বা নীচ কর্ম-মাত্রই কর্মকর্তার উপর প্রতিক্রিয়ারূপে ফিরিয়া আসে। প্রথমে আমরা নিজেরা, পরে আমাদের ভ্রাতারা—এই ভাবটিতে দোকানদারির ভাব আছে বলিয়া মনে হয়। আমি মনে করি—ঈশ্বরের পিতৃত্বে আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, ভ্রাতাকে আমাদের ভালবাসা উচিত, কারণ প্রত্যেক ধর্ম ও প্রত্যেক মতবাদ মানুষের দেবত্ব স্বীকার করে। মানুষের মধ্যে যে দেবত্ব আছে, উহা যেন কোন প্রকার ক্ষুণ্ণ না হয়, সেইজন্যই কাহারও কোন অনিষ্ট করা উচিত নয়।