Site icon BnBoi.Com

বিচিত চিন্তা – সাহিত্যিক চিন্তা – আহমদ শরীফ

বিচিত চিন্তা - সাহিত্যিক চিন্তা - আহমদ শরীফ

অতীন্দ্রিয়লোকে রবীন্দ্রনাথ [কবি-জীবনের শেষ পর্যায়]

০১.

রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভূমি ও ভূমার অনুভূতি সংমিশ্রণে এক অতীন্দ্রিয় লোকের সন্ধান পেয়েছেন। আমরা জানি রবীন্দ্র-প্রতিভারশ্মি বিচিত্র ধারায় হৃদয় ও মনের এবং জগৎ ও জীবনের আনাচে-কানাচে অলিতে-গলিতে প্রবিষ্ট হয়েছে; অদেখা-অজানা ও অভাবিত বিষয়ও তাঁর প্রতিভারশিপাতে উজ্জ্বল ও প্রত্যক্ষীকৃত হয়েছে।

কিন্তু পত্রপুট, ও সেকুঁতির পূর্বপর্যন্ত তিনি হৃদয় দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, intuition দিয়েই জগৎ ও জীবন, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, হৃদয় ও মন, মানুষ ও প্রকৃতি এবং রূপ ও সৌন্দর্যের অন্তর্নিগূঢ় রহস্যাবিষ্কারে তৎপর ছিলেন। এ সময়কার বিশ্বমানবতা ও বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাত্মবোধ ছিল একান্তভাবে তাঁর হৃদয়াবেগপ্রসূত। তখন ছিলেন তিনি অনুভাবক, শেষজীবনে হলেন দ্রষ্টা। তখন তিনি হৃদয়, মন, বুদ্ধি দিয়ে করতেন অনুভব, শেষজীবনে করলেন প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে দর্শন। যা ছিল নিছক অনুভূতি, তা-ই হল উপলব্ধি। তখন বলেছেন :

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।

এ সময় বলতে পারতেন–

দিঠি না জানি কেমনে গেল খুলি
ত্রিভুবন আবরণ করিছে খোলাখুলি।

আমরা সিন্ধু, বসুন্ধরা, প্রবাসীর কবি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি; সোনার তরী ও চিত্রা জীবনদেবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথকে জানি, গীতাঞ্জলি, গীতালি ও গীতিমাল্যের কবি অধ্যাত্মধর্মী রবীন্দ্রনাথের সাথেও আমাদের অপরিচয় নেই; রূপ, সৌন্দর্য ও প্রণয়ের কবি রবীন্দ্রনাথও অপরিচিত নন, জীবনবেত্তা ও মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে ঘনিষ্ঠতাও বহুদিনের। কিন্তু এই বিশ্বানুভূতি, এই সৃষ্টি ও স্রষ্টায় যোগসূত্র সন্ধান, এই অধ্যাত্মসাধনা, এই জীবন ও প্রণয়ধর্মের রহস্য আবিষ্কার প্রভৃতির ভিত্তি ছিল জিজ্ঞাসা, হৃদয়াবেগ, বিস্ময়, বুদ্ধি ও intuition :

তবু জানি, অজানার পরিচয় আছিল নিহিত
বাক্যের আর বাক্যের অতীত
(জন্মদিনে–১২)

তখন :  শুধু বালকের মন নিখিল প্রাণের পেত নাড়া
আকাশের অনিমেষ দৃষ্টির ডাকে দিত সাড়া
তাকায়ে রহিত দূরে।
রাখালের বাঁশির করুণ সুরে
অস্তিত্বের যে বেদনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
নাড়ীতে উঠিত নেচে।
(জন্মদিন—-৯৯)

সেজন্যে আমরা তখন তাঁকে সর্বদা বিস্মিত, সম্মোহিত, আনন্দিত, ব্যাকুলিত, বিচলিত অথবা ব্যথিত দেখতে পেতাম।

যিনি ছিলেন কল্পনা, আশা ও অনুভূতি-প্রদীপ্ত মহাসাধক, তিনিই শেষজীবনে হলেন জগৎ ও জীবনের রহস্যজ্ঞ ত্রিকালদ্রষ্টা মহর্ষি। তিনি এখন আর আশা-কাতর, শঙ্কা-ভীরু সাধক নন, বরং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। শান্ত ও অবিচলিতভাবে তিনি কখনো ভূমার দিকে কখনো ভূমির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ : করেছেন, কখনো ধরার ধূলার হাসি-কান্নায় যোগ দিচ্ছেন, কখনো দ্যুলোকের অভিযাত্রী হচ্ছেন। তাঁর নিরাসক্ত ভারমুক্ত মন–জীবন, জীবন দেবতা, মৃত্যু প্রভৃতির রহস্যসূত্র আবিষ্কারের আনন্দে, সত্য-লাভের পরম তৃপ্তিতে এ লোকে ও লোকাতীতে আসা-যাওয়া করছিল।

যতই তিনি মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছিলেন ততই এই সুখ-দুঃখময় মানব-সংসারের নতুন রূপ, নতুন অর্থ এবং বিশ্ববিধাতার নিগূঢ় অস্তিত্ব ও তাঁর লীলা-বৈচিত্র্যের গভীরতর অর্থ এবং স্বীয় সত্তার রূপ, মৃত্যুর রহস্য তাঁর কাছে সুপ্রকাশিত হচ্ছিল।

সেই অজানার দূত আজি মোরে নিয়ে যায় দূরে,
অকূল সিন্ধুরে নিবেদন করিতে প্রণাম
সকল সংশয় তর্ক যে-মৌনের গভীরে ফুরায়।
(জন্মদিনে–১২)

জীবনের শেষপ্রান্তে উদাসীন শিবের মতো এই প্রজ্ঞা-দৃষ্টি কবির সাধনায় পরিণতি দান করেছে। তিনি বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা নিয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলেন, আর প্রত্যয় ও তৃপ্তিতে তার জীবন সমাপ্তি পেয়েছে। আমরা বিশেষ করে তাঁর শেষ তিনটে কাব্য : রোগশয্যায়, আরোগ্য ও জন্মদিনের কথাই বলছি। কিন্তু আগে থেকেই এ আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। পত্রপুটের কাল থেকেই কবি ক্রমশ এই সুখ-দুঃখময় মানব- সংসারের গভীরতর সত্তার এবং বিশ্ববিধাতার নিগূঢ় অস্তিত্ব গভীরভাবে ও নতুনরূপে উপলব্ধি করছিলেন। তাই তার কাছে ভূলোক ও দ্যুলোকের পার্থক্য-ব্যবধান ঘুচে গিয়েছিল : এ-দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি। এতে তিনি দেশহীন, কালহীন আদিজ্যোতির ধ্যান করবার সুযোগ পেলেন, সেই ধ্যানের দৃষ্টিতে জগৎ ও জীবন, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, এককথায় ভূমি ও ভূমার রহস্য অদ্ভুতভাবে উদঘাটিত হয়েছে।

.

০২.

কবি নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাত্মসাধনায় জগৎ-জীবনের সত্য আবিষ্কার করেননি, মানবচিত্তের সাধনাতেই তা সম্ভব হয়েছে।

মানব চিত্তের সাধনায়
গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ।
সেই সত্য সুখ দুঃখ সবের অতীত
তখন বুঝিতে পারি,
আপন আত্মায় যারা।
ফলবান করে তারে।
তারাই চরম লক্ষ্য মানব সৃষ্টির;
একমাত্র তারা আছে, আর কেহ নাই।
(রোগশয্যায়-২৯)।

এ চিত্ত-সাধনায় চৈতন্য-জ্যোতি শুধু অন্তরে আবদ্ধ নয়, চরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে (এই চৈতন্য-জ্যোতির নাম আত্মা) এবং তা জগৎ-রহস্য উদঘাটিত করে–

যে চৈতন্যজ্যোতি
প্রদীপ্ত রয়েছে মোর অন্তর গগনে,
নহে আকস্মিক বন্দী প্রাণের সংকীর্ণ সীমানায়
আদি যার শূন্যময়, অন্তে যার মৃত্যু নিরর্থক,
মাঝখানে কিছুক্ষণ
যাহা কিছু আছে, তার অর্থ যাহা করে উদ্ভাসিত।
এ চৈতন্য বিরাজিত আকাশে আকাশে
আনন্দ অমৃতরূপে
আজি প্রভাতের জাগরণে
এ বাণী গাঁথিয়া চলে সূর্য গ্রহ তারা
শৃঙ্খলিত ছন্দসূত্রে অনিঃশেষ সৃষ্টির উৎসবে।
(রোগশয্যায়-২৮)।

এভাবে      তিনি উপলব্ধি করলেন :

আনন্দ অমৃত রূপে বিশ্বের প্রকাশ।
অন্তহীন দেশকালে পরিব্যাপ্ত সুত্যের মহিমা।
যে দেখে অখণ্ড রূপে
এ জগতে জন্ম তার হয়েছে সার্থক।
(রোগশয্যায়-২৬),

এবং—

যে চেতনা উদ্ভাসিয়া উঠে
প্রভাত আলোর সাথে
দেখি তার অভিন্ন স্বরূপ,

কেননা—

আকাশ আনন্দপূর্ণ না রহিত যদি
জড়তার নাগপাশে দেহ-মন হইত নিশ্চল।
(রোগশয্যায়-৩৬)

এই উপলব্ধিতেই—-

এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি।
(আরোগ্য-১)

এবং —-

পরম সুন্দর আলোকের স্নান পুণ্য প্রাতে।
অসীম অরূপ
রূপে রূপে স্পর্শমণি।
রসমূর্তি করিছে রচনা,
সব কিছুর সাথে পশে মানুষের প্রীতির পরশ
অমৃতের অর্থ দিয়ে তারে।
মধুময় করে দেয় ধরণীর ধূলি,
সর্বত্র বিছায়ে দেয় চির-মানবের সিংহাসন।..
(আরোগ্য-২)

.

০৩.

একদিকে ভূমার এইরূপ উপলব্ধি, অন্যদিকে ভূমির মানব-সংসারের বিচিত্র জীবন-প্রবাহও কবিকে নতুন দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দান করেছে। মূলত এ তার চিত্ত-সাধনার দুটো শাখা : সৃষ্টির রহস্য-চেতনা আর মানব-ঐতিহ্য মন্থন। একসাথে চলল রূপ আর অরূপের সাধনা।

মানব-ইতিহাসের বাণী আজ তাঁর কাছে সুস্পষ্ট। কেননা কবি দ্রষ্টা। তিনি দেখেছেন :

মানব আপন সত্তা ব্যর্থ করিয়াছে দলে দলে।
বিধাতার সংকল্পের নিত্যই করেছে বিপর্যয়।
ইতিহাসময়
সেই পাপে, আত্মহত্যা অভিশাপে আপনার সাধিছে বিলয়।
(জন্মদিনে–২২)

অভ্রভেদী ঐশ্বর্যের চূর্ণীভূত পতনের কালে,
দরিদ্রের জীর্ণদশা বাসা তার বাঁধিবে কঙ্কালে
(জন্মদিনে–২২)

আবার—

দুঃখে দুঃখে পাপ যদি নাহি পায় ক্ষয়
প্রলয়ের ভস্মক্ষেত্রে বীজ তার রবে সুপ্ত হয়ে
নূতন সৃষ্টির বক্ষে
কণ্টকিয়া উঠিবে আবার।
(রোগশয্যায়–৩৮)

অন্যায়েরে টেনে আনে অন্যায়েরই ভূত।
ভবিষতের দূত।
(জন্মদিনে–১৬)

সুতরাং

এ পাপযুগের অন্ত হবে তখনই যখন
মানব তপস্বী বেশে
চিতাভস্ম শয্যাতলে এসে
নবসৃষ্টি ধ্যানের আসনে
স্থান লবে নিরাসক্ত মনে,
(জন্মদিনে–২১)

এবং
আত্মার অমৃত অন্ন করিবারে দান

যাঁরা সাধনা করেছিলেন :

অকৃতার্থ হন নাই তারা
মিশিয়া আছেন সেই দেহাতীত মহাপ্রাণ মাঝে
শক্তি যোগাইছে যাহা অগোচরে চির-মানবেরে
তাহাদের করুণার স্পর্শ লভিতেছি।
আজি এই প্রভাত আলোকে
তাঁহাদের নমস্কার করি। (জন্মদিনে–১৭)

মৃত্যু এসে একদিন তাকে বিচ্ছিন্ন করে নেবে রূপ জগৎ হতে জীবন মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে (জন্মদিনে-৪)। তাই কবি অনুভব করছেন।

জীবনের সর্বশেষ বিচ্ছেদ বেদনা (আরোগ্য–৪)

এবং

হিংস্ররাত্রি যে চুপি চুপি অন্তরে প্রবেশ করে।
হরণ করিতে থাকে জীবনের গৌরবের রূপ (আরোগ)-৭)।

তা-ই কবিকে বিচলিত করে এবং অনাগত কালে বেঁচে থাকবেন না বলেও কবি ব্যথিত হচ্ছেন :

সে আমার ভবিষ্যৎ
যারে কোনো কালে পাই নাই
যার মধ্যে আকাক্ষা আমার
ভূমিগর্ভে বীজের মতন
অঙ্কুরিত আশা লয়ে
দীর্ঘরাত্রি স্বপ্ন দেখে ছিল
অনাগত আলোকের লাগি। (রোগশয্যায়-২২)।

কিন্তু এসব ক্ষণস্থায়ী, কেননা কবি জেনেছেন :

প্রভাতের প্রসন্ন আলোকে
দুঃখ বিজয়ীর মূর্তি দেখি আপনার
জীর্ণ দেহ দুর্গের শিখরে। (আরোগ্য–৭)

এবং

প্রভাতে প্রভাতে পাই আলোকের প্রসন্ন পরশে
অস্তিত্বের স্বর্গীয় সম্মান।
জ্যোতিস্রোতে মিলে যাক রক্তের প্রবাহ,
নীরবে ধ্বনিত হয় দেহে মনে
জ্যোতিষ্কের বাণী। (রোগশয্যায়–৩২)

অপূর্ব আলোকে মানুষ
দেখিছে তার অপরূপ ভবিষ্যের রূপ
সাবিত্রী পৃথিবী এই আত্মার মর্তনিকেতন, (জন্মদিনে–৫)

এই মর্ত্যলীলাক্ষেত্রে সুখে দুঃখে
অমৃতের স্বাদ পেয়েছি তো ক্ষণে ক্ষণে
বারে বারে অসীমেরে দেখেছি সীমার অন্তরালে
বুঝিয়াছি, এ জন্মের শেষ অর্থ ছিল সেইখানে।
সেই সুন্দরের রূপে
সে সংগীতে অনির্বচনীয়। (জন্মদিনে–১৩)

কিন্তু

আকাশবাণীর সাথে প্রাণের বাণীর।
সুর বাঁধা হয় নাই পূর্ণ সুরে।
ভাষা পাই নাই। (রোগশয্যায়-৩)

সুতরাং কবির এই যা দুঃখ, কেননা—

বৈদিক মন্ত্রের বাণী
কণ্ঠে যদি থাকিত আমার
মিলিত আমার স্তব
স্বচ্ছ এই আলোকে আলোকে
ভাষা নাই ভাষা নাই। (আরোগ্য–৩)

তাই কবি কণ্ঠে জেগেছে আকুল আবেদন :

করো করো অপাবৃত্ত হে সূর্য, আলোক আবরণ
তোমার অন্তরতম পরম জ্যোতির মধ্যে দেখি
আপনার আত্মার স্বরূপ। (জন্মদিনে–১৩)।

এবং

হে সবিতা তোমার কল্যাণতম রূপ।
করো অপাবৃত্ত,
সেই দিব্য আবির্ভাবে
হেরি আমি আপন আত্মারে মৃত্যুর অতীত। (জন্মদিনে–২৩)

.

০৪.

উপরি উদ্ধৃত কবিতাদ্বয়ে এবং রোগশয্যায় কাব্যের ২৬, ২০ আরোগ্য কাব্যের ৩২ এবং জন্মদিনে কাব্যের ২৭ সংখ্যক কবিতায় সূর্যকেই সৃষ্টির মূলীভূত কারণরূপে কল্পনা করা হয়েছে :

পাঠায়েছি নিঃশব্দ বন্দনা
সেই সবিতারে যার জ্যোতিরূপে প্রথম পুরুষ
মর্তের প্রাঙ্গণতলে দেবতার দেখেছি স্বরূপ।

তাই কবি সূর্যকেই সম্বোধন করেছেন উপরোক্ত ও অন্যান্য বহু কবিতায় :

হে প্রভাত সূর্য।
আপনার শুভ্রতম রূপ
তোমার জ্যোতির কেন্দ্রে হেরিব উজ্জ্বল (রোগশয্যায়–১৫)

শুধু নিজের নয়, কবি সবকিছুর রূপ সূর্যের আলোকেই প্রত্যক্ষ করেছেন : (রোগশয্যায়–৫, ১৬, ২১, ২৪, ২৬, ২৭, ৩২, ৩৩) এবং এইভাবে পুরোপুরি মেনে নিয়েছেন :

আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই
জানি আমি তার সাথে আত্মার ভেদ নাই,
এক আদি জ্যোতি উৎস হতে
চৈতন্যের পূণ্যস্রোতে
আমার হয়েছে অভিষেক,
ললাটে দিয়েছে জয়লেখ,
জানায়েছে, অমৃতের আমি অধিকারী
পরম আমির সাথে যুক্ত।
পেতে পারি বিচিত্র জগতে
প্রবেশ লভিতে পারি আনন্দের পথে। (আরোগ্য–৩২)

আদি জ্যোতির সাতে    সবিতার জ্যোতি আর আত্মার চৈতন্যের জ্যোতির কোনো পার্থক্য নেই। তাই কবি কামনা করেছেন :

সমস্ত কুহেলিকা ভেদ করে
চৈতন্যের শুভ্র জ্যোতি সত্যের অমৃতরূপ করুক প্রকাশ,
যে সংসারের ক্ষুব্ধতার স্তব্ধ-ঊর্ধ্ব লোকে
নিত্যের যে শান্তিরূপ তাই যেন দেখে নিতে পারি,
আর-এ জন্মের সত্য অর্থ স্পষ্ট চোখে জেনে যাই যেন
সীমা তার পেরবার আগে। (আরোগ্য–৩৩)

কবির অভিলাষ পূর্ণ হয়েছিল। তবু কবি বলেন :

এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি,
এ ভালোবাসাই সত্য, এ জন্মের দান,
বিদায় নিবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার। (রোগশয্যায়-২৬)

এবং

আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো
এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে। (মৃত্যুঞ্জয়)

এইভাবে কবি ভূলোকে-দ্যুলোকে এবং মহাশূন্যতায় ও মহাপূর্ণতায় বিচরণ করেছেন পরিপূর্ণ আনন্দে, তৃপ্তিতে এবং বিশ্বাসে। তাই এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি।

এবং সেজন্যেই মহা অজানার পরিচয় ও সম্মুখে শান্তি পারাবারের সন্ধান পেয়েও কবি যে মধুর মর্ত্যজীবন পেছনে ফেলে যাচ্ছেন সে জীবনের অধিদেবতাকে নম্র নমস্কারে কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং যারা বন্ধুজন তাদের হাতের পরশে মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে জীবনের চরম প্রসাদ এবং মানুষের শেষ আশীর্বাদ নিয়ে যেতেও কম লালায়িত ছিলেন না।

.

০৫.

