সূক্ষ্মতম মন ও স্থূলতম বস্তুর মধ্যে পার্থক্য শুধু পরিমাণের। অতএব সমগ্র বিশ্বকে মন অথবা বস্তু বলা যাইতে পারে, কোন্টা—তাহাতে কিছু আসে যায় না। তোমরা মনকে বিশুদ্ধ বস্তু, অথবা শরীরকে, স্থূল বা বাস্তব মন বলিতে পার, কোন্টাকে কি নামে ডাক তাহাতে সামান্য পার্থক্যই পরিলক্ষিত হয়। জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের মধ্যে বিরোধজনিত যে-সকল অসুবিধার সৃষ্টি হইয়াছে, সেগুলির কারণ ভুল চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে এই দুই-এর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। আমার ও নিম্নতম শূকরশাবকের মধ্যে পার্থক্য শুধু পরিমাণের। শূকরশাবকের মধ্যে শক্তির প্রকাশ কম, আর আমার মধ্যে শক্তির প্রকাশ বেশী। কখনও আমি নিকৃষ্ট, কখনও শূকরশাবক উৎকৃষ্ট।
মন অথবা বস্তু—কোন্টি প্রথমে আসে, ইহার আলোচনা করিয়া কোন লাভ নাই। মনই কি প্রথম—যাহা হইতে বস্তু আসিয়াছে? অথবা বস্তুই কি প্রথম—যাহা হইতে মন আসিয়াছে? এ-সকল অর্থহীন প্রশ্ন হইতে দার্শনিক যুক্তির অনেকগুলি উদ্ভূত হইয়াছে। ইহা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগী আগে?’—এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার মত। দুই-ই প্রথম এবং দুই-ই শেষ—মন ও বস্তু, বস্তু ও মন। যদি আমি বলি, বস্তুর অস্তিত্ব প্রথমে এবং বস্তু ক্রমশঃ সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইয়া মন হয়, তাহা হইলে আমি অবশ্যই স্বীকার করিব যে, বস্তুর পূর্বে মনের অস্তিত্ব নিশ্চয়ই থাকিবে। যদি না থাকিত, বস্তু কোথা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে? মনের পূর্বে বস্তুর অস্তিত্ব, বস্তুর পূর্বে মনের অস্তিত্ব আছে। ইহা আগাগোড়া ‘মুরগী ও ডিমের’ প্রশ্নের মত।
সমগ্র প্রকৃতি নিমিত্তের বিধি দ্বারা সীমাবদ্ধ এবং দেশ-কালের অন্তর্গত। দেশের বাহিরে আমরা কিছু দেখিতে পারি না, তথাপি আমরা দেশ জানি না। কালের বাহিরে আমরা কিছু অনুভব করিতে পারি না, তথাপি আমরা কাল জানি না। কার্য-কারণের ভাষায় না বলিলে আমরা কিছু বুঝিতে পারি না, তথাপি কার্যকারণ কি তাহা আমরা জানি না। দেশ কাল নিমিত্ত—এই তিনটি প্রত্যেক দৃশ্যবস্তুর মধ্যে অনুস্যূত আছে, কিন্তু উহারা দৃশ্যবস্তু নয়। বুঝিতে পারিবার পূর্বে ইহারা যেন বিভিন্ন আকার বা ছাঁচ, যেগুলিতে ইহাদিগের প্রত্যেকটিকে অবশ্যই ঢালিতে হইবে। দেশ-কাল-নিমিত্তের সমবায়ে বস্তু একটি সত্ত্ব। দেশ-কাল-নিমিত্তের সমবায়ে মন একটি সত্ত্ব।
