তারপর দুঃখের অন্য মহৎ কারণ—ভয়। কেন একজন আর একজনের অনিষ্ট করে? কারণ তাহার আশঙ্কা—সে যথেষ্ট ভোগ করিতে পারিবে না। একজন আশঙ্কা করে যে, হয়তো তাহার যথেষ্ট অর্থ হইবে না, এবং এই আশঙ্কাবশতই সে অপরের অনিষ্ট করে এবং অর্থ লুণ্ঠন করে। যেখানে কেবল এক সত্তা আছে, সেখানে ভয়ের স্থান কোথায়? যদি আমার মাথায় একটি বজ্রপাত হয়, আমি-ই সেই বজ্র, কারণ আমিই একমাত্র সত্তা। যদি প্লেগের আবির্ভাব হয়, আমিই সেই প্লেগ; যদি একটি ব্যাঘ্র আসে, আমিই সেই ব্যাঘ্র; যদি মৃত্যু আসে, আমিই সেই মৃত্যু। আমি জন্ম ও মৃত্যু দুই-ই। আমরা দেখিতেছি যে, বিশ্বে দুইটি সত্তা আছে—এই ধারণা হইতেই ভয় আসে, ‘পরস্পরকে ভালবাস’—এ-কথা প্রচারিত হইতে আমরা সর্বদা শুনিয়া থাকি। কিন্তু কি জন্য সকলকে ভালবাসিব—তাহার ব্যাখ্যা এখানে। আমি প্রত্যেককে ভালবাসিব কেন? কারণ তাহারা ও আমি এক। আমার ভ্রাতাকে ভালবাসিব কেন? কারণ সে ও আমি এক। এই একত্ব—এই সমগ্র বিশ্বের অখণ্ডত্বই ভালবাসার কারণ। পদতলবিহারী ক্ষুদ্রতম কীট হইতে উচ্চতম জীব পর্যন্ত সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন শরীর আছে, কিন্তু তাহারা সকলেই এক আত্মা। সকল মুখ দিয়াই তুমি খাও; সকল হাত দিয়াই তুমি কাজ কর; সকল চোখ দিয়াই তুমি দেখ। লক্ষ লক্ষ দেহে তুমি স্বাস্থ্যসুখ উপভোগ করিতেছ, লক্ষ লক্ষ শরীরে তুমি ব্যাধি-যন্ত্রণা ভোগ করিতেছ। যখন এই ভাব আসে এবং আমরা ইহা উপলব্ধি করি, দেখি, অনুভব করি, তখনই দুঃখের নিবৃত্তি হইবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও চলিয়া যাইবে। আমি কিরূপে মরিতে পারি? আমাকে ছাড়া কিছুই নাই। ভয় চলিয়া যায়, এবং কেবল তখনই পূর্ণ সুখ ও পূর্ণ প্রেম আসে। সেই অবিনাশী সর্বজনীন সহানুভূতি, সর্বজনীন প্রেম, সর্বজনীন সুখ মানুষকে সর্ববস্তুর উপরে তুলিয়া ধরে। ইহার কোন প্রতিক্রিয়া নাই, কোন দুঃখ ইহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। কিন্তু জগতের এই সামান্য পান-ভোজন সর্বদাই একটি প্রতিক্রিয়া আনয়ন করে। ইহার সমগ্র হেতু এই দ্বৈতবাদ—বিশ্ব হইতে ভগবান্ হইতে আমি পৃথক্, এই ভাব। কিন্তু যে-মুহূর্তে আমরা উপলব্ধি করিয়াছি যে, ‘আমিই তিনি, আমি বিশ্বের আত্মা, আমি চিরসুখী, চিরমুক্ত’, তখনই আসিবে প্রকৃত প্রেম, চলিয়া যাইবে সব ভয় এবং অবসান হইবে সকল দুঃখের।
৪১. মুক্তির পথ
[১৯০০ খ্রীঃ ১২ মার্চ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যাণ্ডে প্রদত্ত বক্তৃতার বিবরণ।]
‘ওকল্যাণ্ড এনকোয়ারার’ (Oakland, Enquirer) পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্যসহ বক্তৃতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের মতে ‘মুক্তির পথ কি?’—এ বিষয়ে বক্তৃতা শুনিবার জন্য গত সন্ধ্যায় ফার্ষ্ট ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এর ওয়েণ্ড্টে হল-এ (Wendte Hall) বিপুল শ্রোতার সমাগম হইয়াছিল। স্বামী যে তিনটি ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়াছিলেন, এটিই সেগুলির শেষ বক্তৃতা। তিনি অংশতঃ বলেনঃ