বক্তব্য উদ্ধৃতি-বহুল হল। তার কারণ আমরা কবির রচনায় কবিকে দেখতে চেয়েছি। বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে চাইনি। বার্ধক্যে যখন আবেগ হয়েছে নিঃশেষিত, প্রজ্ঞা পেয়েছে বৃদ্ধি, মনন হয়েছে সূক্ষ্ম এবং পরিবেশ-চেতনা পেয়েছে প্রাধান্য-তখনকার রচনা এগুলো। তাই এতে বিজ্ঞানবুদ্ধি, দার্শনিকতত্ত্ব, ইতিহাসের শিক্ষা ও কল্যাণ-চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছে কবির মন ও মত। এখানে চিত্তের চাইতে চিন্তা, আবেগ ছাপিয়ে উদ্বেগ, মনের উপরে মস্তিষ্ক, ভাবের চেয়ে ভাবনা, প্রাণ থেকে প্রজ্ঞা প্রবল হয়েছে–দেখতে পাই। এজন্যে অভিভূতি অপেক্ষা আবেগের তারল্য, কবিত্বের চেয়ে কথকতার প্রাধান্য, ভাবের চাইতে ভঙ্গির জৌলুস এবং অনুভবের চেয়ে মননের ঔজ্জ্বল্যই প্রকাশ পেয়েছে বেশি। এখানে কবি অনেকাংশে বক্তা ও বেত্তা। মানুষ ও মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও আদর্শই এখানে কবির মন ও মনন অধিকার করে রয়েছে। তাই এখানে সবিতা একাধারে বিজ্ঞানীর জগৎ-কারণ, অধ্যাত্মবাদীর দেবতা ও মানব-ইতিহাসের সাক্ষী। বার্ধক্যে রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত মনীষী আর গৌণত কবি। তাঁর রচনাও তাই কবিতাশ্রয়ী জার্নাল।

নজরুল ইসলাম : এক বিরূপ পাঠকের দৃষ্টিতে

আমার এক বন্ধু আড্ডার আসরে সেদিন নজরুল-কাব্য সম্বন্ধে তার যে-বক্তব্য পেশ করেছেন, এখানে আমি তার সার সংকলন, করে দিচ্ছি। দিচ্ছি এজন্যে যে এতে ভাববার ও ভাবনার বিষয় যেমন আছে, তেমনি রয়েছে তর্কের অবকাশ।

তিনি বললেন, নজরুলকে কোনো মতেই বিদ্রোহী বলা চলে না। কেননা, সুব্যবস্থা ও ন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ যে করে সে-ই বিদ্রোহী। নজরুলের সমকালীন সমাজ ও সামাজিক বিশ্বাস সংস্কার যাদের পছন্দসই ছিল তাদের চোখেই নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, আর যারা নিশ্চিত ব্যবস্থায় নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছে, ভালো-মন্দের অনুভূতি নেই–তাদের কাছে তিনি বিপ্লবী। আর আমরা-যারা তাঁর মতাদর্শের সমর্থক আমাদের কাছে তিনি সংগ্রামী বা যিহাদী কবি–তিনি মুযাহিদ।

তাকে মানবতার কবিও বলাও ভুল। মানবতা বিশ্বমানবপ্রীতির দ্যোতক। মানুষ অবিশেষের প্রতি প্রীতি তাঁর ছিল না। মার কোনো সন্তান দুবৃত্ত হলে মা বেদনা বোধ করেন, কিন্তু তার মৃত্যু কামনা করেন না বা নির্মম শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন না। গৌতমবুদ্ধকে বলা যায় মানবতার পূজারী। নজরুল বঞ্চিত উৎপীড়িতের পক্ষ নিয়ে উৎপীড়কের বিরুদ্ধ সংগ্রাম ঘোষণা করেছেন, চেয়েছেন তাদের বুকের রক্ত পান করে প্রতিশোধ নিতে। কাজেই তাঁকে বড়জোর নির্যাতিত মানবতার কবি বলে আখ্যাত করা যায়।

আবার তাও বলা যায় কি-না তলিয়ে দেখবার মতো। কেননা, নজরুলের ঠিক ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ব্রত ছিল না। তিনি নিজেও বঞ্চিতের একজন, দুঃখ- লাঞ্ছনায় তার জীবনও হয়েছিল দুঃসহ। কাজেই তার সংগ্রামের মূলে নির্জলা লাঞ্ছিত-বাৎসল্য ছিল না–আত্মরতিও ছিল। এজন্যেই তাঁর কাব্যে উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা বেশি, আদর্শবাদের আবেগের চাইতে চিত্ত-বিক্ষোভের পরিমাণ অধিক। রবীন্দ্রনাথ ধনীর দুলাল। তাই তাঁর এবার ফিরাও মোরে, দুরন্ত আশা দেশের উন্নতি অপমান প্রভৃতি কবিতায় তিরস্কার আছে, ভৎর্সনা আছে, সদিচ্ছাও রয়েছে, কিন্তু ক্ষুব্ধচিত্তের উত্তেজনা নেই! ফলে রবীন্দ্রনাথের আবেদন হয়তো হৃয়দবানদের ভাবিয়ে তুলেছে, কিন্তু নজরুলের কথার আগুনে-গোলা পাঠককে করেছে বিক্ষুব্ধ এবং সগ্রামী।

আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আমরা নজরুলকে জাতীয় কবি বলে প্রচার করি। অন্যত্র যেমনই হোক, সুধীসভায় তাঁকে জাতীয় কবি বলে পরিচিত করাবার চেষ্টা অনুচিত কর্ম। কেননা জাতীয় কবির যে-সংজ্ঞা আমাদের জানা আছে, তাতে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি হতে পারেন না। সগ্রামী আদর্শেও না, বোধেও না।

নজরুলই বাঙলাদেশে একমাত্র লেখক, যার অবচেতন মনেও হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না। তাঁর কথায়, কাজে ও আচরণে তিনি যে উদার মন ও মতের পরিচয় দিয়েছেন তা একান্তই বিস্ময়কর। বিশুদ্ধ-বুদ্ধি প্রত্যেক মানুষেরই অনুকরণীয়। এদিক দিয়ে নজরুলের জুড়ি নেই। মানুষ নজরুল ও কবি নজরুলের চরিত্র ও কাব্যের কেবল এদিকটি স্মরণে রাখলেও যে-কোনো মানুষেরই আত্মিক উন্নতির সম্ভাবনা বাড়ে। এ দুর্লভ উদারতার একটি কারণ হয়তো এই যে, সেদিনকার ভারতের স্বাধীনতা এবং শোষিত জনের মুক্তিই তার কাম্য ও সাধ্য ছিল, তাই তিনি কোনো তুচ্ছ আবেগকে প্রশ্রয় দেননি–আদর্শ ও লক্ষ্যে বিপর্য ঘটবে বলে।

এই মনোভাব ছিল বলেই নজরুল ও তাঁর কাব্যকে সহসা কোনো বিশেষ সাম্প্রদায়িক ছাপে চিহ্নিত করা যায় না। নিতান্ত এ যুগের লোক না হলে ফকির লালনের ন্যায় নজরুলের জাতিত্ব ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিতর্কের কারণ ঘটত। তাঁর কাব্যে ত যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে। শ্যামাসঙ্গীত; মুসলিম ঐতিহ্যের পাশে রয়েছে হিন্দু পুরাণ; আল্লাহ্-রাসুলে বিশ্বাসের সাথে পাই তাঁর দেবদ্বিজে ভক্তি। তার পারিবারিক জীবনেও ঘটেছে হিন্দু-মুসলিম মিলন। সে-মিলন। সমন্বয়ভিত্তিক নয়–সংযোগমূলক। এতে দুটো জাতির ধার্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পারস্পরিক শ্রদ্ধার সূত্রেই গড়ে উঠেছে। এও কারুর চোখে ভালো, আবার কারুর কাছে মন্দ।

জীবনচর্যায় নজরুলে মুসলমানী যতটুকু আছে, হিন্দুয়ানী আছে তার চেয়েও বেশি। তিনি মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাস রাখেননি। তার আস্থা ছিল হিন্দু-মুসলিম জাতীয়তায়। রবীন্দ্রনাথ তবু মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বার্থ স্বীকার করেছেন, নজরুল তাও করেননি। রবীন্দ্রনাথকে ত্যাগ করতে হলে নজরুলকেও রাখা চলে না।

অবশ্য নজরুল ছিলেন বাঙালি ও মুসলমান। বাঙালি হিসেবে দেশী প্রাচীন ঐতিহ্যে ছিল তাঁর জন্মগত অধিকার। আর ধর্মীয় ঐক্যের সুবাদে আরব-ইরানের ঐতিহ্যে জন্মেছে তার আকর্ষণ। তাই তাঁর মধ্যে আমরা হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি সমান আগ্রহ লক্ষ্য করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালি আর ভারতের বাইরে হিন্দু নেই। কাজেই তাঁর দেশী ও ধর্মীয় ঐতিহ্য ছিল অভিন্ন এবং দুটোই আপাতদৃষ্টিতে হিন্দুয়ানী। একের প্রশংসা ও অপরের নিন্দার কারণ ঘটেছে এভাবেই। ভুল বোঝাবুঝির অবকাশও মিলেছে এখানেই।

আঙ্গিক হচ্ছে কাব্যের দেহ, অনুভূত ভাব হল কাব্যের প্রাণ। দুটোই আপেক্ষিক বস্তু। কারণ দেহহীন প্রাণের কল্পনা অলীক আর প্রাণহীন দেহ নিরর্থক। কাজেই কাব্যের আঙ্গিক কাব্যের আত্মার মতোই মূল্যবান এবং অপরিহার্য নজরুল-কাব্যে আঙ্গিক সৌন্দর্যের অভাব রয়েছে। অথচ সাধারণ্যে রূপ যে গুণের চেয়ে চড়া দামে বিকায়–তা কে না জানে! কবিতায় বক্তব্য প্রকাশে তিনি যত ব্যস্ত, অঙ্গ সৃষ্টিতে তত মনোযোগী নন। ফলে যে-পরিমাণে দ্যুতি রয়েছে, সে-অনুপাতে অঙ্গ-সুষমা নেই। এজন্যেই নজরুল-কাব্যে ভাবে, ভাষায় ও আঙ্গিকে ক্রম-উৎকর্ষ বা ক্রমবিকাশ কিংবা ক্রমপরিণতি দুর্লক্ষ্য। প্রতিভাও যে পরিশীলন ও অনুশীলনের অপেক্ষা রাখে, নজরুল কাব্যই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বক্তব্য প্রকাশে অর্থাৎ মত প্রচারেও তিনি মন দিয়েছিলেন যতটুকু, ততটুকু মনন দেননি। ফলে তার বক্তব্যের পেছনে কোনো তত্ত্ব, বিজ্ঞান বা দর্শনের পষ্ট ভিত্তি নেই। এ যুগে কবিমাত্রই কবি-দার্শনিক বা কবি-বিজ্ঞানী কিংবা কবি-তাত্ত্বিক। শাদা কথায়; নীতি, ধর্ম, সমাজ বা রাষ্ট্র সম্পর্কীয় একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বা দর্শনানুগ মতবাদ থাকে আজকালকার কবি-সাহিত্যিকের রচনার পটভূমিকায়। নজরুলেরও মত আছে, বক্তব্য আছে, কিন্তু তা পষ্ট করে কোনো সমাজবিজ্ঞানের বা রাষ্ট্রাদর্শের বা নীতি-দর্শনের ধারণা দেয় না। তিনি চেয়েছেন পীড়নমুক্ত সুস্থ ও স্বস্থ মনুষ্যসমাজ। সে-ই যে বলেছি, তাঁর বক্তব্যের পেছনে মনন ছিল না, কেবল ক্ষুব্ধ চিত্তের আবেগই ছিল; তাই তিনি সুমুখে যাকেই পেয়েছেন তাকেই শত্রু বলে জেনেছেন এবং আক্রমণ করেছেন। তলিয়ে দেখেননি যে, পীড়ক-পীড়িত দুই-ই পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার নির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্রকলেরই by product। যন্ত্র আর যন্ত্রী বদল না হলে ধনীর ধনী না হয়ে উপায় নেই, নির্ধনেরও ধনাগমের পথ নেই। ঘুষ শুধু আমরা দিতে বাধ্য হইনে, নিতেও বাধ্য থাকি। আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় না। যন্ত্রের পরিবর্তন না হলে যন্ত্রজ পদার্থের রূপ-রস বদল হতেই পারে না। কাজেই যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষিত হয়েছে, তারা আসলে সংগ্রামের লক্ষ্য হবার যোগ্য নয়, এর নাম শ্ৰেণী-সংগ্রাম–ভাঙার গান। আদর্শ প্রতিষ্ঠার সাধনা এ নয়–গড়ার কারিগরিও নয়। এ কারণেই লোকে বলে তাঁর কাব্যে ভাঙার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই। উদার সমাজ দর্শন বা সমাজবিজ্ঞান এতে নেই।

বলেছি, নজরুল কাব্যে আঙ্গিকের প্রতি অবহেলা আছে, তবু উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা তথা আবেগ আন্তরিক হলে বাণীর আপনিতেই একটা ছন্দ গড়ে ওঠে–বক্তব্য হয় মর্মস্পর্শ, তাতে কাব্য-সুষমাও ফুটে ওঠে, নজরুল কাব্যেও তাই রয়েছে। তাঁর কাব্যে সামগ্রিক সুষমা না থাক–দ্যুতি আছে, স্থানে স্থানে দীপ্তি আছে এবং তা হীরেমুক্তোর মতো উজ্জ্বল। বিদ্রোহী, সিন্ধু, দারিদ্র্য প্রভৃতি কবিতাই তার প্রমাণ। আবার এ উচ্ছ্বাস-প্রবণতার জন্যেই নজরুল সনেটও রচনা করতে পারেননি এবং তার গদ্যও উচ্ছ্বাসের পঙ্কে মজেছে।

একে তো নজরুল সম্বন্ধে অধিকাংশ পাঠকের আজো বিস্ময় ও উত্তেজনার ঘোর কাটেনি, তার উপর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নজরুল সম্বন্ধে আমাদের উচ্ছ্বাস দেখানোর গরজও অনুভূত হয়, ফলে তাঁর কাব্যের নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাই আজো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে কবি আজো বেঁচে আছেন এবং কালের হিসেবেও পুরোনো নন।

কবির জিঞ্জির কাব্যখানা ইসলামি কবিতার সংকলন বলে সাধারণ্যে প্রচারিত। আসলে এর Spirit তা নয়। কবি পরাধীন দেশের লোক ছিলেন, বিদেশী-বিজাতির শাসন-শোষণের প্রতি ছিলেন হাড়ে হাড়ে চটা। বলা যায়, তার সংগ্রামের অন্যতম মুখ্য প্রতিপক্ষ বিদেশী শোষক। তাঁর ব্রতই ছিল এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। তাই আফ্রিকা-এশিয়ার পরাধীন ও উৎপীড়িত জাতি এবং দেশগুলো ছিল তাঁর সহানুভূতি ও সমবেদনার পাত্র। এদের জাগরণে কবি উল্লসিত হয়েছেন, অভিনন্দনে সে-উল্লাসের অকুণ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। এ হচ্ছে সমদুঃখী ও সমব্যথী আত্মীয়ের সাফল্যে উল্লাস– মুসলমান বলে নয়, পরাধীন ও উৎপীড়িত বলে। এরা যে মুসলমান তা আকস্মিক।

নজরুল আসলে প্রেমিক, প্রতিকূল পরিবেশই তাঁকে সগ্রামী ও মারমুখো করেছে। সে খবর তাঁর মুখেই শোনা যাক্ : যার ইচ্ছায় আজ দেহের মাঝে দেহাতীতের নিত্য-মধুর রূপ দর্শন করেছি, তিনি যদি আমার সর্ব অস্তিত্ব গ্রহণ করে আমার আনন্দময়ী প্রেমময়ী শক্তিকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে এই বিদ্বেষ জর্জরিত…. ভেদজ্ঞানে কলুষিত, অসুন্দর অসুরনিপীড়িত পৃথিবীকে সুন্দর করে যাব। এই তৃষিতা পৃথিবী বহুকাল যে প্রেম, যে অমৃত, যে আনন্দরসধারা থেকে বঞ্চিত; সেই আনন্দ, সেই প্রেম সে আবার পাবে। আমি হব উপলক্ষ্যমাত্র। সেই সাম্য, অভেদ শান্তি, আনন্দ, প্রেম আবার আসবে আমার নিত্য পরম সুন্দর পরম প্রেমময়ের কাছ থেকে। …. বিশ্বাস করো, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসেনি– আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না ….।

এ কারণেই কবির বেদনা-করুণ কণ্ঠে শোনা গেল-বীণা মোর শাপে তব হল তরবার। মানুষের বিরুদ্ধে–সমাজাদির বিরুদ্ধে কবির যে অভিযোগ, তা আজকের মানুষ আমাদেরও। তাই নজরুল, আমাদের হৃদয়রাজ্যের রাজা, নজরুল আমাদের প্রিয় সেনাপতি। নজরুল যেসব সমস্যা তুলে ধরেছিলেন, সেসবের সমাধান-পন্থা আজো আমাদের দৃষ্টির বাইরে। তাই নজরুলের কাব্যে আমাদের মনের কথা–প্রাণের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এসব কারণেই নজরুল-কাব্য আমাদের প্রিয় ও পাঠ্য এবং আমাদের প্রেরণার উৎস। চিত্ত-বিক্ষোভের নিঃসঙ্কোচ প্রকাশান্তের যে দাহ-শান্ত ভাব–তাও হয়তো তাঁর কাব্য থেকে পাই।

—-বিবৃত কথাগুলো আমার বন্ধুরই উক্তি। এগুলোর সঙ্গে আমার মনের বা মতের মিল আছে। মনে না-করাই বাঞ্ছনীয়। এও বলে রাখছি, তার কোনো কথাই আমি বানিয়ে-বাড়িয়ে বা কমিয়ে লুকিয়ে বলিনি।

 নজরুল ইসলামের ধর্ম

নজরুল ইসলাম দার্শনিক ছিলেন না। বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞানির্ভরও তিনি নন। একান্তভাবে হৃদয়ধর্মী কবি নজরুলের মধ্যে আমরা যে-শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ দেখতে পাই তা নিতান্ত স্পর্শ-চঞ্চলতা ও অনুভূতিপ্রবণতার দুর্বার গতিজাত। এজন্যেই তাঁর কাব্যে সমাজ ও রাষ্ট্রসচেনতার স্পষ্ট ও ঋজু মূর্তি প্রকাশ পায়নি, ভাঙার গানই তিনি গেয়ে গেলেন, জোড়ার কাজে হাত দিতে পারেননি। তাঁর মধ্যে সুন্দর সুষ্ঠু সমাজজীবনের পরিকল্পনা ছিল না। শুধু সমস্যাই তিনি দেখেছেন, সমস্যার সমাধানও তিনি চেয়েছেন আন্তরিকভাবে, কিন্তু পথের সন্ধান তিনি বাতলিয়ে দেননি। রক্তঝরানোই কর্তব্য বলে মেনে নিয়েছেন : রক্তঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা। কারণ যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস তাদের উৎসাদনই হচ্ছে আশু কর্তব্য। সেইজন্যেই কবির অভিলাষ যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ। তিনি চেয়েছেন মানুষ নির্বিশেষের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও কুসংস্কার মুক্তি। এই মুক্তিকামনার উৎস সমাজবোধ নয়, হৃদয়বৃত্তিজাত সহানুভূতি। তাই তার আবেদনে অকৃত্রিম আবেগ আছে, ঐকান্তিক সাধনার নিদর্শন নেই–যে সাধনা গড়ে তুলতে পারত সুন্দর নির্ঘ নির্বিঘ্ন সমাজ, দিয়ে যেতে পারত মহৎ ও বৃহৎ কোনো অবদান। তাঁর মধ্যে প্রচুর আবেগ, সীমাহীন উত্তেজনা রয়েছে। উত্তেজনা সবসময় ক্ষণস্থায়ী এবং মহৎ ও বৃহৎ কর্মের পরিপন্থী। ফলে বিদ্রোহ সার্থকতার পথ খুঁজে পেল না, বিপ্লব পেল না সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন। উত্তেজনায় সংযমের স্বাস্থ্য থাকে না, থাকে না সুপরিকল্পিত কর্মের প্রেরণা। তাই তিনি উত্তেজনা ও প্রাণপ্রাচুর্য বশে তারুণ্যের, যৌবনের, জীবনের, সুন্দরের বন্দনা করে গেলেও তাদের স্বরূপ চিহ্নিত করে দিতে পারেন নি।

যা পারেন নি, যা দেন নি তা নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। কিন্তু তিনি যা দিয়েছেন, তার মূল্যও অপরিসীম। তিনি সত্তা-অচেতন জড় জাতির জীবনে নতুন করে প্রাণ-স্পন্দন দিয়েছিলেন। দারিদ্র দাসত্ব-অশিক্ষা-শোষণ জর্জরিত স্বদেশবাসীর জন্যে তাঁর আকুলতার সীমা ছিল না, ক্ষোভের ছিল না অন্ত। এই ক্ষোভ ও আকুলতাই তাঁকে বিদ্রোহী ও বিপ্লবী করেছিল। সমাজে-রাষ্ট্রে-ধর্মে যেখানেই তিনি অন্যায় দেখেছেন সেখানেই রুখে দাঁড়িয়েছেন, নির্মমভাবে করেছেন আঘাত, নিঃসংকোচে প্রকাশ করেছেন তাঁর উপলব্ধ সত্যকে, নির্ভীকচিত্তে করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তিনি নিজেই বলেছেন যা অন্যায় বলে বুঝেছি অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কারও তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কারো পিছনে পো ধরি নাই। আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই–সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। (জবানবন্দী)।

নির্যাতিত স্বদেশী লোকের দুঃখবেদনায় সমবেদনা জানাতে গিয়ে কবি বিশ্বের দুর্গত জনসাধারণের হয়ে অন্যায়-অত্যাচরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। ব্যক্তি-চেতনা জাগানো এবং ব্যক্তি-সত্তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর সাধনা। স্ব স্ব মর্যাদায় অধিকারে ও বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত থেকে মানুষ তৈরি করবে মিলন-ময়দান-যে ময়দানে সমবেদনায় সকলে হয়েছে ভাই। নির্যাতিত মুমূর্ষ মানুষকে আত্মচেতনা ও আত্মবিশ্বাস দানই ছিল তার ব্রত। এ ক্রন্দন কী আমার একার? না এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল নীরব ক্রন্দসীর সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের প্রলয়-হুঁঙ্কার একা আমার নয়, সে নিখিল আর্তপীড়িত আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার। (জবানবন্দী)

অথবা–বীর কারুর অধীন নয়, ভিতরে বাইরে সে কারুর দাস নয়–সম্পূর্ণ উদার মুক্ত। পরকে ভক্তি করে, বিশ্বাস করে শিক্ষা হয় পরাবলম্বন–আর পরাবলম্বন মানেই দাসত্ব।… বল কারুর অধীনতা মানিনা-স্বদেশীরও না বিদেশীরও না। (দুর্দিনের যাত্রী)।

নজরুলের কাব্য-সাধনা ছিল একান্তভাবে মানবনিষ্ঠ। নজরুলের ধর্মও ছিল তাই মানবনিষ্ঠা। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে প্রেম করাই আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ এবাদত। এ প্রেমে ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠা থাকা প্রয়োজন। সেজন্যে আমরা দেখতে পাই বিবেক, সত্য ও মানবতাকে তিনি সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি বিবেকের নির্দেশ মেনে চলেন। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যে ঘোষণা করেছেন জেহাদ। মানুষ নির্বিশেষের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও প্রেমই তাঁকে ধর্মের গোঁড়ামি, আভিজাত্যবোধ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করেছে :

গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহীয়ান,
নাই দেশকাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি;
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

অথবা

দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফুটে তাজা ফুল
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে খুলে দেখ নিজ প্রাণ।

নজরুল ইসলাম কোনো বিশেষ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন বলা চলে না। তিনি দেশ-জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান উদারতায় ভালোবাসতে পেরেছেন। বিবেক-বিধৃত সত্যের উপরে সত্য নেই, এ-ই তাঁর বিশ্বাস —

শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা সত্য-সিন্ধুজলে।
ওরে বেকুব, ওরে জড়, শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়।
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

বলেছি, নজরুল ইসলামকে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুরাগী বলা চলে না। এতদসত্ত্বেও তিনি ইসলামের প্রতি তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছেন। তার কারণ, কবির জীবনের যা ব্রত তা ইসলামের মতো আর কোনো ধর্ম এত দৃঢ়তার সঙ্গে এমন স্পষ্ট করে বলেনি। কবি বলেন :