এই তত্ত্বটি অন্যভাবে প্রকাশ করা যাইতে পারে। প্রত্যেক বস্তুই সত্ত্ব—নাম ও রূপের সমবায়ে। নাম ও রূপ আসে এবং যায়, কিন্তু সত্ত্ব চিরদিন একই থাকে। সত্ত্ব, নাম ও রূপ এই জলপাত্রটিকে গড়ে। ভাঙিয়া গেলে ইহাকে আর ‘পাত্র’ নামে অভিহিত কর না, অথবা ইহার পাত্র-রূপ দেখ না। ইহার নাম ও রূপ থাকে না, কিন্তু ইহার সত্ত্ব থাকে। নাম ও রূপের দ্বারা বস্তুর যাবতীয় পার্থক্য হয়। এগুলি যথার্থ নয়, কারণ ইহাদের অস্তিত্ব থাকে না। আমরা যাহাকে প্রকৃতি বলি, তাহা অবিনাশী ও বিকারহীন সত্ত্ব নয়। দেশ কাল ও নিমিত্তই প্রকৃতি। নাম ও রূপই প্রকৃতি। প্রকৃতিই মায়া। যে নাম ও রূপে প্রত্যেক বস্তুকে ঢালা হয়, তাহাকে ‘মায়া’ বলে। মায়া সত্য নয়, মিথ্যা। মায়া সত্য হইলে ইহাকে আমরা বিনাশ অথবা পরিবর্তন করিতে পারিতাম না। সত্ত্ব হইতেছে অজ্ঞাত ও বস্তুজগতের গুণাগুণশূন্য এবং শুধু বুদ্ধি দ্বারা অধিগম্য বিষয়, আর মায়া হইতেছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু বা প্রপঞ্চ। প্রকৃত ‘আমি’কে কিছুই বিনাশ করিতে পারে না। কাঁচা বা পরিদৃশ্যমান ‘আমি’ সতত পরিবর্তনশীল ও নশ্বর।
আসল কথা এই—পার্থিব বস্তু মাত্রেরই দুইটা দিক্ আছে। একটা দিক্ নিত্য, বিকারহীন ও অবিনাশী; অপর দিক্ অনিত্য, পরিবর্তনশীল ও নশ্বর। মানুষ স্বরূপতঃ সত্ত্ব, আত্মা। এই আত্মা—এই সত্ত্ব বিকারহীন অবিনাশী। কিন্তু ইহা নামরূপান্তক বলিয়া প্রতীয়মান হয়। এই নাম ও রূপ বিকারহীন বা অবিনাশী নয়; ইহারা চিরপরিবর্তনশীল ও নশ্বর। তথাপি মানুষ এই পরিবর্তনশীল দেহ ও মনে নির্বোধের মত অমরত্ব খোঁজে—শাশ্বত একটি দেহ পাইতে চায়। আমি সেরূপ অমৃতত্ব চাই না।
প্রকৃতি ও আমার মধ্যে কি সম্বন্ধ? প্রকৃতি নাম ও রূপ অথবা দেশ কাল ও নিমিত্তের প্রতীক; আমি প্রকৃতির অংশ নই, কারণ আমি মুক্ত, অমৃত, অপরিণামী ও অনন্ত। আমার স্বাধীন ইচ্ছা আছে কি নাই—এই প্রশ্ন আসে না। আমি যে-কোন ইচ্ছারই অতীত। যেখানেই ইচ্ছা, উহা কখনও স্বাধীন নয়। ইচ্ছার কোনই স্বাধীনতা নাই। নাম ও রূপ ইচ্ছাকে ধরিয়া দাস করিলেও ইহার স্বাধীনতা বজায় থাকে। সেই সত্ত্ব—আত্মা যেন নিজেকে নামরূপের ছাঁচে ঢালিয়া গড়িয়া তুলেন এবং অচিরে বদ্ধ হন, অথচ পূর্বেই তিনি মুক্ত বা স্বাধীন ছিলেন। তথাপি ইহার মূল স্বভাব থাকিয়াই যায়। এজন্যই শাস্ত্র বলেন, ‘আমি মুক্ত; এ-সব বন্ধন সত্ত্বেও আমি মুক্ত’। এবং ইহা কখনই এ-কথা বিস্মৃত হয় না।
কিন্তু যখন আত্মার ইচ্ছা হইয়াছে, ইহা আর প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বা মুক্ত নয়। প্রকৃতি শিকল ধরিয়া টানে, এবং প্রকৃতি যেমনই নাচাইতে চায়, তেমনই ইহাকে নাচিতে হয়। এভাবে তুমি ও আমি বর্ষ-বর্ষ নাচিয়াছি। আমরা যাহা কিছু দেখি, করি, অনুভব করি ও জানি, আমাদের সকল চিন্তা ও কার্য প্রকৃতির নির্দেশানুয়াযী নৃত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কোন কিছুতেই ইহার কোন স্বাধীনতা ছিল না এবং নাই। নিম্নতম হইতে উচ্চতম সকল চিন্তা ও কার্য প্রণালীবদ্ধ, এবং এগুলির কোনটিই আমাদের প্রকৃতস্বরূপগত নয়।