কেহ বলে—ঈশ্বর স্বর্গে আছেন। আর একজন বলে—ঈশ্বর প্রকৃতিতে এবং সর্বত্রই বিদ্যমান। কিন্তু মহৎ বিপর্যয় উপস্থিত হইলে আমরা দেখিতে পাই, উদ্দেশ্য একই। আমরা সকলেই বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করি, কিন্তু পরিণাম ভিন্ন হয়।
প্রত্যেকটি মহান্ ধর্মের দুইটি মহৎ নীতিবাক্য—ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ। আমরা সকলেই সত্য চাই, এবং জানি যে, আমরা চাই বা না চাই সত্য আসিবেই। কিছু পরিমাণে আমরা সকলেই সেই সত্যের (শ্রেয়ের) জন্য চেষ্টা করিতেছি। সত্যলাভের প্রতিবন্ধক কি? আমরা নিজেরাই। আপনাদের পূর্বপুরুষগণ এই প্রতিবন্ধককে ‘শয়তান’ বলিতেন; কিন্তু ইহা আমাদের নিজেদের মিথ্যা ‘অহং’। আমরা দাসত্বের মধ্যে বাস করি, এবং দাসত্ব না থাকিলে আমরা মরিয়া যাইতাম। আমরা সেই লোকটির মত, যে নব্বই বৎসর ঘোর অন্ধকারে থাকার পর প্রকৃতির সূর্যালোকে আনীত হইলে পূর্বেকার সেই অন্ধকার কক্ষেই ফিরিয়া যাইবার জন্য কাতর প্রার্থনা জানায়। আপনারা এই গতানুগতিক পুরাতন জীবনযাত্রা ছাড়িয়া নূতন অধিকতর উন্মুক্ত স্বাধীনতায় যাইতে চাহিবেন না।
প্রকৃত ঘটনার গভীরে প্রবেশ করাই প্রধান সমস্যা। ব্যাপারগুলি হইতেছে—অমুক জ্যাকের ছোটখাট নিকৃষ্ট বিভ্রান্তিসকল, যে জ্যাক মনে করে, বিভিন্ন ধর্মবিষয়ে সে যতই সামান্য হউক না কেন, তাহার একটি অসীম আত্মা আছেন। ধর্ম-হিসাবে এক দেশের মানুষ বহুপত্নীক; অন্যদেশে একজন নারীর অনেক পতি আছে। সুতরাং কোন কোন লোকের উপাস্য দুই দেবতা, কাহারও উপাস্য এক ঈশ্বর, কেহ কেহ কোন ঈশ্বরেই বিশ্বাস করে না।
কিন্তু কাজ ও ভালবাসার মধ্যে আছে মুক্তি। আপনারা কোন একটি বিষয় সম্যক রূপে শিখিয়াছেন; যথাসময়ে হয়তো সেই বিষয় স্মরণ করিতে পারিতেছেন না, তথাপি জিনিষটি আপনাদের আন্তর চেতনায় ডুবিয়া গিয়াছে এবং আপনাদের অঙ্গীভূত হইয়া আছে। অতএব আপনারা যখন কাজ করেন, সেই কাজ ভালই হউক বা মন্দই হউক, তখন আপনারা নিজেদের ভাবী জীবন ধারা গঠন করেন। যদি আপনারা কর্মের ভাবে ভাবিত হইয়া—কর্মের জন্যই কর্ম হিসাবে—সৎ কর্ম করেন, তবে আপনাদের ভাব অনুযায়ী স্বর্গে গমন করিবেন এবং স্বর্গের স্বপ্ন দেখিবেন।
পৃথিবীর ইতিহাস মহাপুরুষ ও উপদেবতাদের ইতিহাস নয়, উহা সমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মত, যেগুলি সমুদ্রের স্রোত-তাড়িত বস্তুখণ্ডসমূহ হইতে আপনা-আপনি মহাদেশ- রূপে গড়িয়া উঠে। তাহা হইলে প্রতি গৃহে অনুষ্ঠিত আত্মোৎসর্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কার্যের মধ্যে নিহিত আছে পৃথিবীর ইতিহাস। মানুষ তাহার নিজস্ব বিচারবুদ্ধির উপর নির্ভর করিতে ইচ্ছা করে না বলিয়াই ধর্ম গ্রহণ করে।