চির উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির
ওই শিখর হিমাদ্রির।

কোরআন বলে–আনতুমা খয়ারে উম্মাতীন। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তির কাছে মানুষের শির অবনমিত হবে না। মানুষ আশরাফুল মখলুকাত।

কবি বলেন- এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো কাবা-মন্দির নাই।

ইসলাম বলে : মানুষের হৃদয় কাবা স্বরূপ।

কবি বলেন

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নাই কিছু মহীয়ান
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি।

ইসলাম বলে– মানুষ সব এক আদমের সন্তান এবং পরস্পর ভাই ভাই

কবি বলেন- তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।

অথবা, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হল।

ইসলাম বলে– যে-দুঃখ, যে-বেদনা, যে-লাঞ্ছনা তুমি নিজের জন্যে কামনা করতে পারো না, তা তোমার ভাইয়ের জন্যে কামনা করো না। প্রতিবেশীকে উপবাসী রেখে নিজে ক্ষুধার অন্ন গ্রহণ করো না।

কবি বলেন–সবদেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

ইসলাম বলে–মানুষকে ভালোবাসাই আল্লার শ্রেষ্ঠ এবাদত।

কবি চেয়েছেন–মানুষের ব্যক্তি-মর্যাদার সাম্য, বিত্ত-বৃত্তি নিরপেক্ষ ভ্রাতৃত্ব, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি; শোষণ, অত্যাচার ও আভিজাত্যবোধের উৎসাদন।

ইসলামের শিক্ষাও হচ্ছে :

নাই ছোট বড়–সকল মানুষ এক সমান,
রাজা প্রজা নয় কারো কেহ।
সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
কারো আঁখি জলে কারো ঘরে কী রে জ্বলিবে দীপ।
দুজনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বনসীব?
এ-নহে বিধান ইসলামের ॥

ইসলামের এ শিক্ষাই কবিকে মুগ্ধ করেছে। এজন্যেই কবি ইসলামকে আঁকড়ে ধরে আছেন। ইসলামের মানবতা ও সমাজ সংজ্ঞা তাঁর আদর্শের সম্পূর্ণ অনুকূল বলেই মানুষ নির্বিশেষের মিলন পীঠ কাবার ছবি তার বক্ষে অঙ্কিত; মানবতা ও সাম্যের বাণী-বাহক হজরত মুহাম্মদের নাম তাঁর জপমালা; এইজন্যেই মর্যাদার পূজারী উন্নতশির কবির হৃদয় কলেমা লাইলাহা ইলল্লাহু মুহম্মদ রসুলাল্লাহ আন্দোলন জাগায়। তাঁর এই ইসলামপ্রীতি ধার্মিকতাপ্রসূত নয়–মানবতা ও ব্যক্তি নিষ্ঠাজাত। ধর্মপ্রাণতা নয়– আদর্শানুগত্য। তাঁর আদর্শের সাধনার অনুকূল উপাদান তিনি যেখানেই পেয়েছেন, গ্রহণ করেছেন। তাই হিন্দুর দেবদেবী, পুরাণ প্রভৃতিও তাঁর কাব্যসাধনায় ও আদর্শানুসরণে প্রেরণা দিয়েছে, আশা জাগিয়েছে, ভাষা যুগিয়েছে। খলিফা ওমর, তার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন শুধু ধার্মিক বলে নয়, ইসলাম ও মুসলমানদের ভাগ্যবিধাতা বলেও নন, মানুষকে ভালোবেসেছেন বলে :

মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু।
বলিয়াছ ভাই–তাই তো
মারে এখন চোখের পানিতে
স্মরি গো সর্বদাই।

এইরূপে আমপারা, মোহররম, ফাতেহা-দোয়াজদহম মরুভাস্কর প্রভৃতি রচনায় কবি ইসলামের ও হজরতের জীবনের মানবতার দিকটি উদঘাটিত করেছেন। ইসলাম ও রসুলের জীবনের এই সৌন্দর্য ও শিক্ষায় তিনি মুগ্ধ ছিলেন। নিজের জীবনে ও সমাজে এই শিক্ষার বাস্তব রূপায়ণেই তাঁর সাধনা নিয়োজিত ছিল।

অতএব নজরুলের ধর্মবোধ স্বাতন্ত্রবুদ্ধি জাগায় না। এ ধর্ম কল্যাণ ও মিলনকামী। এ ধর্ম মোক্ষের সহায় নয়জীবনের অবলম্বন-ঋজুপথের দিশারী ও স্বস্থ জীবনের পাথেয়।

নজরুল-কাব্যে প্রেম

নজরুল ইসলাম ব্যবহারিক জীবন-সমস্যার কবি। সেজন্যেই তাঁর কাব্যে সমস্যানিরপেক্ষ রসসর্বস্বতা বিরল। মানুষের ব্যবহারিক জীবনকে রাষ্ট্রিক পেষণ ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে সহজ মনুষ্যত্বের আলোকে সুন্দর ও আনন্দপূর্ণ করে তোলাই ছিল নজরুলের সাধনা। এজন্যেই তাঁর কাব্যে আমরা উচ্চ দার্শনিকতার সাক্ষাৎ পাইনে। তিনি আদর্শ ও নীতি প্রচার করেছেন, কোথাও তত্ত্ব প্রচার করেননি। তাই তিনি বিদ্রোহী কবি, বিপ্লবী কবি, জনস্বার্থের কবি, মানুষের কবি, মানবতার কবি। কিন্তু দার্শনিক বা মরমী কবি নন। মানুষের আন্তজীবনের রহস্যঘন মূর্তি তিনি অঙ্কিত করেননি, বহির্জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অভাব-অভিযোগের কাহিনী তার কাব্যের উপজীব্য যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। –এ-ই ছিল কবির ব্রত বা সাধনার আদর্শ। তিনি বহির্জীবনকে নির্বিঘ্ন করতে চেয়েছেন, অন্তৰ্জীবনকে নির্ঘ করার সাধনা তার নয়। তবে আশা ছিল–গ্লানিমুক্ত ব্যবহারিক জীবন অন্তবৃত্তিগুলোকে বিকশিত ও সুষমামণ্ডিত করে তুলবে, বহিজীবনের আনন্দ অন্তবৃক্ষের মূলে রস যোগাবে-কাণ্ডে ফোঁটাবে ফুল; দেহকে করবে পুষ্ট, আত্মাকে করবে মহিমান্বিত।

তবু এই বিপ্লব, বেদনা এবং শক্তির কবির হৃদয় নারীপ্রেম বর্জিত ছিল না। যে স্পর্শ-চঞ্চলতা ও ভাবালুতা তাঁকে বিপ্লবী করেছিল, সে-প্রাণময়তাই তাঁকে প্রণয় ব্যাপারেও উচ্ছ্বাসী এবং হৃদয়ধর্মী করে রেখেছিল। নজরুলের প্রেমের কবিতার সংখ্যা কম নয়, প্রণয়-গীতিও বহু। বাঙলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কেউ অত গান লেখেন নি। নজরুলের গানের অধিকাংশই প্রেম-সংগীত।

নজরুল বিপ্লবের কবি, প্রাণপ্রাচুর্যের কবি, জীবনবাদের কবি! এদিক দিয়ে তার পৌরুষ-ব্যঞ্জনা ও দৃঢ়তার সীমা নেই। কিন্তু প্রণয়-ব্যাপারে কবি শিশুর মতো অসহায়, শিশুর ন্যায় অশ্রুর আবেদন ছাড়া তাঁর আর গতি নেই। যে-কবি শক্তির পূজারী, মনোবলের উদ্গাতা, আপনার সীমাহীন শক্তির উত্তেজনায় যিনি সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে নতুন করে গড়ার প্রয়াসী: সে-কবির প্রণয় রাজ্যে অসহায়তা ও রিক্ততার সকরুণ হাহাকার পরমাশ্চর্যের বিষয় বই কি! এই অদ্ভুত অসামঞ্জস্যের কারণ খুঁজলে বোঝা যাবে–কবির হৃদয় উচ্ছ্বাসপ্রবণ ও কোমল। ব্যবহারিক জীবন ব্যাপারে যে-উত্তেজনা রক্ত ঝরাতে প্রবুদ্ধ করে, সেই উত্তেজনাই প্রণয় ব্যাপারে ব্যর্থতার কান্না ও হাহাকার এনে দেয়। একই হৃদয় বৃত্তির দুটো দিক : উচ্ছ্বাস-উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়া আর কেঁদে লুটানোআগুন জ্বালানো আর অশ্রু-ঝরানো। এজন্যেই আমরা তাঁকে একান্তভাবেই হৃদয়ধর্মী বলেছি। বুদ্ধিজীবী তিনি নন। তাই তাঁর সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিষয়ক বিপ্লবাত্মক রচনায় হৃদয়বৃত্তির উচ্ছ্বাসময় বিকাশ ও প্রকাশ দেখতে পাই, বুদ্ধিমত্তা ও মনীষার দীপ্তির সাক্ষাৎ পাইনে। হৃদয়-উদ্ভুত সত্যনিষ্ঠাই এসব রচনার প্রাণ। তাই বিপ্লবী কবির রচনায় ভাঙ্গার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই।

নজরুল ইসলামের প্রণয়-কাব্যেও উঁচু দার্শনিকতা নেই। শেলী, ব্রাউনিং বা রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি অতীন্দ্রিয় প্রেমরাজ্যে বিহার প্রয়াসী নন। একান্তভাবে শরীর-নিষ্ঠ ভালোবাসার সাধক তিনি। এ কায়ার সাধনায় ছায়া যদি কোথাও মায়া পেতে থাকে, তবে তা আকস্মিক-সচেতন প্রয়াস নয়। যেমন :

যা কিছু সুন্দর হেরি করেছি চুম্বন,
যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর–
সে সবার মাঝে যেন তব হরষ…

অনুভব করেছেন, এবং—

কথা কও কথা কও প্রিয়া
হে আমার যুগে যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া
—[অনামিকা]

এ শরীরনিষ্ঠ প্রণয়-কথা বলবার সাহসও কম প্রশংসনীয় নয়। কবি মোহিতলালও শারীর প্রেমের কবি। সে-প্রেম অবশ্য আত্মাকে বাদ দিয়ে নয়। দেহভিত্তিক প্রেমের মানসোপভোগই মোহিতলালের কাব্যাদর্শ। যদিও মোহিতলাল শরীরনিষ্ঠ প্রণয়-পূজারী, তবু নজরুলের মতো এমন উচ্ছ্বাস ও প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ তাঁর পক্ষে সর্বত্র সম্ভব হয়নি। ইতোপূর্বে কবি গোবিন্দ দাসের একটি কবিতায় দেহনিষ্ঠার নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ দেখেছি

আয় বালিকা খেলবি যদি এ এক নতুন খেলা,
চুপ চুপ চুপ কসনে কারো এ এক নতুন খেলা।

রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমল কাব্যে বিবসনা, স্তন, দেহের মিলন, প্রভৃতি কবিতা রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এসব কবিতা অতীন্দ্রিয় প্রণয়-রাজ্যের সোপানস্বরূপ বলা যেতে পারে, কেননা তিনি এতে তৃপ্তি খুঁজে পাননি। সুতরাং নজরুল ইসলামই দেহনিষ্ঠ মানবীয় ভালোবাসার প্রধান সপ্রতিভ স্তুতিকার। মানুষের দেহ, মন, প্রাণ, কর্ম সবকিছু যে-দেশে দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত; অধ্যাত্মপ্রেম ছাড়া যে-দেশে অন্য প্রেমের কোনো স্বীকৃতি নেই, সে-দেশে সে-সমাজে এমনি প্রণয়সাধনা কম দুঃসাহসের কথা নয়। তাঁর সমসময়ে আমরা মোহিতলালকে এবং তারপরে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতিকে পাচ্ছি। কামাক্ষীপ্রসাদ ও আরো অনেকের কবিতায় এসব বস্তুনিষ্ঠা অনুকৃত হয়েছে।

কিন্তু তাঁর শরীরনিষ্ঠ সাধনায় অসংযম বা অশ্লীলতা নেই, ক্লেদ-পঙ্কিল বীভৎসতা কোথাও প্রকট হয়ে উঠেনি। এ দেহসর্বস্ব প্রণয়েও পবিত্রতা এবং সুষমা কোথাও অস্বীকৃত হয়নি। তাঁর দোলন চাঁপা, ছায়ানট পূবের হাওয়া ও বুলবুলের কবিতা ও গানগুলোতে এবং আরো অনেক গানে আমাদের উক্তির সমর্থন মিলবে। নজরুল শারীর- প্রেমের সাধক হলেও আত্মার অস্তিত্ব ও প্রভাব অস্বীকার করেননি। এজন্যেই উদ্বেল ভাবাবেগে কবি এখানে-সেখানে শরীরের সঙ্গে আত্মাকে এবং আত্মার সঙ্গে দেহকে টেনে এনেছেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য অস্পষ্ট হয়েছে; অসামঞ্জস্য এবং অসংগতিও দুর্লভ নয়।

নজরুলের প্রণয়-সাধনা বিচিত্ররূপে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর প্রণয়তৃষ্ণারও গভীরতা এবং বিপুলতা নেই। তবু সর্বত্র ব্যর্থতার মর্মভেদী হাহাকার ও গাঢ় বেদনার মূৰ্ছনা প্রকট হয়ে উঠেছে। যে-কবির হৃদয় অগ্নিগর্ভ, বাণী অগ্নিক্ষরা এবং যাকে বলদৃপ্ত, দৃঢ়চিত্ত, দাম্ভিক ও সীমাহীন ব্যক্তিত্বশীল বলে মনে হত, তিনিই নারীর করুণার ভিখিরি হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। অশ্রুর আবেদন ছাড়া দ্বিতীয় সম্বল নেই, দ্বিতীয় অস্ত্র নেই তাঁর নারীর হৃদয় জয়ার্থ প্রয়োগ করবার জন্যে। এতে বোঝা যায়, কবি যা ই বলুন না কেন, আসলে তার হৃদয় বড় দুর্বল, বড় কোমল :

আমার দুচোখ পরে বেদনার স্লানিমা ঘনায়,
বুকে বাজে হাহাকার করতালি,
কে বিরহী কেঁদে যায় খালি সব খালি
ঐ নভ, এই ধরা, এই সন্ধ্যালোক
নিখিলের করুণার যা, কিছু তোর তরে তাহাদের অশ্রুহীন চোখে।
—(বেলা শেষে)

অথবা

কান্নাহাসির খেলার মোহে অনেক আমার কাটল বেলা,
আজকে বড় শ্রান্ত আমি আশার আশায় মিথ্যা ঘুরে।
—(উপেক্ষিত)

বিদ্রোহী-র কবির ভেতরকার স্বরূপ :

খেয়ে এনু পায়ের ঠেলা–
আর সহেনা মাগো এখন আমায় নিয়ে হেলা ফেলা।

অথবা-

চাই যারে মা তায় দেখিনে।
ফিরে এনু তাই একেলা
পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে বক্ষে বিঁধে অবহেলা
বিশ্বজয়ের গর্ব আমার জয় করেছে ঐ পরাজয়
ছিন্ন আশা নেতিয়ে পড়ে ওমা এসে দাও বরাভয়।

হৃদয়-জগতে অহঙ্কার থাকলে আর যাই হোক প্রণয়ে সিদ্ধি নেই। তাই কবির অহঙ্কারের এমন ধূল্যবলুণ্ঠিত অবস্থা–এমন লাঞ্ছনা। আমিত্ব ও ব্যক্তিত্বের বিলোপ সাধনের দ্বারাই প্রণয়ে সাফল্য সম্ভব। পূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারাই প্রণয়ের মূল্য দিতে হয়।

নজরুলের প্রণয়-সাধনা একটানা ব্যর্থতার ইতিহাস, তবু এখানে-সেখানে এক আধটু আশার আলো যে নেই, তা নয়। তবে যে-সুর তাঁর কাব্যে প্রবল তা হতাশার–ব্যর্থতার–নৈরাশ্যের ও বেদনার সুর, সে সুরে ক্ষোভও কম নয়।

বায়ু শুধু ফোঁটায় কালিকা
অলি এসে হরে নেয় ফুল।

এই ব্যর্থতাও–স্মৃতি সুখময় হয়ে হৃদয় ভরে রইল। কারণ–

না চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে
তুমি শুধু তুমি
সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া
আজ আমি শতবার করে
তব প্রিয় নাম চুমি।

শুধু তাই নয়, কবির উপলব্ধির জগৎও প্রশস্ততর হয়েছে। প্রেয়সীকে পাওয়া নাই-বা গেল, কিন্তু প্রণয়ানুভূতি তো চিরন্তন হয়ে রইল, তাই-বা কী কম লাভ?

মরিয়াছে অশান্ত অতৃপ্ত চির স্বার্থপর লোভী
অমর হইয়া আছে, রবে চিরদিন,
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি।–(পূজারিণী)

এবং

যেদিন আমায় ভুলতে গিয়ে
করবে মনে, সেদিন প্রিয়ে।
ভোলোর মাঝে উঠব বেঁচে সেইতো আমার প্রাণ
নাইবা পেলাম চেয়ে গেলাম গেয়ে গেলাম গান।
—(গোপন প্রিয়া)

কারণ,–প্রেম সত্য-চিরন্তন। প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়। জন্ম যার কামনার বীজে। (অনামিকা)

নজরুলের পূজারিণী কবিতাটিকে তাঁর প্রণয়-দর্শনের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছি। কেননা এ কবিতায় তাঁর প্রণয়াদর্শের স্বরূপ পূর্ণরূপে উদঘাটিত হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এখানে প্রেমের আদি, মধ্য ও পরিণতির একটা স্পষ্টরূপ ধরা দিয়েছে। দেহ-কামনা এবং কাম-বিরহিত প্রণয়ানুভূতির সুন্দর সুষ্ঠু প্রকাশ এমনি করে আর কোনো কবিতায় বা গানে দেখা যায়নি। পূজারিণী কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। শুধু এ কবিতাটিও কবিকে অমরতা দান করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সমর্পণ পুবের চাতক চপল সাথী কবি-বাণী, অভিশাপ, অবেলার ডাক প্রভৃতি কবিতাও স্মরণীয়। অনামিকায় কবি পরমের সঙ্গে অনন্ত প্রেমের সন্ধান পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের অনন্ত প্রেম কবিতাটি এর সঙ্গে স্মরণীয় :

প্রেম সত্য প্রেম-পাত্র বহু অগণন;
তাই চাই বুকে পাই, তবু কেঁদে উঠে মন,
মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়,
যে পাত্রে ঢালিয়া খাও, সেই নেশা হয়।
চির-সহচরি।
এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি!
আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছে গোপন
বৃথা আমি খুঁজে মরি জন্মে জন্মে করিনু রোদন।…
প্রতিরূপে অপরূপা ডাক তুমি
চিনেছি তোমায়,
যাহারে বাসিব ভালো সে-ই তুমি
ধরা দেবে তায়,
প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম
সে সরার লোহু।
–(অনামিকা)।

এরূপ অনুভূতি আরো কয়েকটা কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। চিরজনমের প্রিয়া জন্মে জন্মে প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ হেঁয়ালির মতো ঠেকে। কারণ শারীর-প্রেমের কবির, বিশেষত মুসলিম কবির পক্ষে এসব শব্দের প্রয়োগ অবান্তর ও নিরর্থক। এসব শব্দের ব্যঞ্জনা অর্থবিভ্রান্তি ঘটায় মাত্র।

মোহিতলালের মানস-লক্ষ্মী, শাহাদত হোসেনের উপেক্ষিত, গোলাম মোস্তফার পাষাণী, আবদুল কাদিরের লাবণ্যলতা, খান মঈনুদ্দিনের রহস্যময়ী আর নজরুল ইসলামের পূজারিণী ও অনামিকা প্রায় একই জাতীয় কবিতা। উপরোক্ত কবিতাগুলোতে কবিগণের স্ব স্ব প্রণয়াদর্শ অভিব্যক্তি লাভ করেছে।

নজরুলের হবের হাওয়া গ্রন্থের গানে-কবিতায় কবিমনের প্রেমবৈচিত্র্য প্রকাশ পায়নি, পেয়েছে হালকা ও অনিৰ্দেশ্য বিরহ-বিলাস। এজন্যে কবিচিত্তে যেমন, পাঠক-চিত্তেও তেমনি এসব গান ও কবিতা বিশেষ দোলা জাগায় না। নজরুলের ব্যক্তিজীবনে যেমুন একধরনের চাঞ্চল্য, অস্থিরতা, অস্বস্তি ও অতৃপ্তি ছিল; তাঁর সাহিত্যিক জীবনেও ছিল তেমনি একপ্রকারের ক্ষোভ, তৃষ্ণা, অতৃপ্তি ও বেদনাবোধ। প্রথম জীবনের বাউণ্ডেলের আত্মকথা, রিক্তের বেদন থেকে তাঁর শেষ রচনায় অবধি তা প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে উপস্থিত। কোনো পাওয়াতেই যেন তাঁর মন ওঠে না। না পাওয়ার ক্ষোভ আর পেয়ে হারানোর বেদনাই যেন তাঁর জীবনব্যাপী একটা আর্তনাদ—একটা হাহাকার রূপে অবয়ব নিয়েছে। তাই নজরুল বেদনা-বিক্ষুব্ধ ঔপন্যাসিক, বিপ্লবী সগ্রামী কবি এবং প্রত্যাখ্যান-বিক্ষুব্ধ ও বিরহী প্রেমিক।

পরিশেষে বক্তব্য এই যে, নজরুল সংগ্রামে যেমন বাদপি কঠোরানি প্রণয়ে তেমনি কোমলানি কুসুমাদপি। তাঁর জীবনের স্বরূপ, তার অন্তর ও কবি-জীবনের পরিচয়, তাঁর সাধনা ও জীবনোপভোগের পদ্ধতি, তার অন্তর্জগৎ ও বাহ্যজগতের দিগদর্শন একটিমাত্র কথায় যথার্থভাবে প্রকাশ পেয়েছে :

মম এত হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী,
আর হাতে রণতূর্য।

এর চেয়ে যথার্থ আত্মপরিচয়, এর চেয়ে বেশি আত্মোপলব্ধি কবির আর কোথাও দেখা যায় না।

নজরুল-মানস

নজরুলের মন ছিল সরল, বুদ্ধি ছিল ঋজু, আত্মা ছিল অনাবিল। তিনি যা চেয়েছেন সহজভাবেই তা বলেছেন, যা ভেবেছেন তাতে কোনো কূট-সমস্যা নেই- জটিল যুক্তিজাল নেই। সরল মানুষের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনে চাওয়া ও পাওয়ার দাবীই তিনি পেশ করেছেন। তাই তাঁর কাব্যে দর্শন নেই, তত্ত্ব নেই। তার কাম্য ছিল : পারস্পরিক প্রীতি, সাম্য ও স্বস্তিপূর্ণ সমাজ। সুস্থ, স্বস্থ ও সুখী মানুষের সমাজ এবং এই মানুষকে ভালোবেসে, এই মানুষেরই ভালোবাসা পেয়ে তিনি আত্মপ্রসাদ ভালো করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন : আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। কাজেই তিনি সাম্য– কামী ও অভাবমুক্ত মানুষ তথা কাঙাল-বিরল সমাজকামী হলেও মার্কসবাদী ছিলেন না, তা তিনি বুঝবার চেষ্টাও করেননি কোনোদিন।

বলেছি, তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন সে-ভালোবাসা যেমন ছিল অকপট, তেমনি ছিল গভীর। তাই ভালোবাসার পথে যারা বাধা হয়ে রইল, তাদের প্রতি মারমুখো হয়ে রইলেন তিনি। এ হচ্ছে সরল হৃদয়ের অনভূতিজাত উত্তেজনা, চিন্তাপ্রসূত বিক্ষেভ নয়। তাই তার রচনায় ভাঙার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই। এজন্যেই তিনি সোজা কথাটা ভাবতে পারেননি যে, যাদেরকে তিনি গরিব ও দুর্বলের দুশমন মনে করেছেন, দোষ তাদের নয়– তাদের রক্ত ঝরলেই শত্ৰুনিপাত হয় না। এক জমিদার পথে বসলে আর এক জমিদার গজায়, এক পুঁজিপতি দেউলিয়া হলে আর এক ধনী মাথা উঁচু করে। গলদ রয়েছে গোড়ায়–অর্থাৎ সমাজকাঠামো, নৈতিক আদর্শ এবং ব্যষ্টির দায়িত্ব ও দাবী, কর্তব্য ও অধিকারবোধ না পাল্টালে এ ব্যাধির কবল থেকে নিষ্কৃতি মেলে না। সহজ প্রাণের চাহিদা আর প্রয়োজন-উপলব্ধি এক জিনিস নয়। নজরুল যা চেয়েছেন তা তাঁর প্রেমিকহৃদয়ের চাহিদা। এজন্যেই তাঁর কাব্যে দর্শন নেই, সমাজতত্ত্ব নেই, নতুন সমাজ গড়ার সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। কেবল যা চেয়েছেন তা পাননি বলে, প্রবল উত্তেজনায় সুমুখে যাকে পেয়েছেন তাকেই আক্রমণ করেছেন; কার্যকে ভেবেছেন কারণ, আর কারণ-এর খোঁজ পাননি বড় একটা।

ফলে প্রেমিক হলেন সংগ্রামী। প্রেম বিলোতে এসে বিরুদ্ধ-পরিবেশে পড়ে রক্ত ঝরানোর সংকল্প নিলেন। তার কথায়; দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি)। প্রত্যক্ষভাবে পারছেন না বলে পরোক্ষ উপায় গ্রহণ করলেন। অসির বদলে মসিই করলেন সম্বল এবং প্রকাশ্যে বললেন, রক্ত ঝরাতে পারি না যে একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা। এও হৃদয়বান কবির প্রায়-কায়িক উত্তেজনারই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে জাতপ্রেমিক–বিশ্বমানব প্রেমিক হলেন বিদ্রোহী, বিপ্লবী, সংগ্রামী ও জাতীয় কবি। ভাগ্যের পরিহাস!

এতে আমরা কিন্তু ভাগ্যবান হলাম। কেননা এতে আমরা জানলাম, জাগলাম আর অংশত জয়ীও হলাম। আবার এক ক্ষেত্রে নজরুল বাস্তববোধের ও সমস্যা-সচেতনতার বিস্ময়কর পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন– বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ভারতে ধর্মীয় পরিচয় গৌণ করে না তুললে কেয়ামত তক মারামারি চলতেই থাকবে। তাই এক্ষেত্রে অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে দেশগত জাতীয়তাবাদ প্রচারকে তিনি বিশেষ ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এই মুখ্যব্রতে বাঙলাদেশে তিনি অতুলনীয় এবং এর উদযাপনেও তিনি অসীম ধৈর্য, অপরিমেয় সহনশীলতা ও প্রচুর অধ্যবসায়ের স্বাক্ষর রেখেছেন।

নজরুলের হৃদয় ছিল কুসুমকোমল। তার বাইরের ধর্মও ছিল আবার বজ্রকঠোর–তাই তাঁকে  কুলিশ-কঠোর সংগ্রামী বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও তা তার যথার্থ পরিচয় নয়। কোনো প্রেমিকই কঠোর হতে জানে না, যদিও উত্তেজনাবশে নিষ্ঠুর আচরণও তার পক্ষে সম্ভব। সে কেবল আকস্মিক এবং ক্ষণিকের রূপ–স্থায়ীভাবে নয়। তাই তার প্রেমের কবিতায় তাঁকে পৌরুষের অভিমান-বর্জিত কেঁদে-লুটানো অসহায় প্রেমপ্রার্থী রূপে দেখি, যদিও তিনি বলেছেন এবং কাজে দেখিয়েওছেন;

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশী আর হাতে রণ তুর্য।

তবু এহো বাহ্য। অন্তরে তিনি প্রেমিক, দয়ালু ও হৃদয়বান। মানুষকে ভালোবাসাই তার স্বভাব, দরদই তাঁর পুঁজি। কোন্দল করা নয়–গান গাওয়াই তার ব্রত। কিন্তু তাঁর বীণা প্রতিকূল প্রতিবেশে তরবারি হল। সে-তরবারিই আমরা দেখলাম, সংগ্রামী বলেই তাঁকে জানলাম, মানবপ্রেমিক আমাদের দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল। বিরাট সম্ভাবনা বিপ্লবে, সংগ্রামে ও জাতীয়তাবোধ-প্রচারেই নিঃশেষ হল। নজরুলের ভাগ্যের বিড়ম্বনা!

নজরুল হলেন প্রমূর্ত প্রাণময়তা। প্রাণচঞ্চল এ মানুষটি যখন ক্রুদ্ধ হন তখন চিৎকার করেন; যখন আনন্দিত হন, তখন অট্টহাস্য করেন। গাইবার সময় উঁচুকণ্ঠেই গান; উল্লসিত হলে হৈ হৈ, করেন; আর হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে দীলে চোট পেলে শিশুর মতো অসহায়ভাবে কান্নাকাটি করেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও অপরিমেয় মমতার আধারস্বরূপ এই পুরুষটি সংগ্রামে আলীর মতো নির্ভীক, অন্তরে বুদ্ধের মতো ক্ষমাসুন্দর, প্রীতিতে ঈসার মতো উকণ্ঠ আর প্রণয়-ব্যাপারে কৃষ্ণের মতোই। নিঃসংকোচ। এমন মানুষকে ভালো না–বেসে পারা যায় না। তাই নজরুল আমাদের প্রিয়।

যে করেই হোক, নজরুল পূর্ববাঙালিদের প্রিয় ও সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যাপারে প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন। সেজন্যেই নজরুল-কাব্যের চর্চা যত বেশি হয়, ততই মঙ্গল। তাঁকে বারোয়ারিভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের রেওয়াজ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের আজকের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনজিজ্ঞাসায় নজরুলের কাব্যের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। যেজন্যে নজরুলের সগ্রাম, তা আজো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। নজরুলেরই সংকল্প–আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম-গণমানসে সংক্রামিত হোক।

নজরুলের কাব্যপ্রেরণার উৎস

কবি হতে হলে হৃদয়বৃত্তির বিশিষ্ট বিকাশ প্রয়োজন। এতে মন তীব্রভাবে অনুভূতিপ্রবণ ও স্পর্শচঞ্চল হয়ে উঠে। কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে এ বিকাশ পূর্ণমাত্রায় হয়েছিল। যে-বয়েসে মন শুধু গ্রহণ করতে থাকে এবং বিবেচনাহীন উচ্ছ্বাসে পরিচালিত হয়, সেই কিশোর বয়েসে কবি লড়াই-এর ময়দানে গিয়েছিলেন, দূর থেকে দেখেছিলেন বর্বরতার নির্লজ্জ অভিনয়, নিষ্ঠুরতার তাণ্ডব লীলা, পাশব-বৃত্তির নগ্ন আত্মপ্রকাশ, মানবতার অপমৃত্যু। জীবনের গ্লানি আর মৃত্যুর বীভৎসরূপ তাঁর কাছে প্রকট হয়ে ওঠে একান্তভাবে। এতে কবির অনুভূতিপ্রবণ স্পর্শচঞ্চল মন ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়। তার আত্মায় জ্বলে উঠল বিদ্রোহ, বিপ্লব আর মানবতাবোধের অপূর্ব দ্যুতিময় শিখা।

কবি ফিরে তাকালেন তাঁর দেশবাসীর দিকে। দেখলেন–সেখানেও দাসত্ব, দারিদ্র্য ও অশিক্ষায় মানোষের মুমূর্ষ আত্মা ধুকছে। কবির বিক্ষুব্ধ আত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। মারমুখী হয়ে তিনি সংগ্রাম শুরু করলেন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বাহুবল তাঁর ছিল না; তাই শোষণ অনাচারের বিরুদ্ধে চলল বাণীর অভিযান :

রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা।

তার সে কী তীব্রতা! সে কী আশ্চর্য আবেগমুখরতা! ক্ষোভে, জ্বালায়, যুক্তির সারবত্তায়, বাচনভঙ্গির তীক্ষ্ণতায়, উচ্ছ্বাসের দুর্বার গতিবেগে সহস্র বজ্রনিনাদে তাঁর বাণীবর্শা নিপতিত হতে লাগল এটমবোমার মতো সমাজদেহে ও রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর। কবি উদাত্তকণ্ঠে সবিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন তার ব্রত :

আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খঙ্গ-কৃপাণ ভীমরণভূমে
রণিবে না।

শুরু হল সংগ্রাম–আপোষহীন, বিরামহীন। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ লাভ-ক্ষতির খতিয়ান গেল তলিয়ে। একান্তভাবে ভালোবেসেছিলেন তিনি স্বদেশকে ও স্বজাতিকে। হিংসা, ঘৃণা, দ্বেষ ছিল না কারো প্রতি। কারো ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অন্যায়ের প্রতি তাঁর ছিল না নালিশ। তাঁর সংগ্রাম আদর্শগত; ব্যক্তি, রুচি বা স্বার্থগত নয়। তাই দেশের মানুষ নির্বিশেষকে তিনি ভালোবাসতে পেরেছিলেন হৃদয়-মন দিয়ে, দ্বিধাহীনচিত্তে ক্ষমা করতে পেরেছিলেন ব্যক্তিজীবনের স্থলন-পতন-ত্রুটি। এইজন্যেই নারীপুরুষ, কৃষকমজুর, এমনকি বারাঙ্গনাকেও তিনি সমান উদারতায় মর্যাদা দিতে পেরেছেন। শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছেন মানুষ নির্বিশেষকে অকুণ্ঠচিত্তে।

পতিত স্বদেশ ও নির্যাতিত স্বজাতিকে ভালোবাসতে গিয়ে কবি বিশ্বের সমস্ত নির্যাতিত মানবতাকে ভালোবেসেছেন। স্বদেশ ও স্বজাতির জন্যে ফরিয়াদের হাত উঠিয়ে তিনি দাসত্ব, শোষণ ও অত্যাচার-জর্জরিত বিশ্বমানবের জন্যে আন্তরিকভাবে ফরিয়াদ জানিয়েছেন। এ কারণেই দুর্গত এশিয়ার সমস্ত অনুন্নত, পেষণক্লিষ্ট জাতির সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষায় সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত হতভাগ্য এশীয় জাতিগুলোর সবকটাই মুসলমান। তাই কোনো কোনো পাঠক সমালোচক তাকে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তাবাদী বা pan Islamism-এ বিশ্বাসী ঠাউরেছেন। আমাদের মনে হয়, তাঁদের এ বিশ্বাসে গলদ আছে, কেননা তাঁর মুসলিম দেশ ও বীর-প্রশস্তি বিষয়ক কবিতাগুলো মুসলিম প্রীতির চেয়ে দুঃখীর প্রতি সমপ্রাণতার পরিচয়ই যেন বেশি বহন করছে। যেমন–

ইরাকবাহিনী! এ যে গো কাহিনী
কে জানিত কবে বঙ্গবাহিনী
তোমারও দুখে জননী আমার
বলিয়া ফেলিবে তপ্তনীর?
পরাধীনা! এই একই ব্যথায় ব্যথিত
ঢালিল দু-ফোঁটা অশ্রু ভক্ত বীর। অথবা–

তাই

মিশরের নহে এই শোক
এই দুর্দিন আজি,
এশিয়া-আফ্রিকা দুই মহাভূমি
বেদনা উঠিছে বাজি।
অধীন ভারত তোমারে স্মরণ
করিয়াছে শতবার।

এরূপ আরো কবিতায় কবি এশিয়ার অনুন্নত দেশসমূহের নব-জাগরণে উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে স্বদেশীয়দের নিষ্ক্রিয়তার জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন;

এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে হে ঋষি
তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল।
চলিতেছে দিবানিশি।

অথবা

খররোদ পোড়া খর্জুর তরু তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর।
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ভারতের বুকে নাই রুধির!

অপর কয়েকটা কবিতায় তিনি অন্যদেশের ন্যায় স্বদেশেও জাগরণ কামনা করেছেন :

জেগেছে আরব ইরান তুরান।
মরক্কো আফগান মেছের
এয় খোদা! এই জাগরণ রোলে।
এই মেষের দেশও জাগাও ফের।

অথবা

মলয় শীতল সুজলা এদেশে
আশিস করিও খালি–
উড়ে আসে যেন তোমার দেশের
মরুর দু মুঠো বালি!

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলত আত্যন্তিক স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রেমের যে-অভিব্যক্তি বাণীরূপ লাভ করল, তা বৃহত্তর ক্ষেত্রে আচার, সংস্কার, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নক্লিষ্ট মানবসাধারণের মুক্তি-জেহাদের রূপ গ্রহণ করেছে। এ জেহাদ একাধারে ত্রিমুখী : বিদেশী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি-সগ্রাম, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক কুৎসিত মনোভঙ্গির উৎসাদন প্রয়াস এবং ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি প্রচেষ্টা। এ-জেহাদে নজরুল অকপট মুহিদ ছিলেন। সংকল্পের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ ছিল নিবিড়। যে-ব্ৰত তিনি হৃদয়-মন-বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করলেন, তার উদযাপন প্রচেষ্টায়ও তিনি উক্ত বৃত্তিনিচয়ের উদার ও অবাধ সহযোগিতা পেলেন। ফলে তার মুখনিঃসৃত বাণী জ্বালায়, দরদে, ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে তীক্ষ্ণ-তীব্র মধুর হয়ে উঠেছে।

কবি নিজে ছিলেন প্রাণধর্মী। এজন্যে প্রাণধর্মের প্রতীক তরুণ ও তারুণ্যকে কবি সর্বত্র অভিনন্দন জানিয়েছেন :

কুপমণ্ডুক অসংযমীর
আখ্যা দিয়াছে যারে–
তারি তরে ভাই গান রচে যাই
বন্দনা করি তারে।

কবি জীবনধর্মী অভিযাত্রীও বটে, তাই তিনি বলেছেন :

গাহি তাহাদেরি গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে
যারা আজি আগুয়ান।

এসবও হয়তো বাহ্য লক্ষণ। তার সর্বসংগ্রামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার সম্যক উপলব্ধি। তিনি এজন্যেই বলেছেন :

নাই দানব নাই অসুর? চাইনে সুর, চাই মানব।

কারণ–

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নাই কিছু মহীয়ান।

এহেন মানুষের তিনি প্রেমিক। এই মানুষকে ভালোবেসেই তিনি ধন্য হতে চান– জীবনকে চান সার্থক করে তুলতে। এমন মানুষের দুঃখ-বেদনা লাঞ্ছনায় কী তিনি স্থির থাকতে পারেন? তাই তাঁর ভাষা এত তীব্র, বাণী এমন তীক্ষ্ণ এবং জোরালো? এই ভালোবাসাই তাঁকে সাম্যবাদী করেছে– করেছে বিদ্রোহী, করেছে বিপ্লবী। কিন্তু তাঁর সাম্যবাদকে মার্কসবাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করলে ভুল হবে। কারণ তাঁর সাম্যবাদের গোড়ার কথা হচ্ছে মানুষ এক আদমের সন্তান, সুতরাং মানুষ মাত্রেই ভাই ভাই। মানুষ হচ্ছে আনতুমা খয়ায়ে উম্মাতীন। অতএব এক আল্লাহ ব্যতীত কোনো মর্ত্যশক্তির নিকট তার মাথা নত করতে নেই। মানুষের এ মর্যাদায় তিনি পূর্ণ বিশ্বাসী। সর্বপ্রকার কর্ম ও বৃত্তি যখন জীবন ও সমাজ রক্ষার জন্যে অপরিহার্য তখন কোনো কাজ বা পেশাই ছোট নয় এবং বৃত্তির জন্যে কেউ হেয় হতে পারে না। সেইজন্যেই কবি সাম্যের বাণী প্রচার করেছেন। তবু শ্ৰেণীবিলুপ্তির কথা তাঁর বাণীতে নেই। তিনি চেয়েছেন স্ব-স্ব অধিকার, বিত্ত ও বৃত্তি বজায় রেখে স্বাধিকারে স্বাধীনভাবে ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদার পূর্ণ স্ফুরণ; চেয়েছেন এমন ব্যবস্থা যাতে স্ব স্ব স্বাতন্ত্র, মর্যাদা ও বৃত্তি বজায় রেখেও মানুষ যেখানে আসিয়া সমবেদনায় সকলে হয়েছে। ভাই। আইন করে চাপানো ধনসাম্য নয়–প্রীতি-বন্ধুত্বের সাম্য তথা সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাম্যই কবির কাম্য।

এই আদর্শই ছিল তাঁর কাব্যপ্রেরণার উৎস। এই আদর্শের বাস্তব রূপায়ণই ছিল তাঁর ব্রত। এই উদ্দেশ্যেই তাঁর সাধনা। এই-ই হচ্ছে তাঁর কাব্যের মূলবাণী–গানের মূল সুর। এইজন্যেই এ আদর্শের রূপায়ণে প্রতিবন্ধকস্বরূপ যতকিছু ছিল, সবকিছুর বিরুদ্ধে সর্বত্র তাঁর বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে। তিনি মানবতার পূজারী মহাসাধক, প্রাণ-ও-জীবনধর্মের মূর্ত প্রতীক।

সুতরাং মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অর্জন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। যুগে যুগে সমাজ, সংস্কার, রাষ্ট্র প্রভৃতির অবাঞ্ছিত জঞ্জাল এসে মানুষের এই মৌলিক অধিকারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কবির সংগ্রাম হচ্ছে তাকে সব বাধা ও মালিন্য মুক্ত করে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। সে-সংগ্রাম করতে গিয়েই কবি বাঙালির সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে একযোগে বিপ্লব আনয়ন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিরাট ও মহান। তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটা বাঙালি জাতিকে (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দাঁড় করানো। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, আদর্শে, আচারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ধর্মে, সাহিত্যে কোথাও যেন গ্লানি না থাকে। মনুষ্যত্বের সুউচ্চ সাধনায় যেন তার দেশবাসী আত্মনিয়োগ করে–এই ছিল তাঁর অভিলাষ।

প্রতিভাবানেরা সমসাময়িক যুগের দিশারী ও নিয়ন্তা এবং ভবিষ্যৎকালের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। কাজী নজরুলও এমনি একজন প্রতিভা। তিনি সমাজে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরে নতুন যুগের প্রবর্তন করেছেন। যা অভিলাষ করেছিলেন, তা অনেকাংশে পূর্ণও হয়েছে। ভবিষ্যতে একদিন তাঁর স্বপ্ন হয়তো পুরোপুরিভাবেই সফল হবে। সেদিন তিনি থাকবেন না, কিন্তু তার আদর্শানুসারী লক্ষ লক্ষ প্রবুদ্ধ জন-কণ্ঠে সেদিন নিবেদিত হবে তাঁর প্রতি অকপট শ্রদ্ধা।

নজরুলের কাব্যসাধনার লক্ষ্য

নজরুল ইসলামই মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র কবি–যার অনন্য প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতা ছিল। প্রতিভাবানেরা সমসাময়িক যুগের দিশারী ও নিয়ন্তা এবং ভবিষ্যৎকালের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। নজরুল ইসলামের মধ্যেও আমরা এসব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরে একযোগে বিপ্লব আনয়ন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিরাট ও মহান। তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটাজাতিকে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে দাঁড় করানো। শিক্ষায়, সভ্যতায়, আচারে, আদর্শে যেন কোথাও গ্লানি না থাকে, মনুষ্যত্বের সুউচ্চ সাধনায় যেন তার দেশবাসী আত্মনিয়োগ করে– এ-ই ছিল তার অভিলাষ। এইজন্যেই তিনি বিপ্লবী কবি।

এইরকম আর একজন মাত্র প্রতিভা বাঙলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁরও সাধনা ছিল বাঙালি হিন্দুকে উন্নত সমাজাদর্শ, ধর্মাদর্শ, রাষ্ট্রাদর্শ ও জাতীয়তাবোধ দান করা। সমাজাদর্শে দেবী চৌধুরাণী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল এবং রাষ্ট্র ও জাতীয়তার প্রতীক তাঁর সীতারাম, আনন্দমঠ, রাজসিংহ প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুশীলন, ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র প্রভৃতির দ্বারা তিনি ধর্ম-সংস্কারের প্রয়াসী হন। নজরুল ইসলামও অগ্নিবীণা, সন্ধ্যা, সর্বাহারা, সাম্যবাদী, বিষের বাঁশী, জিঞ্জির, ভাঙ্গার গান প্রভৃতি কাব্য; আমপারা, মরুভাস্কর প্রভৃতি গ্রন্থ এবং কোরবানী, মোহররম, ফাতেহা দোয়াজদহম আর আমানুল্লাহ, জগলুলপাশা, খালেদ, কামালপাশা প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের প্রশস্তি দ্বারা একাধারে মুসলমান ও বাঙালি জাতির উন্নতি কামনা করে গেছেন। একদিক দিয়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বড়। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু হিন্দুর কথা ভেবেছেন, প্রতিবেশী মুসলমানকে তিনি আপনজন ভাবতে পারেননি। স্বামী বিবেকানন্দও মুচি, মেথর, চণ্ডাল ভারতবাসীকে ভাই বলেছেন, কিন্তু মুসলমানকে ভাই বলে বরণ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রও এ ত্রুটি থেকে মুক্ত নন। নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখেননি কখনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময়েও নয়। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে বাঙলার যমজ সন্তান বলেই জানতেন। বস্তুত সমগ্র বাঙলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামই একমাত্র লেখক–যিনি ভুলেও কখনো বিধর্মীকে বিদ্বেষ বা বিদ্রূপ করেননি। পক্ষান্তরে বাঙলা সাহিত্যের প্রায় সব হিন্দু-লেখকের লেখায় অল্প-বিস্তর মুসলমান-বিদ্বেষ বা বিদ্রূপ প্রকাশ পেয়েছে।

নজরুল-প্রতিভার পরম বিস্ময়কর দিক হচ্ছে সমকালীন জীবনবোধ। রাশিয়ার সাম্যবাদের বুলি যখন এদেশে পৌঁছেনি, তখন তারা ভারতবর্ষে–হয়তো গোটা এশিয়ায় তিনিই প্রথম জনগণের দুঃখ-দুর্দশার ফরিয়াদ নিয়ে সমাজের ও রাষ্ট্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং উদাত্তকণ্ঠে প্রতিকারের দাবী জানালেন। এমন অকৃত্রিম দরদী বাঙলাদেশে কমই জন্মেছেন। এইজন্যেই তাকে এককথায় জীবনধর্মী মানবতার কবি বলে আখ্যাত করা হয়েছে।

কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তিনি প্রচার-সাহিত্যের কবি, তাঁর সাহিত্যে সাহিত্যের চিরন্তন উপাদান নেই। এসব মতবাদ একটু সেকেলে। কেননা যে-সাহিত্য মানুষের রসপিপাসা মিটাতে সমর্থ, তা পুরোনো হবার নয়। ধরতে গেলে সাহিত্যের বিষয়বস্তু কোনোকালেই চিরন্তন নয়, কবি সাহিত্যিকের প্রতিভার স্পর্শেই নগণ্য বিষয়বস্তুও শিল্পায়ত্ত হয়ে চিরন্তন রসের উৎস হয়ে থাকে। যেমন একটি দুর্ভিক্ষ বা একটি বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের কাহিনী শিল্পীর সক্ষম তুলিকায় চিরন্তন বাণীমূর্তি লাভ করে সর্বকালের পাঠকের কাছে কারুণ্যের নিঝর হয়ে থাকতে পারে। অথচ দুর্ভিক্ষ বা বন্যা এমন কিছু চিরন্তন সাহিত্যের উপাদান নয়। সুতরাং ভাব বা বিষয়বস্তু সাহিত্যের তেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়, রূপায়ণশক্তিই সাহিত্যের চাবিকাঠি অন্য কথায় সাহিত্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে কঙ্কালস্বরূপ, ভাব হচ্ছে রক্তমাংস স্বরূপ এবং প্রাণ হচ্ছে প্রকাশভঙ্গি। এই প্রকাশ-প্রতিভা (style) না থাকলে রচনা সাহিত্য হয় না। সুতরাং নজরুল ইসলাম তার যে-কাব্য দিয়ে সমাজে সাহিত্যে-ভাষায় ছন্দে-সুরে যুগপ্রবর্তক কবি বলে অভিনন্দিত হলেন, সে-কাব্যের আবেদন অনাগতকালে থাকবে না এমন ধারণায় সত্য নেই বিশেষ। কেননা যা সাহিত্য তা রসোত্তীর্ণ কাজেই নজরুলের কাব্যের যে অংশ সাহিত্যরসময় সে-অংশ কখনো বিলুপ্ত হবে না। তা পুরোনো সাহিত্যরূপে উত্তরকালেও কদর পাবে। যদি সমালোচকদের যুক্তি মেনে নিয়ে বলি যেহেতু ইহা প্রচার সাহিত্য–এ-যুগের প্রয়োজনেই রচিত, সেহেতু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী যুগে এর কদর হবার কথা নয়, তাহলেও আমরা ভুল ধারণাই পোষণ করব, কেননা সেদিন এই সাহিত্য ইতিহাসের বাণীর ন্যায় সে-অনাগত দিনের জনগণকে আদর্শচ্যুতি বা পথবিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে। কারণ নির্বিশেষ মানুষ কোনোদিন দুষ্পবৃত্তির ও সংকীর্ণতার উপরে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। সুতরাং আজকের মতো সেদিনও পাঠকচিত্তে নজরুলের কাব্য রস ও প্রেরণা যোগাবে।

নজরুল ইসলাম স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক কবি। তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি নির্যাতিত মানবতার কবি। স্বদেশের দুঃখী জনসাধারণের দুঃখ-বেদনা-নিপীড়নের ফরিয়াদ ও প্রতিকার প্রচেষ্টায় তিনি কলম ধরেছিলেন। সর্বপ্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অত্যাচারমুক্ত করে মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর ব্রত : যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস। যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেশ-জাতি ও শ্রেণীর ঊর্ধ্বে মানুষের যেখানে নির্বিশেষ পরিচয়, সেই পরিচয়ের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত এবং নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন করে তোলাতেই তাঁর সাধনা নিবদ্ধ ছিল। বিত্ত-বৃত্তি নিরপেক্ষ মানুষের যে–ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তির আত্মিক মর্যাদা আছে– সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করাই ছিল তাঁর কাব্যসাধনার লক্ষ্য। তিনি চেয়েছিলেন মনুষ্যত্বের অবাধ স্ফুরণ ও বিকাশের অধিকার। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মানুষ নির্বিশেষের অবাধ ও সহজ মিলনের; যে-মিলনে বিত্ত-বৃত্তি-বেশাত বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, যে-মিলন সম্ভব হয় পরস্পরের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদার স্বীকৃতির উপর। তিনি চেয়েছেন এমন মিলন ময়দান যেখানে মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যাত্মা লাঞ্ছিত হয় না এবং যেখানে আসিয়া সমবেদনায় সকলে হয়েছে ভাই।

নতুন দৃষ্টিতে মধুসূদন

মধুসূদনকে আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষাপুষ্ট, আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসু, নবমানবতার উদ্গাতা আভিজাত্যগর্বী পরিশীলিত রুচির কবি এবং ধন-যশ-মান-লিন্দু উচ্চাভিলাষী মানুষ বলেই জানি এবং মানি। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ছিল অসামান্য, প্রয়াস ও সাধনা ছিল নিখাদ, আর আকাঙ্ক্ষা ছিল ধ্রুব। আকাক্ষা তো নয় যেন যোগ্যতালভ্য দাবী! তাঁর অটল আত্মবিশ্বাসই তার উদ্ধত উক্তি ও দাম্ভিক আচরণের উৎস। কৈশোরে ও যৌবনে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার চাওয়া আর পাওয়া নিয়তির মতো অমোঘ। তার এমনি আত্মপ্রত্যয় তাঁকে শিশুর মতো খেয়ালি, প্রাণবন্ত, বেপরওয়া ও উদ্ধত করেছিল। আমাদের চোখে যা অবিমৃষ্যকারিতা ও অপরিণামদর্শিতা, তার কাছে তা-ই ছিল লক্ষ্য-নির্দিষ্ট অকৃত্রিম জীবন-প্রয়াস। তাঁর সীমাহীন আত্মপ্রত্যয় তাঁকে নিশ্চিত সিদ্ধির যে প্রত্যক্ষ মরীচিকায় নিশ্চিন্ত রেখেছিল, উত্তর-তিরিশে তা যখন নিয়তির ছলনারূপে প্রতিভাত হল, তখন হতাশায় ও হাহাকারে তাঁর মন-মরু কুঁকড়ে কেঁদে উঠল! তারই প্রতিচ্ছবি পাই আমরা তাঁর অমর কাব্যে ও রাবণ চরিত্রে।

পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট ইয়ংবেঙ্গলের ঐহিক জীবনবাদ ও পুরুষকারের বিঘোষিত মহিমার প্রতিমূর্তি ছিলেন মধুসূদন। আর তারই প্রতিচ্ছবি হলেন রাবণ। কিন্তু এই পুরুষকারের মূল আত্মায় নয়, আত্মম্ভরিতায়। কেননা পাশ্চাত্য জীবনবোধে ভূঁইফোড় মধূসূদনের চেতনায় পৌরুষ, ঐশ্বর্যগর্ব ভোগলিপ্সা স্কুল ও অমার্জিতই রয়ে গেছে; তার জীবনে কিংবা কাব্যে তা সূক্ষ্ম ও পরিসুত রুচি বা রসবোধে পরিণত হয়নি বরং দাম্ভিকতায় তার প্রকাশ এবং হতবাঞ্ছার হাহাকারে ঘটেছে তার পরিণতি।

এ কেন এবং কেমন করে ঘটল, তা-ই বুঝবার চেষ্টা করা যাক। সুরুচি ও সংস্কৃতি হচ্ছে। শিক্ষা, শীল ও চর্যার প্রসূন। কাজেই তা জীবনে ফুটিয়ে তুলতে হয়, বাইরে থেকে জুড়ে দিলে চলে না। প্রতীচ্য শিক্ষার মাধ্যমে ভারত-ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মিলন-মুহূর্তে মধুসূদনের জন্ম। ইরেজের মহিমামুগ্ধ পিতার সন্তান, কোলকাতাবাসী ইরেজি-পড়য়া মধুসূদন আবাল্য প্রতীচ্য সংস্কৃতির রূপে মুগ্ধ। দেশী জীবনবোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই নতুন-দেখা সংস্কৃতির সাদৃশ্য সামান্যই। কৈশোরেই মধুসূদন এই সংস্কৃতির পূজারী হলেন বটে কিন্তু যে-পরিবেশে কোনো সংস্কৃতি রক্তের-সংস্কারে পরিণত হয়; আজন্ম লালনে অনুভূতিসিদ্ধ অপরিহার্যতায় পরিণতি পায়; দেখে-শেখা ও পড়ে-পাওয়া সংস্কৃতি সে পরিবেশ পায় না, তেমনিভাবে আত্মস্থও হয় না, তা আভরণের মতোই আলগা থেকে যায়, ত্বকের মতো অঙ্গীভূত হয় না। একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। কোনো অশিক্ষিত বা অশিক্ষিত-পরিবেশে লালিত অল্পশিক্ষিত ব্যক্তি যদি ঠিকেদারী কিংবা ব্যবসা করে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়, তাহলে সেও দেশের সংস্কৃতিবান ঐশ্বর্যশালী অভিজাতের মতো করে দালান-কোঠা তৈরি করে, আসবাবপত্র সাজিয়ে, বাগান-ফোয়ারা বানিয়ে চিত্র ও ভাস্কর মূর্তি রেখে সুরুচি ও আভিজাত্যবোধের প্রতিযোগিতায় নামে। কিন্তু দুয়ের মধ্যে তফাৎ রয়েছে বিস্তর, একের পক্ষে যা আজীবন চর্চার অঙ্গ, অপরের পক্ষে তা বিলাস-বাঞ্ছার ও গৌরব-গর্বের সামগ্রী। একজনের যা আত্মোখিত, অপরজনের তা বহিরার্জিত। একে করে অন্তরের প্রবর্তনায়, অপরজনে গড়ে ঐশ্বর্য-শালিতার আস্পর্ধায়। একজনের দৃষ্টি অন্তর্মুখী, অপরজনের নজর বহির্মুখী!

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চর্চায় মধুসূদন এই অপরজন। কেননা, ইংরেজের সংস্কৃতিতে কেবল ইংরেজেরই অধিকার। এ তার পুরুষানুক্রমিক সাধনায় পাওয়া ধন, এ তার স্বরূপেরই বিচিত্র বিকাশ। এতে তারই আত্মার ঐকান্তিক ও অকৃত্রিম প্রকাশ। এ তারই দেহ-মন-আত্মার লাবণ্য, উপলব্ধ জীবনসত্য, এ কেবল তারই অঙ্গের লাবণ্য বাড়ায়, কেবল তারই চলন-বলন ও মননে শোভা পায়। এ তার নৈষ্ঠিক জীবনচর্যার প্রসূন। কাজেই এতে মধুসূদনের উত্তরাধিকার ছিল না। তিনি হলেন usurper–জবর দখলকার। এ সংস্কৃতির মর্মে অধিকার ছিল না তার। কেবল অবয়বে মালিকানা পেয়েই তিনি বাহ্যাড়ম্বর ও আত্মম্ভরিতাকে আভিজাত্য প্রকাশের বাহন করলেন। তাই তাঁর দৃষ্টি ছিল বহির্মুখখা। অন্তরের ঐশ্বর্যের মূল্য-মাহাত্ম্য তাঁর বোধে ধন-সম্পদের কাছে ম্লান। এজন্যে তিনি তার জ্ঞান-মনীষা, পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের কাঞ্চন-মূল্যের প্রত্যাশী ছিলেন। পদমর্যাদা ও ধন-সম্পদের যে ব্যবহারিক দাপট, তা-ই তাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি। চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, কিংবা মনীষার জন্যে মানুষের অন্তরে ব্যক্তিবিশেষের জন্যে যে শ্রদ্ধার পুষ্পসন রচিত হয়ে থাকে, তা যে অসামান্য ও অতুল্য, সে তত্ত্ব তাঁর মনে জাগেনি। তাই ধনীর প্রতি ছিল তাঁর ঈর্ষা আর সাধারণের জন্যে ছিল তার অনুকম্পা ও অবজ্ঞা। ছাত্রজীবনে মাঝারি ছাত্রের সঙ্গেও তিনি মিশতেন না। আবার মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে মেশার দীনতা-সূচক আগ্রহ ছিল তাঁর তীব্র। কবি হবেন–এ বাসনা থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সবচেয়ে বড় কবি হব–এ আকাক্ষা মনে রাখা নয়, কথায় ব্যক্ত করা হল সেই বহির্মুখখা দৃষ্টিজাত ঔদ্ধত্য। আমি কবি হব এই বাসনা প্রকাশে বাধা নেই, কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের চাইতে বড় কবি হব, এ উক্তি কেমন শোনায়,–কোনো অর্বাচীন-অবিমৃষ্য-অসংযত মনের পরিচয় দেয়!

সাহেবের দোকানে চুল কাটিয়েছি এক মোহর দিয়ে, রাজনারায়ণের ছেলে গুণে পয়সা দেয় না। দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা দেখে বড়লোকের ছেলে তাই … রাজকবি টেনিসনের মর্যাদা দেখে রাজকবি হওয়ার স্বপ্ন ও প্রয়াস, সাহেবপাড়ায় বাস করার জেদ, সাধারণ লোককে অনুগৃহীত করার আগ্রহ, পড়ে বড় হওয়া সত্ত্বেও কড়িতে বড় হওয়ার অস্থির প্রয়াস, ছোটলোকের কাছে বড়পনা ফলানোর জন্যে ধনী বন্ধুর কাছে কাঙালের মতো ধার চেয়ে বেড়ানো আর ছোটলোকের প্রাপ্য মিটিয়ে জবান রাখার আত্মপ্রসাদ লাভের মধ্যেও একই মনোভাব কাজ করেছে।

ত্যাগ ও অনাসক্তির মধ্যেও যে সুখ ও মর্যাদা আছে, তা ভোগকামী মধূসূদন ক্ষণকালের জন্যেও উপলব্ধি করেননি। তাঁর এত বিদ্যা, এত ভাষাজ্ঞান এবং অসামান্য প্রতিভাই তাকে সমাজে প্রথম শ্রেণীর গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তাঁর চোখের সামনে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায় কেশবচন্দ্র প্রমুখ অনেকেই কোলকাতার ধনীসমাজের শ্রদ্ধেয় ও মান্য হয়ে উঠেছিলেন। মধুসূদনের সেদিকে খেয়াল ছিল না। কেননা তিনি যে কোলকাতার ধনী-মানীর অন্যতম রাজনারায়ণ মুন্সীর সন্তান ও বিদগ্ধ সাহেব, তা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারেননি। তাই তিনি ঐশ্বর্য ও পদমর্যাদার মোহে মরীচিৎকার পিছু নিয়েছিলেন। এ কারণেই তাঁর জ্ঞান, মনীষা-কবিত্ব তাঁকে তৃপ্তি দেয়া দূরে থাক, প্রবোধও দিতে পারেনি। অবশ্যি ভেতরকার আর্তনাদ ঢেকে রাখবার জন্যে তিনি এসবেরও আস্ফালন কম করেননি। কিন্তু এহো বাহ্য। কেননা, প্রজ্ঞা কিংবা আত্মিক ঐশ্বর্য-চেতনা তাতে ছিল অনুপস্থিত কিংবা সুপ্ত। নইলে ভোগ ও ঐশ্বর্থিক উন্নতিকে তিনি তুচ্ছ বলে মানতেন। ভাগ্যের এমনি বিড়ম্বনা, অপ্রমেয় আত্মপ্রত্যয় ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার জীবনের কোনো অভীষ্টই সিদ্ধ হয়নি। যে-কবি হওয়ার বাসনায় তিনি খ্রীস্টান হয়ে বিলেত যেতে চেয়েছিলেন তা অপূর্ণই রয়ে গেল। সময়মতো বিলেত যাওয়া ঘটেনি, তাঁর উদ্দিষ্ট কাব্যও তাই আর রচিত হয়নি। যেভাবে যেমন লোকবন্দ্য কবি হবেন আশা করেছিলেন, তা এমনিভাবে ব্যর্থ হল।

তারপর বাঞ্ছহত প্রায় বেকার মধুসূদন যৌবনের প্রান্তে এসে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখের ইয়ার্কিসুলভ Challenge গ্রহণ করে নিতান্ত কৌতুকবসেই বাঙলায় প্রতীচ্য আদর্শে সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। এ হল অনেকটা খেলতে খেলতে সাহিত্য সৃষ্টি। অতএব জীবন- প্রভাতে যে কবি হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা অপূর্ণই রয়ে গেল। অথচ তন্ময় কাব্য-সার্থক মহাকাব্য রচনার জন্য যে-বিদ্যা ও বৈদগ্ধ্য প্রয়োজন তা তাঁর পুরোমাত্রায় ছিল। আবার ইংরেজি-বাঙলায় যা লিখলেন সমকালে তা-ও ন্যায্য কদর পেল না। উচ্চপদ কিংবা রোজগারের জন্যে যে-যোগ্যতা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। ব্যারিস্টারি পাস করেও তিনি কোনোটাই পেলেন না। এমনি বিড়ম্বিত জীবন তার। এই হল মধু-জীবনে নিয়তির নির্যাতন–রাবণেরও ট্রাজেডি। লোক-বাঞ্ছিত পদ আর প্রতুল ঐশ্বর্য পেলেন না বলে তিনি ভাবলেন জীবন ব্যর্থ হল। উচ্চাভিলাষী, বিলাসপ্রিয়, ভোগলিলু, যশকামী, মানলোভী ও সুখপিপাসু মধুসূদন–গভীর আত্মবিশ্বাস ও অপরিমেয় সাহস থাকা সত্ত্বেও–ধন-যশ-মানের সাধনায় ব্যর্থ হলেন নিদারুণভাবে। তার অন্তরের ঐশ্বর্য ও মনীষা সম্বন্ধে যথাযথ মূল্যবোধ ও চেতনার অভাবে, কস্তুরী-সৌরভ মত্ত মৃগের মতো ছুটোছুটি করেই হয়রান হলেন।

এই বহির্মুখিতা এই বহিরার্জিত শক্তি-নির্ভরতা তাঁর সাহিত্যেও পাই। তার প্রধান চরিত্রের কেউ ত্যাগে সুন্দর নয়; বিভিন্ন ভাবে ভোগপ্রবণ। কৃষ্ণকুমারী নাটকের ভীম সিংহ শিশুর মতো সরল! পৌরুষ তাঁর একফোঁটাও নেই। কন্যার মৃত্যুর বিনিময়েও তিনি রাজ্যসুখ-ভোগ করতে চান। এ ব্যাপারে তার মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। বহির্শক্তির কবল থেকে ধনপ্রাণ বাঁচাবার কাপুরুষোচিত নির্বোধ উপায় খুঁজছেন ভীম সিংহ অথচ পুরুষোচিত গুণ ও আত্মমর্যাদাবোধের কণামাত্র তার মধ্যে উপস্থিত থাকলে সুকৌশলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দিয়ে কিংবা নিজে প্রবলপক্ষে যোগদান করে আসন্ন বিপদ এড়াতে পারতেন। তা না করে তিনি অনাথা নারীর মতো নিজ কন্যার মৃত্যুতেই বিপন্মুক্তি খুঁজেছেন। তিনি শত্ৰুশক্তির ভয়ে এমনি কাবু রইলেন যে নিজের শক্তি যাচাই করবার কথা তার মনে একবারও জাগল না। বাইরের আঘাত প্রতিহত করবার শক্তি পান না তিনি নিজের মধ্যে। অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেন শক্তির পায়ে। জয়-পরাজয় ও দৈব মর্জি নির্ভর। তিলোত্তমাসম্ভবে দেখি ব্রহ্মার হাতের ক্রীড়নক তিলোত্তমার রূপমুগ্ধ ভোগলিন্দু সুন্দ-উপসুন্দ মারামারি করেই মরে, দেব গোষ্ঠীর জয় হয়, কারো মনে চিত্তোঙ্খিত দ্বন্দ্ব-সংশয় দেখা দেয় না। আত্মিক বলে–মনোবলে কেউ বলী নয়। অন্তরের খোঁজ কেউ রাখে না। আত্মিক চেতনা সেখানে দুর্লক্ষ্য।

ব্রজাঙ্গনাও তেমনি তার বিরহবোধের উপাদান খুঁজছে প্রকৃতিতে–অন্তরে নয়। বীরাঙ্গনায়ও মহৎ আদর্শচেতনা নেই, প্রকৃতি চালিত ঋজু ও অসংকোচ বাসনার প্রকাশই অভিনন্দিত হয়েছে। ভোগলিন্দু কবির কাছে।

তাঁর মেঘনাদবধের ইন্দ্রজিতেও দেখি বাহুবলেরই দম্ভ। আমি স্বামীসোহাগিনী সতী–এই দম্ভই প্রমীলাকে মৃত্যুবরণে অনুপ্রাণিত করেছে–এ মধুর জীবন, এ সুন্দর পৃথবী ছেড়ে যাওয়ার বেদনা তাকে যেন বিচলিত করতে পারছে না। রাবণের চিত্তক্ষেত্রও দেখতে পাই নির্কিকার। সে প্রজ্ঞাবান কিংবা বিবেকবান নয়। তবু বহির্শক্তির ভরসায় সে আত্মতৃপ্ত, কৃতার্থনুন্য ও নিশ্চিন্ত। তার শক্তির উৎস ঐশ্বর্য ও আত্মীয়-পরিজনের বিশেষ করে মেঘনাদেরই বাহুবল। তাই এক এক আত্মীয়ের মৃত্যুতে সে বিচলিত হচ্ছে, দুর্বলতা তাকে গ্রাস করছে। কান্নায় সে ভেঙে পড়ছে, তবু আত্মবিশ্লেষণের নাম করে না, নিজের কাছে নিজেকে ধরা দেয় না। অর্জিত ঐশ্বর্য ও জনবল-নির্ভর দাম্ভিকতা কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল। রাবণও শিশুর মতো সরল, খেয়ালি ও বেপরওয়া। বাইরের থেকে আঘাত আসলে সে-আঘাত প্রতিরোধ করবার শক্তি পায় না সে অন্তরে। অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে আত্মপ্রবোধ পেতে চায় নিয়তির নির্যাতনের নামে।

বাঞ্ছহত বিড়ম্বিত মধুসূদনের মন প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর শেষ অসমাপ্ত রচনা মায়াকানন ও বিষ না ধনুগুণ নামের মধ্যেও।

মধুসূদনও এমনি উদ্ধত সুন্দর শিশু। মধুচরিত্রের মাধুর্য এখানেই, মধু-জীবনের ট্রাজেডির বীজও এতেই উপ্ত আর মধু-সাহিত্যের তত্ত্বও এতে নিহিত।

বঙ্কিম-মানস

০১.

আলোচনার সুবিধের জন্যে সাহিত্য-শিল্প সম্বন্ধে আমার স্কুল ধারণাটি প্রথমেই জানিয়ে রাখছি। মাটি থেকেই ঘাস জন্মায়, তাই বলে মাটি আর ঘাস এক জিনিস নয়। তেমনি কাঁচামাটি আর পোড়া ইট এক বস্তু নয়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তাদের জ্ঞাতিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব, হয়তো সহজও, কিন্তু সাহিত্য সে-রকম কোনো পদার্থ নয় যে তাকে কতগুলো উপাদানের সমষ্টি মাত্র বললেই তার স্বরূপ বোঝা যাবে। শব্দের মধ্যে পদের যে অর্থগত তফাৎ, অভিধানের শাব্দিক অর্থ আর কাব্যের চরণান্তৰ্গত পদের অভিধা যেমন ভিন্ন, তেমনি সাহিত্য আর সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে তফাৎ বিস্তর। এ কারণেই বিষয়বস্তুর উচ্চতা কিংবা তুচ্ছতা সাহিত্য-রসের পরিমাপক নয়। শিল্প বলতে যে-কথাটি আমরা বুঝতে ও বোঝাতে চাই তা বিশ্লেষণ-সাধ্য নয়। মাটি থেকে ঘাস হল, এ আমরা দেখলাম, কিন্তু কেমন করে হল তা বোঝানো যায় না। যে-কোনো লিখিত রচনাকেই যদি সাহিত্য বলে ধরা যায় তাহলে লেখাপড়া-জানা লোক মাত্রই লেখে এবং সব লেখাই সাহিত্য। কিন্তু সেসব রচনাকে সাহিত্য বলি না। সে কি কেবল বিষয়বস্তুর তুচ্ছতার জন্যে? তাহলে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির ঘরোয়া চিঠিপত্র পর্যন্ত সাহিত্য হল কী করে? আদিকালের সেই তত্ত্ব এবার স্মরণীয় শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্টত্যগ্রে আর নীরস তরুবরঃ পুরতো ভার্তি। অথবা একালের সোনার হাতে সোনার কাকন কে কার অলঙ্কার কিংবা তেলা মাথায় তেল–এগুলির যে-কোনো একটি শব্দ পাল্টালেই সব সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন কোনো মুখের ছবিতে একটি তিল এদিক-ওদিক করলেই মুখের আদলই যাবে বদলে। সাহিত্য-শিল্প তেমনি একটি অনুভব-সাধ্য ব্যপার। ওটি থাকে তো রসও রইল, শিল্পও রইল। আর যা শিল্প তা-ই রস এবং তা-ই সাহিত্য। শিল্প-রস, কিংবা সৌন্দর্য সবকিছুর মূলে রয়েছে মানবিক রস, ইংরেজিতে যাকে বলে Human interest- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ না থাকলে তা মানুষের পছন্দসই হতেই পারে না। আর যা তৃপ্তি দেবে না, চেতনায় ঘা দেবে না, তা সাহিত্য নয় নিশ্চয়ই। আবার অনেক সময় মানবিকতা থাকলেও যেমন মানবিক রস জন্মাতে পারে, তেমনি এর অভাব ঘটলেও মানবিক রসের অভাব হয় না। চিত্তের উল্লাসই শুধু কাম্য নয়, চিত্ত বিক্ষোভও উৎকৃষ্ট সাহিত্য-রস হতে পারে; যেমন করুণ, ভয়ঙ্কর, বীভৎসাদি রস।

কাব্যের সুষমা ও ব্যঞ্জনার যেমন তর্জমা হয় না, সাহিত্য-শিল্পও তেমনি ব্যাখ্যান্তৰ্গত নয়। সংস্কার বশে আমরা সাহিত্যের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিচ্ছবি পেতে চাই বটে, কিন্তু তা সাহিত্যসৃষ্টির বা পাঠের মূল লক্ষ্য নয়। তার প্রমাণ আমরা কাজের কথা কেজো করে না বলে প্রত্যক্ষকে পরোক্ষ করে, ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে ও রসিয়ে বলি। সৌন্দর্য আমাদের প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক জীবনে কাজে আসে না। সাহিত্য সৃষ্টির ও পাঠের পেছনেও কোনো প্রয়োজনের প্রেরণা থাকতে পারে না। আমাদের দেশে তাই সাহিত্যও একটি কলা এবং নন্দনতত্ত্বের অন্তর্গত। কিন্তু আমরা তো কেবল সৌন্দর্যচর্চায় বাঁচিনে। আমাদের রয়েছে জীবন, সমাজ ও ধর্ম। তাই আমাদের বিষয়বুদ্ধি সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রয়োজনকেও পেতে চায়। কেননা সৌন্দর্য-পিপাসা অল্পেতে এবং ক্ষণিকে মেটে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনবোধের শেষ নেই। এ কারণেই পুরোনো সাহিত্যে আমরা সৌন্দর্যের সাথে নৈতিক বা ধার্মিক আদর্শের প্রতিফলনও কামনা করেছি। ন্যায়ের জয় ও অন্যায় বা অধর্মের ক্ষয় দেখবার আগ্রহই প্রধানত পাঠক বা শ্রোতাকে সাহিত্যরসিক করে তুলত। এ-যুগের পাঠক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আদর্শ খোঁজে। আমরা ভুলে যাই যে এ Utility হচ্ছে আনুষঙ্গিক তথা by product. তাই এর উপরই সব গুরুত্ব দিলে সাহিত্য-শিল্প গৌণ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কাঞ্চন ফেলে আঁচলে গেরো দেয়ার বিড়ম্বনাই ভোগ করতে হয়। আজ পাঠক ও সমালোচক সাহিত্যে সেই বিড়ম্বনা-জালই বিস্তার করছেন। তাই কথায় কথায় পশ্চাৎমুখিতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং প্রগতিবাদিতা সাড়ম্বরে উচ্চারিত হয়। এই বিড়ম্বনার খপ্পরে পড়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। এর কিছুটা তার আত্মকৃত পাপ।

.

০২.

বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন য়ুরোপীয় জীবন-মহিমায় মুগ্ধ। কিন্তু তিনি সম্বিৎ হারাননি। তাই তিনি জীবনের সাধনা ও আবাহন করেছেন জীবনব্যাপী নিজের জন্যে নয়-বাঙালি হিন্দুর জন্যে। (বঙ্কিমচন্দ্রের মানস-গঠন যুগে বৃটিশ-ভারত গড়ে উঠেনি, তাই বঙ্কিমে ভারতীয় জাতীয়তা নেই; আছে বাঙালি হিন্দু-জাতীয়তা।বঙ্কিমের স্বদেশও ভারত নয়, বাঙলা দেশ)। কিন্তু অভিমানী, তীক্ষ্ণ আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও অতিমাত্রায় স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে য়ুরোপের এ মহিমা প্রকাশ্যে স্বীকার করায় কিংবা বরণ করায় বাধা ছিল; সে-বাধা জাতীয় মর্যাদার অভিমানপ্রসূত। তাই তিনি খিড়ফিপথেই য়ুরোপের অবদান অঞ্জলিভরে গ্রহণ করলেন। বলা চলে, রৌদ্রশ্রান্ত লোকের মতো পরম তৃপ্তিতে অবগাহন করলেন। তাই শাড়ি-সিঁদুর পরা মেমসাহেবই তার আদর্শ নারী। তেমনি মর্যাদায়, সাহসে ও পৌরুষে দৃপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ানই তার আদর্শ পুরুষ। সেজন্যে বহুপত্নী ও উপপত্নীর দেশে ভ্রমর, সূর্যমুখী, মতিবিবি চরিত্র সম্ভব হল। মাতৃঘটিত কলঙ্কের জন্যে যে-নারীকে স্বামীঘর ছাড়তে হয়, সে প্রফুল্ল পরপুরুষের সঙ্গে দেশময় ঘুরে বেড়ানোর পর স্বামীগৃহে আদর্শ বধূরূপে বরণডালা পায়। যে জাতিদ্রোহী রাজপুতেরা মুঘলের কাছে আত্মবিক্রয় করেছিল, সে রাজপুতের স্বাজাত্যবোধে ও স্বদেশপ্রেমে এত মহিমা আরোপিত হল। তাঁর প্রথম নায়ক জগৎসিংহ মানসিংহের সন্তান।

অনুকরণের অপবাদ সহজে কেউই গ্রহণ করতে চায় না। বঙ্কিমচন্দ্র অতিমাত্রায় এই দুর্বলতায় ভুগতেন। তাই তিনি অন্তরে যত য়ুরোপমুখী, বাইরে তার বিরূপতাও তত অধিক। এমন অবস্থায় সাধারণত দু-কূল রক্ষা করা যায় না। বুদ্ধিমানের চোখে বঙ্কিমচন্দ্রের এই দুর্বলতা ঢাকা রইল না। তাঁর কৃষ্ণ উনিশ-শতকী আদর্শ রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রভাবজ সৃষ্টি। তাঁর সাম্যবাদে দু-কূল রক্ষার অপচেষ্টা প্রকট এবং তার ধর্মতত্ত্ব পাশ্চাত্য Rationalism-এর অপপ্রয়োগে দুষ্ট।

যে উপকৃত হতে চায় অথচ কৃতজ্ঞ হতে চায় না, সে আর যাই হোক নৈতিক বলে বলী নয়; তার চরিত্র দ্বিধামুক্ত হতে পারে না, এবং তার আচরণ ও কর্ম সহজ ও ঋজু হয় না। এজন্যে বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তায় প্রত্যয়দৃঢ়তা ও উদারবিস্তার নেই; অসামঞ্জস্য আছে অনেক। তিনি খিড়ফি দোর দিয়ে য়ুরোপের প্রসাদ লুট করতে চাইলেন, কিন্তু সদর দরজা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কিছু গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। ফল দাঁড়াল এই যে, শেষ বয়সে যখন তিনি আগের মতো স্থিতধী রইলেন না, তখন আন্তরিক উত্তেজনায় য়ুরোপের সাহিত্য-দর্শন ও সভ্যতার প্রতিই যে কেবল অবজ্ঞা দেখালেন, তা নয়, হিন্দুয়ানীর মহিমা প্রচার না করে উপন্যাস লিখে সময় নষ্ট করেছেন বলে আফসোসও করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ বয়সের এই উগ্রতা ও একগুয়েমি তার স্থায়ী কলঙ্ক।

এই একই কারণে তিনি নিজে প্রগতিবাদী ও জাতিগত-প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় উন্নয়নমূলক কোনে কাজে বা আন্দোলনে তাঁর সমর্থন ও সহযোগিতা মেলেনি বরং বিরূপতা দেখিয়ে নিজের ওজন হালকা করেছেন। এসব কাজ বা আন্দোলন মন্দ বলে যে তিনি দূরে সরে ছিলেন তা নয়, আসলে তাঁর অদ্ভুত অভিমান ও স্বাতন্ত্র্য-প্রীতিই তাঁকে অসামাজিক ও উৎকেন্দ্রিক করে রেখেছিল। এই উৎকেন্দ্রিকতা বজায় রাখার দায়ে পড়েই তাকে কৃত্রিম অনুদারতা ও রক্ষণশীলতার অভিনয় করতে হয়েছিল। কেননা বঙ্কিমচন্দ্র কমকের কথায়, ভাষার ব্যাপারে কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য প্রভৃতি বিবিধ রচনায় ও প্রবন্ধে উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। এই মনস্তান্ত্রিক জেদের প্রতিকার তাঁর মতো প্রতিভা ও মনস্বীও হাতে ছিল না; বিস্ময় এখানেই এবং এ কারণেই। সমকালীন কৃতী পুরুষদের সঙ্গেও তিনি তেমন সৌহার্দ্য স্থাপন করতে পারেননি তাঁর এই আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের জন্যেই। খুব কম লোকের সঙ্গেই তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল।

বঙ্কিমচন্দ্র যা-কিছু লিখেছেন তা কেবল হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর উন্নতির জন্যেই। এমন যে রোমান্টিক রচনা কপালকুণ্ডলা, তাতেও মতিবিবির মাধ্যমে হিন্দুয়ানীকেই (হিন্দুসতীর পতিপ্রাণতাকে) মহিমান্বিত করেছেন। যে বঙ্কিমচন্দ্রের দিনের সাধনা ও রাত্রির স্বপ্ন ছিল ধর্মে, সমাজে ও রাষ্ট্রে হিন্দুকে আদর্শ মানুষ ও জাতি হিসেবে দাঁড় করানো, তার এ ধরনের প্রচেষ্টার আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

বঙ্কিমচন্দ্র নিজে সাহিত্যে একমাত্র utility-বাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সাহিত্যের সেই বিচারে যদি আজ তিনি ঘায়েল হন, তবে কর্মদোষে আস্থা রাখা ছাড়া উপায় কী? বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গাঁয়ের বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন সেকালের হুগলী কলেজে। তাঁর মানস গড়ে উঠেছিল বই পড়ে আর গাঁয়ের পুরোনো ধরনের পরিবেশে। কাজেই কলকাতা শহরের মুক্তবুদ্ধি শিক্ষিত তরুণের মনের স্পর্শ তিনি পাননি। তাঁর অহেতুক ও নিরর্থক অভিমান জিইয়ে রাখার অবাঞ্ছিত সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন এভাবেই।

এসব সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র এযাবৎ শ্রদ্ধার আসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই আসীন রয়েছেন। উনিশ তকে এ শ্রদ্ধা তিনি পেয়েছিলেন অসামান্য শিল্পী ও রোমান্স-রচয়িতা হিসেবে। তিনি লেখক তথা শিল্পী হিসেবে ছিলেন উনিশ শতকের বাঙলার বিস্ময়। আর বিশ শতকের গোড়ার দিককার বিপ্লবীদের (অরবিন্দ ঘোষ প্রভৃতির) বদৌলতে আনন্দমঠ, রাজসিংহ, সীতারাম প্রভৃতির জন্যে তিনি হলেন ঋষি। এ পর্যায়ে তাকে আর শিল্পী কিংবা সমাজবেত্তা হিসেবে যাচাই করবার অবকাশ বা প্রবৃত্তি কারুরই রইল না। তিনি হিন্দুজাতীয়তা ও স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রদ্রষ্টা ও উদ্গাতা ঋষিরূপেই কেবল পূজা পেতে থাকলেন। [ অথচ তখনই স্বাধীনতা চাওয়া অনুচিত- এটাই ছিল উপন্যাসগুলোতে বঙ্কিমের প্রতিপাদ্য। তখন য়ুরোপীয় আদলে শিক্ষিত ও উদ্যোগী মানুষ তৈরি করাই তার লক্ষ্য।

আজ স্বাধীনতা-উত্তর যুগে যখন সে প্রয়োজন মিটে গেছে, তখন বঙ্কিমের মন-মনন ও লেখা নিয়ে সমালোচনা–বিজ্ঞানসম্মত চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ চলবে। এ ধোপে utility-বাদী সমালোচকের দৃষ্টিতে বঙ্কিম জাতির শিরোমণিও হতে পারেন, আবার শিল্পী ও মনীষীকুলকলঙ্ক বলে নিন্দিতও হতে পারেন, দুই সম্ভব। আমার ধারণা, হবেনও তাই। কিন্তু কেবল শিল্পী হিসেবে যেসব সমালোচক তার যোগ্যতা যাচাই করবেন, সেসব রসগ্রাহী পাঠক-সমালোচকের বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তলোকে তার মর্যাদার আসন অক্ষয় হয়ে থাকবে। এ শ্রেণীর লোকের কাছে বঙ্কিম কী বলেছেন তা বড় নয়, কেমন করে বলেছেন তা-ই দ্রষ্টব্য।

উনিশ শতকী শূন্যতায় বঙ্কিমের আবির্ভাব ও সৃষ্টি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। মধুসূদনও প্রতিভা কিন্তু তার প্রভাব ছিল সীমিত। আমরা যদি প্রত্যেক মানুষের স্বভাবের ও মননের বৈচিত্র্য স্বীকার করে নিই, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবাদর্শের জন্যে তাকে মোটেই দোষ দেয়া যায় না। আমাদের পছন্দসই হল না বলে তা মন্দ হতে পারে না।

কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আমাদের ক্ষোভ এই যে তাঁকে আমরা যুগন্ধর ও যুগোত্তর প্রতিভা বলে জানতাম। এতকাল পরে যখন তার সম্বন্ধে আচ্ছন্নভাব কেটে গেছে, তখন দেখতে পাচ্ছি–তাঁর অপূর্ণতা এবং প্রতিভাসুলভ মৌলিকগুণের অভাব। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক, পেয়েছি তার চাইতে কম, তাই এত ক্ষোভ।

তিনি উনিশ শতকের শেষার্ধের লোক হয়েও এবং তাঁর সমকালের য়ুরোপীয় নাস্তিক্য দর্শন, সংশয়বাদ, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রদর্শন, সমাজ প্রভৃতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান এবং ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, মার্কস ও ডারুইন মতবাদের সঙ্গে পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তিনি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় হিন্দু-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর ধারণায় হিন্দু রাজত্ব হলেই হিন্দুজাতির প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙলাদেশে উনিশ শতকের শেষার্ধেও হিন্দু রাজত্ব ছিল দিবাস্বপ্ন মাত্র। যে য়ুরোপ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেখানে যে গণতন্ত্রের বীজ সর্বত্র উপ্ত হচ্ছে এই উচ্চাভিলাষী মনীষীর তা নজরে পড়ল না। কেবল শাসনে নয়, শিক্ষা ও ধনাগম সংস্থাতেই যে তথা অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপরই যে এ-যুগের উন্নতির বীজ নিহিত একালের রাষ্ট্রসংস্থার ভিত্তি রচিত, তা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের উপলব্ধির বাইরে। তিনি হিন্দুর বাহুবল ও চরিত্রবলের ধ্যান করতেন। জ্ঞানবল ও ধনবল তাঁর চিন্তায় গুরুত্ব পায়নি; অথচ এ-যুগে শক্তির উৎস হচ্ছে এ দুটোই। বাঙলাদেশে মুসলমানকে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দুর স্বাধীনতা-বাঞ্ছ যে পূর্ণ হবার নয়– এ বাস্তব বুদ্ধি তাঁর কাছে প্রশ্রয় পায়নি। ফলে তাঁর সাধনা আপাত সফল হলেও পরিণামে ব্যর্থ হল।

হিন্দু-মুসলমান কি কোনোকালে একজাতি ছিল যে বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া যাবে? বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বিজাতি-বিদ্বেষী। সাধারণভাবে বিচার করলে এতে অন্যায়-অস্বাভাবিকতা কিছুই পাওয়া যাবে না। কেননা বঙ্কিম যে-মুসলমানকে গাল দিয়েছেন, তারা তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠী। যে বিদেশী বিজাতি ও বিধর্মী এদেশে চেপে বসল আর দেশবাসীর স্বাধীনতা ও সম্পদ কেড়ে নিল, তাদের প্রতি বিরূপ থাকাই তো স্বাভাবিক ও শোভন। সহজাত এই বিরূপতা দেশী মুসলমানের গায়েও লাগল, কেননা ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে এবং আভিজাত্যবোধে দেশী মুসলমানেরাও নিজেদের তুর্কী-মুঘলের জ্ঞাতি ভাবতে শিখেছে। যেমন দেশী খ্রীস্টানরা স্বজাতি ভেবেছে ইংরেজকে। শাসক-শাসিতের পূর্বসম্পর্ক স্মরণ করে উনিশ শতকের হিন্দু লেখকমাত্রই মুসলমানদের প্রতি কমবেশী বিরূপতা দেখিয়েছেন। সে-বিরূপতা বিদ্বেষ ও বিদ্রূপ-রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি মধুসূদনের মতো সংস্কারমুক্ত প্রতিভাও এ দোষ থেকে মুক্ত নন। তার প্রহসনে মিয়াজান ও কৃষ্ণকুমারী নাটকে যবন–অপহৃতা পদ্মিনী প্রসঙ্গ স্মত। তবু অন্যদের কথা আলোচ্য নয় এজন্যে যে তাঁরা কেউ প্রভাবশালী ছিলেন না। কিন্তু বঙ্কিম যুগস্রষ্টা প্রতিভা বলে স্বীকৃত। কাজেই তাদের পক্ষে এ অনুদার ও অবিজ্ঞজনোচিত মনোভাব দুষণীয়। শাসক-শাসিতের পূর্ব সম্পর্ক যা-ই থাক না কেন, ইংরেজ-শাসনে যখন হিন্দু-মুসলমানের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা, তখন দূরদর্শী জাতিপ্রাণ মনীষীর কর্তব্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের সংহতি সাধনা করা। বঙ্কিমের মনন-দৈন্য এখানে যে, তিনি প্রয়োজন-সচেতন ছিলেন না। একচক্ষু হরিণের মতো তিনি হিন্দু-জাগরণের চারণ কবি ব্রতকেই বড় মনে করেছেন, দেশের সামগ্রিক স্বার্থের দিকে নজর রাখেননি। তাই তিনি হিন্দুর ঋষি হলেন বটে, কিন্তু দেশের চিন্তানায়কের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রইলেন।

আত্যন্তিক আত্মরতি পরপ্রীতির পরিপন্থী। বঙ্কিম স্বজাতিকে বড় ভালোবাসতেন। তাঁর চিন্তা, ধ্যানধারণা সবই একান্তভাবে হিন্দুর জন্যে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোনো নীতি-উপদেশে মানুষকে সহজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না-বরং প্রতিহিংসা বৃত্তি উসকিয়ে দিলে সহজেই উত্তেজনা সৃষ্টি করা সম্ভব। তিনি বাস্তবে করলেনও তাই। যেহেতু ইংরেজ শাসক, সেহেতু ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিহিংসা-বৃত্তি জাগিয়ে তুললে সমূহ বিপদ। তাই তিনি হিন্দুদের মনে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির জন্যে পুরাতন দুশমন (বর্তমানে মৃত হলেও) মুসলমানদের বিরুদ্ধে (আসলে তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠীই লক্ষ্য) হিন্দুদের উত্তেজিত করে তুললেন–নানা সত্য ও কাল্পনিক অত্যাচারের ও অমানুষিকতার চিত্র তুলে ধরে। হিন্দু উত্তেজিত হল। বলা চলে হিন্দুমনে মুসলিম বিদ্বেষের সাথে সাথে স্বাজাত্য ও স্বদেশপ্রেম জাগল–হিন্দু জাতি গড়ে উঠল, কিন্তু ভাঙল মুসলমানের মন। ক্ষুব্ধ হল শিক্ষিত মুসলমান। [মুসলমান-এর পরিবর্তে তুর্কী কিংবা মুঘল শব্দ ব্যবহার করলে কোনো বিদ্বেষ-তিক্ততাই হয়তো সৃষ্টি হত না।]

মুসলমান ছিল এদেশে শাসক জাতি। তাদের উত্তম্মন্যতা শাসিতের প্রতি হয়তো অবজ্ঞার সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু বিদ্বেষ তাদের ছিল না। তাই ইংরেজ যখন তাদের শাসন-ক্ষমতা কেড়ে নিল, তখন ইংরেজকে তাড়াবার জন্যে তারা নিজেরা সগ্রাম করল এবং হিন্দুদের সহযোগিতাও করল কামনা। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যই তাদের প্রধান কাম্য ছিল; এবং ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দ অবধি মুসলমানগণ হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্যের ভিত্তিতে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামী মনোভাব বজায় রেখেছিল। এরপরে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমানরা ব্রিটিশের প্রতি সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। অবশ্য এরপরও যারা ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজ-বিরোধী হয়ে রইলেন, তাঁরাই পরবর্তীকালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক জাতীয়তা গড়ে তুলবার সাধনা করেন। ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চলে এ সাধনা সাফল্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাঙলাদেশে মুসলমানেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের হাতে পীড়িত হচ্ছিল বলে বঙ্কিমকেই হিন্দুমানসের প্রতীক ধরে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল ১৯৩৭ সাল থেকে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বাঙলায় নয়, বঙ্কিম সাহিত্য প্রভাবিত বাঙলাতেই অখণ্ড জাতীয়তায় ফাটল ধরল এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাঙলাদেশে মুসলিমলীগের ভিত্তি দৃঢ় মূল হল। এরপর এল দাঙ্গা, এল আজাদী। পাকিস্তান কায়েম হল। আমাদের ধারণা প্রতিভামাত্রই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, স্থিতধী ও বাস্তব সমস্যা-সচেতন। কিন্তু এ তৌলে বঙ্কিম টেকেন না।

.

০৩.

এবার বঙ্কিমচন্দ্রকে আদর্শবান শিল্পী ও উদ্দেশ্যমূলক রোমান্টিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে বিচার করা যাক। এজন্যে কিছু ভূমিকার দরকার।

শহর কলকাতা গড়ে ওঠে পালিয়ে আসা লোক নিয়ে। জব চার্নক থেকে শুরু করে হিন্দু মুসলমান সবাই এল এভাবেই। কেউ এল আত্মরক্ষার জন্যে, কেউ এল আত্মগোপনের জন্যে আর বেশির ভাগ এল আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রসারের উদ্দেশ্যে। কাজেই দেশ ও সমাজ থেকে বিচ্যুত জনসমষ্টি নিয়ে গড়ে উঠল নতুন বন্দর কলকাতা। এসব লোকের কিছুটা অনন্যতা স্বীকার করতে হয়; তাদের উচ্চাভিলাষ, অধ্যবসায়, বিপদের ঝুঁকি নেবার সাহস, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি নিশ্চয়ই ছিল। ইংরেজ বেনের বানিয়ান হয়ে ওরা নিজেদের ভাগ্য তৈরি করতে থাকে। তারপর পলাশীর যুদ্ধের পর যখন শাসক-শাসিতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে ও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে পাশ্চাত্য মন-মনন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হল, তখন তাদের মানস-দৈন্য ও ঘরোয়া দীনতা তাদের মনে তীব্র গ্লানিবোধ জাগাল। য়ুরোপীয় রেনেসাঁস প্রসূত Rationalism যে-স্বরূপে সেদেশে প্রকাশ পেল, তা সেদেশেরই ধর্মে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও ব্যক্তিজীবনে বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তন এনেছিল। নবলব্ধ বিজ্ঞানবুদ্ধির আলোকে তারা পুরোনো বিশ্বাস ও সংস্কারের সঙ্গে পুরাতন সমাজ, ধর্ম, আর ব্যক্তি-জীবন-ধারণাকেও পাল্টাল। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে এই নতুন মূল্যবোধের ফলে সেদেশের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারীর মর্যাদা, স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, মানবতা, যুক্তিবাদ প্রভৃতি বিশেষ গুরুত্ব পেল। যার ফলে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, সমাজজীবনে সংস্কারমুক্তি, ধর্মে আচার শৈথিল্য, ব্যক্তিজীবনে ন্যায়নিষ্ঠা ও বন্ধনমুক্তি, মুখে মানবপ্রীতি, মন-মননে দ্বন্দ্ব অত্যধিক বিজ্ঞানানুগত্য, যুক্তিবাদে আস্থা প্রভৃতি শিক্ষা, সুরুচি ও আভিজাত্য প্রকাশের কৃত্রিম-অকৃত্রিম অবলম্বন হল। বিজ্ঞানভিত্তিক নাস্তিক্য ও সংশয়বাদই এ-যুগের দর্শনের মূল আলোচ্য।

ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের মাধ্যমে কলকাতার শিক্ষিতজনেরা য়ুরোপের এই মানস-সম্পদ লাভ করে আশায়-উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়ে উঠল। তাদের নিস্তরঙ্গ নিশ্চিন্ত জীবনে যে বিচলন এল, অনভ্যস্ত চোখে হঠাৎ যে-আলো ঝলসিয়ে উঠল, তাতে টাল সামলানো সম্ভব ছিল না। রাজা রামমোহন রায় থেকে এজুরা পর্যন্ত সবাই তাই বেশ কিছুকাল উত্তেজনায় অস্থিরচিত্তে ছুটোছুটি করেছেন। সবারই মনের কথা, বদলাও–পাল্টাও, নতুন কিছু করো। এর তাৎপর্য ও স্বরূপটি বুঝে নিতে হবে। গরিব যখন অপ্রত্যাশিতভাবে ধনী হয়, কিংবা কোনো ভুঁইফোড় ব্যক্তি শিক্ষিত হয়ে বড় চাকুরে হয়, তখন সে তার জীবনের মান উন্নয়নের জন্যে বড় ব্যস্ত হয়ে ওঠে! রুচি পালটিয়ে রাতারাতি সংস্কৃতিবান হয়ে অভিজাতশ্রেণীর একজন হবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। গত শতকের কলকাতার শিক্ষিত-মনেও পাশ্চাত্য প্রভাবে এমনি আকুলতা জেগেছিল পাশ্চাত্য আদর্শে জীবনযাপনের জন্যে এবং পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলবার আগ্রহে! তাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের পরিবার ও সমাজ। গোটা জাতির কথা কেউ ভাবেনি। বিশেষ করে তা তখনি সম্ভব বলে কল্পনা করাও ছিল দুঃসাধ্য। তাই রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণ প্রমুখ সবাই যা-কিছু করেছেন তা কলকাতার ভেতরেই। এ হচ্ছে কলকাতার হঠাৎ-জাগা ধনী ও ভূঁইফোড় ইংরেজিশিক্ষিতদের পরিবার ও সমাজ গড়ে তোলার আন্দোলন। এ যুগে শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন গোটা জাতির উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হতে পারে এবং হয়ও। তার কারণ মফস্বলের লোকেরাও শিক্ষিত এবং খবরের কাগজ ও বইপত্রের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের বাহ্য ও মানস-দূরত্ব ঘুচে গেছে। কিন্তু উনিশ শতকী আন্দোলনের এ ব্যাখ্যা চলতে পারে না। তাদের অবচেতন মনে গোটাজাতির চিন্তা যদি থাকেও তা ছিল একান্তভাবে পরোক্ষ, আকস্মিক এবং অপ্রধান। সুতরাং আমাদের উনিশ শতকী রেনেসাস ছিল একান্তই আত্মকেন্দ্রিক এবং সংকীর্ণ চেতনার প্রসূতি। তখনো তার হিন্দু চেতনার উর্ধ্বে উত্তীর্ণ হয়ে বাঙালি জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেনি। তাই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণের কর্ম ও চিন্তার মধ্যে সংখ্যাগুরু মুসলমানকে পাইনে।

এ সময়কার হিন্দু, মুসলমান ও ইংরেজ–এই ত্রৈকোণ সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণেও মূল্যবান তত্ত্ব পাওয়া যাবে। একটা দৃষ্টান্ত নিলে এ সম্পর্কের স্বরূপটি ধরা সহজ হবে। ১৯৪২ সনে চক্রবর্তী রাজাগোপাল আচারিয়া পাকিস্তান-দাবীকে মেনে নেয়ার ও জাপানির সাহায্যে ইংরেজ তাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অথচ এ দুটোর একটাও কংগ্রেসের আদর্শ ও লক্ষ্যানুগ ছিল না। ব্রিটিশের প্রতি বিরাগ ও আজাদী-বাঞ্ছার তীব্রতাই রাজা গোপালকে এমনি আদর্শবিরোধী ভাবনায় প্রেরণা যুগিয়েছিল।

অনুরূপভাবে সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলমান শাসনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা ও বিদ্বেষ হিন্দুকে মুসলমানবিরোধী ও অসহিষ্ণু করে তুলেছিল। অন্তরে আজাদী লাভের বাসনা থাকলেও বাস্তবে তা তাদেরকে সংগ্রামী করে তুলবার মতো তীব্র ছিল না। তাই লাঞ্ছিত চাকুরের মনিব বদলের স্বস্তি ও আনন্দই তারা পেতে চেয়েছিল। শাসনদণ্ড মুসলমানের থেকে ব্রিটিশের হাতে যাওয়ায় তারা এই স্বস্তি ও আনন্দই লাভ করেছিল। উনিশ শতকের হিন্দু বাঙালির উল্লাস এই মনোভাবেরই ফল এবং স্বাক্ষর। পুরোনো মনিব মুসলমান যখন ব্রিটিশ-বিরূপতায় মনে, ধনে ও মানে খর্ব হচ্ছিল, তখন হিন্দুমনের পুরোনো বিদ্বেষ-বিদ্রূপ, বিরূপতা ও অবজ্ঞারূপে প্রকাশ পেতে থাকে। এর অনপনেয় সাক্ষ্য বহন করছে উনিশ শতকের হিন্দুর রচনা। শত্রুর দুর্ভোগে বিদ্বিষ্ট মনে যে উল্লাস জাগে তারই আভাস পাই উনিশ শতকের হিন্দুর বচনে ও আচরণে। এ সূত্রে সিপাহি বিপ্লবকালে তৃপ্তমন্য বাঙালি হিন্দুর ভূমিকাও স্মর্তব্য।

মুসলমানেরা ছিল শাসকের জাতি। প্রজা হিন্দুর প্রতি তাদের বিদ্বেষ থাকার কথা নয়, বরং থাকতে পারত তাদের উত্তম্মন্যতাজাত অবজ্ঞা। অবজ্ঞা অনুকম্পা ও তাচ্ছিল্য জাগায়, বিদ্বেষ ও বিরূপতার রূপ নেয় না কখনো। কাজেই ইংরেজ যখন তাদের হাত থেকে রাজ্য কেড়ে নিল, তখন তারা ব্রিটিশের সঙ্গে সংগ্রামে হিন্দুর সহযোগিতা কামনা করেছিল। এইজন্যে উনিশ শতকের মুসলিম-মানসে হিন্দু-বিদ্বেষ ছিল না বরং প্রয়াস ছিল হিন্দুকে কাছে টানবার। কংগ্রেস-পূর্ব যুগের এবং কংগ্রেসের সগ্রামকালীন ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য স্যার সৈয়দ আহমদ হিন্দুর ব্রিটিশ-প্রীতি ও সহযোগিতার আত্যন্তিকতা দেখে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পরিণাম চিন্তা করে ব্রিটিশের প্রতি মুসলমান সমাজেও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে তৎপর হন। এই প্রচেষ্টা অবশ্য সৈয়দ আহমদ, আমীর আলী, আমীর হোসেন, আবদুল লতিফ, সলিমুল্লাহ, আগাখান প্রমুখ একশ্রেণীর ইংরেজিশিক্ষিত লোকের প্রয়াস; এবং মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান এঁদের মানস-সন্তান। অন্যান্য শিক্ষিত মুসলমানরা (বিশেষ করে মৌলবীরা) ১৯৩৭ সাল অবধি জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন।

অবশ্য এর মধ্যে আরো একটি মানস-ধারা ছিল। একদিকে ছিল শিক্ষায় ও ধনে দ্রুত পতনশীল মুসলমান অভিজাতশ্রেণী, অপরদিকে ছিল দ্রুত বর্ধিষ্ণু হিন্দু শিক্ষিত ও ধনী সম্প্রদায়। . উভয়ের মধ্যে ছিল পারস্পরিক অশ্রদ্ধা। ঐতিহ্যগৰী দাম্ভিক অভিজাতরা নতুন গজিয়ে ওঠা সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো রকমেই শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠতে পারছে না। আবার বিদ্যা, পদমর্যাদা এবং ধনগর্ব নতুনদেরও উদ্ধত করে তুলছে। এই মানসদ্বন্দ্ব ও তার পরিণতি মূলত তারাশঙ্করের জলসাঘর কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী বা তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতনের মতো। কেবল তফাৎ এই, নতুন-পুরাতনের এই দ্বন্দ্বের আকস্মিক ভিত্তি হল হিন্দু ও মুসলমান। দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগের উৎসও হল তাই এই দ্বন্দ্ব–যা বিশ শতকের প্রথমার্ধ ব্যাপী জাতিবৈর বা সাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানির কারণ হয়ে রইল।

ব্রিটিশ মুসলমানের হাত থেকেই রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল, তাই তাদের মুসলমান-ভীতি তাদেরকে করেছিল মুসলমানের প্রতি বিরূপ ও আস্থাহীন। অন্যদিকে এদেশে তাদের শাসন স্থায়ী করার জন্যে তারা Devide and rule নীতি গ্রহণ করল। ফলে হিন্দু তোষণ ও পোষণ এবং মুসলমান শোষণ ও দলনই হল তাদের লক্ষ্য–যা প্রায় গোটা উনিশ শতক ধরে চলেছে। পরে উনিশ শতকের শেষপাদে ও বিশ শতকে ব্রিটিশ-কৃপায় পাওয়ার তেমন কিছু ছিল না। তখন হিন্দু মনেও জাগল স্বাধীনতার স্পৃহা ও ব্রিটিশ-বিরূপতা। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশের নীতিও পরিবর্তিত হয়ে মুসলমান তোষণ এবং হিন্দু দলন শুরু হল।

এমনি পরিবেশে উনিশ শতকে বাঙালি হিন্দুর ধন, বিদ্যা ও পদমর্যাদা অর্জিত হয়েছিল। আর আগেই বলেছি পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও জীবনরীতির সংস্পর্শে এসে বাঙালি হিন্দুর যে- জাগরণ এল, যাকে রিনেসাঁস বলে চিহ্নিত করা হয়, তা কলকাতাবাসী ধনী ও শিক্ষিতের ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনের মানোন্নয়ন প্রয়াসে- আত্মোন্নয়ন লক্ষ্যেই নিবদ্ধ ছিল। তাদের দৃষ্টি ছিল সাগরপারে, আর লক্ষ্য ছিল আত্মবিকাশ। গোটা দেশের কথা ভাববার সময় সুযোগ ও সম্ভাবনা তখনো দেখা দেয়নি। কাজেই এ রিনেসাঁস কেবল সংকীর্ণ অর্থেই সত্য। তাই একে দিয়ে গোটা দেশের কল্যাণে কোনো বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য সাধন ছিল অসম্ভব।

এমনি পরিবেশের সন্তান হচ্ছেন উনিশ শতকী মনীষীরা। বঙ্কিমচন্দ্রও তাই ব্যতিক্রম নন। অতএব বঙ্কিমের চিন্তায়, বচনে ও আচরণে কোনো অসঙ্গতি নেই। বরং বলতে গেলে তার মধ্যেই উনিশ শতকী মানসের স্বাভাবিক বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। সে হিসেবে বঙ্কিম যুগসৃষ্টি, যুগধর ও যুগ প্রতিভূ। এ-কথাটি যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুঁটিয়ে বুঝতে চাইনে বলেই বঙ্কিম আমাদের কারুর চোখে ঋষি আবার কারুর কাছে মুসলিম-বিদ্বেষী।

বাউল সাহিত্য

ইদানিং বাউল মত ও গান আমাদের চেতনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। কেবল তা-ই নয়, নানা কারণে এসব আমাদের ভাবিয়েও তুলছে। সম্প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টায় বিপুল সংখ্যক গান সংগৃহীত হয়েছে। সাড়ে তিনশ বছরে ধরে দেশের জনসমাজের এক অংশ এমনি নিষ্ঠার সঙ্গে যে জীবনচর্যার এ বিপুল আয়োজনে এতদূর এগিয়ে গেছে, সে-সম্পর্কে আমরা অবহিত ছিলাম না। লোকচক্ষুর অন্তরালে লোকান্তরে প্রসারিত জীবনবোধের পরিচয়বাহী এই কাকলিকুঞ্জে প্রবেশ করে, এই সুরসমুদ্রে অবগাহন করে বিস্ময় মানি। বাউলের অনুচ্চ কণ্ঠের লীলায়িত ভঙ্গিমার সুরপ্রবাহে মন ভাসিয়ে দিলে দূরলোকের উদাস-করা যে ধ্বনি চিত্তবীণায় ঝঙ্কার তোলে তা’ মন ও আত্মার গ্লানি মুছে দিলে অভিভূতির এক শান্ত-আবহ আনে। এক আনন্দ-সুন্দর জীবন-কল্পনায় চিত্তের ক্লিন্নতা ঘুচে যায়। মাটির মমতাকে তুচ্ছ জেনে উৎকণ্ঠ মন-বলাকা পাখা মেলে নতুন-পাওয়া দিগন্তহীন গগন পানে। বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তে ভাবছি, — এ নিয়ে আমরা কী করব! ভোগের পঙ্কে মজেও যখন মনে করছি অমৃতস্নান হচ্ছে, তখন আবেকওসরের উপযোগ-বুদ্ধি নিশ্চিতই হারিয়েছি।

দেশের প্রাকৃতজন যখন ফলপ্রসূ চাষে নিরত, তখন শিক্ষিতগণ নিষ্ফল উদ্যান রচনায় ব্যস্ত। মহৎ জীবনের যে-বীজ প্রাকৃত মনে উপ্ত ও পল্লবিত, এমনকি ফলন্তও, তখনো বিরূপ শিক্ষিত মন বিজ্ঞানবুদ্ধির জপবারি সিঞ্চনে চিত্তমরু শীতল করবার ব্যর্থ সাধনায় রত।
বাউলমত যদি আদ্যিকালের ইতিকথা হত তাহলে পরিহারযোগ্য ঐতিহ্য মনে করতাম। কিন্তু আজকের মানুষের এক অংশের জীবন-দর্শনের প্রতি এমনি উদাসীন থাকা দায়িত্ববোধের অভাবই জ্ঞাপন করবে। Materialism ও Spiritualism-এর দ্বন্দ্বে যখন দুনিয়ার মানুষের মন অস্থির ও অসুস্থ, যখন নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত, যখন পৃথিবীর কল্যাণকামী চিত্ত অবক্ষয়ের নিরূপ যন্ত্রণায় কাতর — মানস দ্বন্দ্বে বিক্ষত, মানুষ যখন স্বস্তির নিদান লাভের আগ্রহে উন্মুখ ও উৎকণ্ঠ, বিমূঢ় শিল্পী ও মনীষীরা যখন দিশাহারা; তখন এই আধ্যাত্মবাদ-নির্ভর নিশ্চিন্ত মনের অবিচল প্রসন্ন-প্রশান্তি আমাদের ভাবিয়ে তুলবেই। বস্তুবাদ (তথা ভোগবাদ কিংবা ঐহিত জীবনবাদ) ও আধ্যাত্মবাদের দ্বৈত্ব বোধে পুষ্ট দ্বান্দ্বিকবোধের টানাপড়েনে উত্ত্যক্ত ও বিকৃতিবুদ্ধি মানুষ আমরা। আমাদের কাছে বাউলের জীবনচর্যা অত্যন্ত অর্থবহ — জীবনের সুষ্ঠ মূল্যায়নের ইঙ্গিতবাহী এবং আজকের প্রতিবেশে জীবনাদর্শ নির্ণয়ের সহায়ক। বাউলগান আমাদের ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় জীবনের মূল রয়েছে গভীরে, গতি হচ্ছে অনন্তে আর সম্ভাবনা আছে বিপুল।

প্রখ্যাত বাউল কবি ও সাধক লালন শাহ্‌, পাগলা কানাই, শেখ মদন বাউল প্রমুভের নাম ও তাঁদের পদ শিক্ষিতসমাজে পরিচিত লাভ করেছে। সুফী মতবাদের লৌকিক আচারিক রূপ এঁদের পদরচনার ধারাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। অধ্যাত্ম ও মরমী চিন্তার ঐশ্বর্যের সঙ্গে সহজ কাব্যসৌন্দর্যমণ্ডিত মানবিক বোধই বাউল সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য।

আজ এখানে দুজন স্বল্প-পরিচিত বাউল কবি সম্বন্ধে আলোচনা করছি।

বাউল ফুলবাসউদ্দীন ও তাঁর সাগরেদ নসরুদ্দীন বা নসরুল্লাহ্‌র বিপুল সংখ্যক পদ পাওয়া গেছে। এজন্যে তাঁরা বিশেষ আলোচনার দাবীদার। এখনো হয়তো তাঁদের গান সংগ্রহের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে তাঁদের জনপ্রিয় পদগুলি সংগৃহীত হয়ে গেছে এমন ধারণা পোষণ করা হয়তো অযৌক্তিক নয়। কারণ, ভালো গানই জনপ্রিয় হয়, জনপ্রিয় গানই বেশি চালু থাকে আর সেগুলাই প্রথমে সংগ্রাহকের হাতে পড়ে।

ফুলবাসউদ্দীনের গুরু বিনোদ, শিষ্য নসরুদ্দীন। তিনজনই কবি ও সাধক। নসরুদ্দীন ওরফে নসরুল্লাহ্‌র পদে উল্লেখিত মরিয়ম (আত্মবোধন) ও নিসারুন (সাঁইতত্ত্ব) হয়তো তাঁর দুই সাধন-সঙ্গিনীর নাম। বাউলের সাধন-সঙ্গীনী প্রয়োজন। পরকীয়া হলেই ভালো। কিন্তু মুসলমান বাউল স্বকীয়া তথা স্ত্রীকেই সাধারণত সাধন-সঙ্গিনী করে। কাজেই মরিয়ম ও নিরারুন হয়তো নসরুদ্দীনের স্ত্রীই। মরিয়মও কবি। তাঁর আত্মবোধনমূলক একটি গান পাওয়া গেছে:

–“মাঝিকে আগে রাজি কর, সাঁতার দিলে প্রাণে বাঁচতে পার।”

বাউল কবিদের মধ্যে বহুল পরিচয়ের ফলে আমরা লালনকেই শ্রেষ্ঠ বলে জানি এবং মানি। কিন্তু অন্য অনেক কবিই যথার্থ তাত্ত্বিক ও সুকবির খ্যাতি ও মর্যাদা পাবার যোগ্য। ফুলবাস ও নসরকে এ-শ্রেণীর কবি বলেই মনে করি। জগৎ, জীবন ও স্রষ্টার যে-রহস্য উদঘাটনে আত্মার আকুলতা, আত্মনিমগ্ন ভাবে-বিভোর বাউলকবি সে-রহস্য-দ্বার উন্মোচনে অবিচল নিষ্ঠায় সদানিরত। পিঁপড়ের সমুদ্র-সাঁতারের আকাঙ্খার মতো ক্ষুদ্র মানুষের অসীমের সীমা খোঁজার এ প্রয়াসও চির-অসাফল্যে বিড়ম্বিত। অকূলে কূল পাবার আকুলতা প্রকাশেই এর সার্থকতা। কেননা, এতেই আত্মার আকুতি আনন্দময় প্রয়াসে নিঃশেষ হবার সুযোগ পায়। ইরানি কবির জবানীতে ‘জগৎ হচ্ছে একটি ছেঁড়া পুথি — এর আদি গেছে খোওয়া, অন্ত রয়েছে অলিখিত।’ কাজেই এর আদি-অন্তের রহস্য কোনোদিনই জানা যাবে না। তবু অবোধ মন বুঝ মানে না, তাই ঘরও নয়, গন্তব্যও নয়; পথ চলে, পথের দিশা খুঁজে, পথ বাড়ানোর খ্যাপামি একে পেয়ে বসে। এই মোহময়ী মরীচিকাই দিগন্তহীন আকাশচারিতার আনন্দে অভিভূত রাখে। জীবনে আকাঙ্খার এই প্রদীপ্ত আগেব, এই আনন্দিত অভিভূতিই যথালাভ।

বাউল এই খ্যাপামির শিকার। তাই তার অশান্ত চিত্তে জিজ্ঞাসার শেষ নেই, বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য প্রয়োগে সে নানাভাবে স্রষ্টার, সৃষ্টির ও জীবনের দিশা খোঁজে। সিএ আকুল জিজ্ঞাসার স্বাক্ষর হচ্ছে এক-একটি পদ। বাউল গানের প্রথম চরণেই এক-একটি মুহূর্তের এক-একটি ভাব-বুদবুদের সাক্ষ্য রয়েছে; কখন কোনো তত্ত্ব মনকে নাড়া দিচ্ছে, প্রাণে সাড়া জাগাচ্ছে তা ঐ প্রথম চরণ থেকেই আঁচ করা যায়।

ফুলবাসের মুখেও সে অনাদিকালের প্রশ্ন–‘তুমি আমার কে হও, শুনি?’ কিন্তু তিনি তো এ প্রশ্নের জবাব পান না। অন্যেরা কী পেয়েছে? তাই আবার তাদের কাছে জিজ্ঞাসা– ‘সাঁই-এর কী রূপ দেখে স্থির তোরা?’ দয়াল সাঁইও আবার ভক্তকে দেখার জন্যে উৎকণ্ঠ, তাই তিনি বলেন–

“একবার আয় দেখিরে, তোমায় নয়ন ভরে দেখি
তোমার মতন ভক্ত পেলে, আমি হৃদমন্দিরে রাখি।
আমি নিজ শক্তি তোমায় দিয়ে
থাকব তোমার অধীন হয়ে
আত্মা আত্মায় মিশায়ে হব আমি সুখী।”

কবির এমন উপলব্দি বেশিক্ষণ টেকে না। আকাশচারী দুরন্ত মন আবার মাটিতে নেমে আসে, জৈব-সমস্যার কথা ভাবে, তখন গোহারী জানায়:

দেখে তোমার কাজগুলা
যায় না কো সাঁই দয়াল বলা
তোমার দয়াল নামের এমনি গুণ,
পান্তা ভাতে মেলে না নুন;
কেউ খায় ঘৃত মাখন কার কান্ধে দেও ঝোলা,
কার নাহি জোটে খেটেখুটে,
পড়ে থাকে ছেঁড়া চটে,
দিবারাতি নানান কষ্টে, শোক-অনলে হয় কয়লা।
কেউ সুখ-সাগরে ডুব দিয়া রয়,
কারো কেঁদে কেঁদে জনম যায়,
ফুলবাস উদ্দীন ভাবে সদাই–কার নামে ‘জপি মালা!’

কোনো যুক্তি দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়েই আল্লাহ্‌কে লাভ করতে হবে। নিজের চিত্তের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করাই মানুষের ব্রত; কেননা আল্লাহ ‘যখন গড়েছিল আদম, এক চিজ রেখেছে কম — এই ভালোবাসার কাম।

আর,         'জপতপ, ভজন সাধন, সে ধন বিনে (ভালোবাসা) সব অকারণ
               আবার যদিও শুনি আলিফে লাম লুকায় যেমন, এই মানুষে সাঁই
                                                              আছে তেমন,
               জাতে আর সিফাতে খোদা, মিশে সদায়
এবং          'কুলুবেন মোমিন আরশ আল্লাতালা'
               কোরানেতে আছে খোলা,
               যেদিকে ফিরাই আঁখি, সেইদিকে তোমারে দেখি
               যেখানে ফুল সেখানে বাস, থাকে মিশামিশি,
               তবে কেন দেও না দেখা বল, করি কী উপায়।
               ...সাঁই-এর আজব লীলা আমার বুঝার সাধ্য নাই।
               আহাদে আমহদ হল মোহাম্মদে লুকাইল
               আদমরূপে প্রকাশ হল, তিনে হল এক বরণ।

কবি তাঁর মনের মধ্যে এর উত্তর খুঁজে পান:

সাঁই আমার আসমান জমিন, পবন-পানি কভু ছাড়া নয়।…
…..মোকামে আছে রব সাঁই আমি দেখিতে শুনিতে পাই,
সে যে ‘বাক্‌’-রূপেতে খেলছে সদায়
যে দেখেছে তাঁর প্রাণ জুড়ায়,
ছয় মোকামে ছয় লতিফাতে,
চার ঘণ্টা করিয়া তাতে
বিরাজ করেন সেই যে রব সাঁই
বেখুদী হবে যে জন সেই তো পাবে দরশন।

বাউল সাধনায় পরম গুরু হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্‌। যেমন:

আমি ডাকি তোমায় বারংবার
এসে আমায় দেও গো দিদার
তুমি বিনে কেউ নাই আমার
ওগো মুরশীদ খোদা।

সাধনতত্ত্ব বিষয়ে ফুলবাস বলেন:

সাদেকী প্রেমিক হলে, কামরতি তাহার থাকে না
সহস্র দলে উজান চলে, কামত্যাগী প্রেমিক যেজন।
সুজন হলে উজান চলে, নাহি টলে রতিমাসা।

আত্মাতত্ত্ব:

জনমভর যত্ন করে একদিনও দেখলাম নারে
আমি এই দেখবার আশায় ফাঁদ পাতিলাম
তবু পাখি পড়ে না ফাঁদে, ‘পুড়ুত’ করে উড়ে যায়।
জীবনের এই হচ্ছে বিড়ম্বনা।

অভেদ তত্ত্ব:

জাত বিজাতি যে বাছে
তার চেয়ে আর বোকা কে আছে?
আর ব্রহ্মাণ্ডময় একই খোদা–
এই মানুষ ছাড়া নয়কো জুদা
এক চিজেতে সবাই পয়দা,
ধাঁধায় পড়ে ঘুরতেছে।
বামুন কায়েত হাড়ি মুড়ি
একই জলে হলেন শুচি
সেখানে নাই বাছাবাছি
সকলে শুচি হচ্ছে।
আর চন্দ্র সূর্য নক্ষত্রগণ
এই মাটির উপরে সবারি আসন
এক মনিবের সব প্রজাগণ
ফুলবাস উদ্দীন ভাবতেছে।

এই অভেদ-দৃষ্টি লাভ করা কেবল লোকান্তরে প্রসারিত জীবন অধ্যাত্মবাদীর পক্ষেই সম্ভব। বাউলেরা বৈষ্ণবদের মতো সমাজ প্রতিবেশ সম্বন্ধে উদাসীন নয়। বাউল গানে ব্যবহারিক জীবনের নানা বস্তু থেকে রূপকাদি গৃহীত হয়েছে। সাধারণত দেহতত্ত্ব ও আত্মবোধন বিষয়ক গানেই রূপপ্রতীকের আধিক্য দেখা যায়। বাউলেরা জীবনকে নৌকা এবং দুনিয়াকে দরিয়া ভাবতে বিশেষ অভ্যস্ত।

ফুলবাসের শিষ্য নসরুদ্দীনের ধারণায়, আল্লাহ্‌ ভক্তবৎসল। আল্লাহ্‌ বলেন:

‘আমি ভক্তের অধীন আছি চিরকান
ধনী মানী দুঃখী তাপীরে — কাহাকেও ভাবি না ভিন।
যেভাবে রাখে যেবা জন,
তার কাছে রই তেমনি মতন,
যোগাই তাহার মন।’

নসরুদ্দীনের সৃষ্টিতত্ত্ব:

নীর হইতে নূরের আকার ধরে,
আলিফ রূপে সেই পরওয়ার
আহাদ নামটি হল তাহার
নূর-নিরঞ্জন যারে কয়
আলিফের ‘কালেব’ হইতে
আহাদ এল মিম রূপেতে
আহমদ রয় মিমের মধ্যে
মিমরূপে সেই জগৎ সাঁই
মিম ফেটে হয় মোতির মতন
সেই নূরে আদম হয় চেতন
জাতে জাতে এল তখন
পেল বিবি আমেনায়।

নসরের মতে:

দেহের বিচে দেখ আছে আজব কারখানা
তিনশত ষাট দিয়ে জোড়া করেছে দেহ খাড়া
দুই খুঁটি একটি আড়া — বেড়া চারখানা
দশ দরজা আট কুঠুরি — চার কুতুব ষোলো প্রহরী
বায়ান্ন গলি, তিপান্ন বাজার, তের নদী সাত সমুদ্দর
তাহার মধ্যে চোদ্দটা ঘর, কেউ করে না তাহার খবর —
তিন উজির তিন বাদশা তার, এক মনিব দুই খরিদ্দার
দালাল তাহার দুইজনা।
দেহের খবর বড় খবর
তিন তারেতে হচ্ছে সব খবর।
বারো বুরুজ সাত সিতারা,
দেহের ভিতর আছে পোরা।

আর দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে বিভিন্ন শক্তির অধীন। নসরের ভাষায়:

ওয়াজেবল অজুদের মাঝি — রহমানি নফস আছে
ওয়াহেদল অজুদের বিচে — মাতাইন্না নফস রয়
আর মমকেনল অজুদের ধারা — বাস করে নফস আম্মারা
মমতেনাল অজুদে পোরা, লওমা সেই নফস কয়
মলহেমা বলে যারে, আরফেল অজুদে ফিরে
পাঁচ অজুদকে চিনতে পারলে নসর কয়, অধর ধরা যায়।
স্বরূপ-রূপে নিয়ে নয়ন চেতন হয়ে দেখ এবার
মিমমোকামে ভজন সাধন, ‘হাহুতে’ সেই সাঁই-এর আসন।

নসরের কাছে জীবন ও স্রষ্টার অভেদতত্ত্ব এরূপ:

আমি দুগ্ধ তুমি মাখন, আমি পাথর তুমি আগুন
আমি ফুল তুমি ঘ্রাণ — রাখছি জাত সিফাতে
চাঁদের চাঁদনী যেমন, সূর্যের মধ্যে ধূপের কিরণ।
আবের মধ্যে বিজলি গোপন, এইরূপে রয় জাত সিফাতে
জাতে সিফাত সিফাতে জাত, আমি তুমি নয়কো তফাত
তুমি আছ নসরের সাথ, খেতে শুতে পথে যেতে।

এখানে সুমধুর কবিত্বে তত্ত্বকথা কাব্যকথার রূপ নিয়েছে।
রসিক কবির প্রতিবেশ-চেতনা ও তীক্ষ্ণদৃষ্টির পরিচয় মেলে বাঙালি মুসলমানের জীবনচত্র অঙ্কনের প্রয়াসে:

বাঙলা দেশের জঙলা মুসলমান
কই মানে হাদিস-কোরান।
সুদ-ঘুষ-জেনায় মত্ত, বেপর্দা নারী যত
তাদের হাতে সবাই খান।
দারি ছাঁটে এ্যালবার্ট-কাটে
শার্ট কোর্ট ঘড়ি পকেটে
কেউ দেয় লেংটি এঁটে
চশমা চোখে হাতে ঘড়ি
তামাক খান না — পান বিড়ি
তহ্‌বন-টুপির নাইকো মান।

পানিই জগৎ-কারণ — এ-কথা বলতে গিয়ে পানি-মাহাত্ম্য বর্ণন প্রসঙ্গে ফলমূলের একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন কবি:

পানিতে হল এ সংসার
এই যে পানি দেহ খানি, সৃষ্টি করলে সাঁই আমার
নীরাকারে ডিম্বরূপে ভেসেছিলেন সাঁই
পানি হতে আসমান-জমিন চৌদ্দ ভুবন হয়।
পানির আড়া পানির বেড়া পানি ছাড়া কে এবার।
রাই সরিষা, মটর, মশুরী, তিল গোঁজা ছোলা
ক্ষীরা-কুমড়া-তরমুজ-শশা আর কলা
পেয়ারা-পেঁপে-পোস্তদানা, পানির ‘পরে জন্ম তার
মহুরী-শুপারী, এলাজ-কস্তুরী, বরবটি ধোঁধল
লিচু পিচু গোলাপ জাম, হচ্ছে রাম পটল,
হেট্‌ কাবাজারী রাই-খেশারী ডুমুর ডালিম হয় এবার।
আম জাম হয় কাঁঠাল এই বাঙলাদেশে
করমচা কামরাঙা ভালো, খেলে জ্বর আসে
আইফল-নাশপাতি ভালো বাংলা দেশে পাওয়া ভার
আছে আঙুর কিনে খেজুর পয়সা জোটে না
লঙ্কা খেলে পেট জ্বলে খাও বরফদানা
নসের বলে পানি নইলে চল্‌বে না আর এ সংসার।

প্রার্থনাসূচক গানগুলোতে নসরের ভক্তহৃদয়ের আবদার, অভিমান, গোহারী ও মিনতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন:

১. (তুমি) ভক্ত হতে প্রকাশিত, ভক্ত না থাকিলে কে ডাকিত
তুমি মনিব আমি যে দাস, আমা হতে তোমার নাম প্রকাশ
২. রহমান নাম কেন তোমার
পাপীকে যদি না কর উদ্ধার।

পরিশেষে আমারও কবির সাথে প্রার্থণায় যোগ দিয়ে প্রাণের কথা নিবেদন করি:

তুমি দয়া কর দয়াময়
দীনহীনে ডাকে যে তোমায়
তোমার আশায় চিরদিন এ যৌবন বয়ে যায়
দিনে দিনে ফুরাল দিন, আমার ভাবতে ভাবতে
তনু যে ক্ষীণ
আমায় কী ভাবেতে ভেবছ ভিন আমি কী তোর কেহ নয়
কত সহে জীবনে, আমি পুড়ে মলাম আশকৎআগুনে
দেবা পার কত দিনে — দীনহীন নসরে কয়।

পরিণামে সব মানবাত্মারই এক আবেদন, একই মিনতি! অপরিমেয় রূপপ্রতীকের প্রয়োগ বাউল গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মধুসূদনের অন্তর্লোক

মধুসূদন আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে এক আশ্চর্য জ্যোতিষ্ক। উনিশ শতকের দ্বিতীয় পদে তাঁর জন্ম। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব সে শতকের তৃতীয় পদে। ভৌগোলিক হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানেরই সন্তান।

ধনী ও মানী রাজনারায়ণ মুন্সীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন আজন্ম সর্বপ্রকার প্রশ্রয়ে লালিত। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দম্ভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছোটকে তুচ্ছ করা আর বড়র বন্দনা করা ছিল তাঁর স্বভাবজ। জীবনে ও মননে ছিল তাঁর বিলাসপ্রবণতা ও আভিজাত্য। ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতাকে তিনি আবাল্য এড়িয়ে চলতেন। এটি তাঁর জীবনে আদর্শ ও লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। ধন, যশ ও মানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁর জীবনের শুরু। আর এ তিনটের সাধনায় ও সন্ধানে তার জীবন অবসিত! ধনী, মানী ও জীবনবিলাসী বুর্জোয়া ইংরেজ ছিল তাঁর আদর্শ। ইংল্যান্ড ছিল তাঁর স্বপ্নের জগৎ–আকাক্ষার স্বর্গলোক। তাই ধনী, মানী ও যশস্বী হবার বাসনায় কৈশোরেই বরণ করলেন খ্রীস্টধর্ম, শিখলেন ইংরেজি, হতে চাইলেন ইংরেজ কবি। ফলে যা কিছু দেশী তা পেল তার তাচ্ছিল্য এবং যে-কিছু য়ুরোপীয় তা হল তাঁর বন্দ্য। বিয়ে করলেন য়ুরোপীয় মহিলা, পোশাক পরলেন য়ুরোপীয়, বাসা নিলেন সাহেব পাড়ায়, মদ খেলেন তাও সাহেবের মতো। কিন্তু কোনোটাই তার উচ্ছলতা জাত নয়, জীবন রচনার ও সাধনায় সিদ্ধির অবলম্বন মাত্র। এজন্যেই মধুসূদনের প্রতি আমাদের অবজ্ঞা নেই, রয়েছে গাঢ় মমতা ও সহানুভূতি।

আজীবন মধুসূদন ছিলেন এক স্বাস্থ্যবান প্রাণধর্মী দুরন্ত শিশু। শিশুর মতোই তিনি প্রাণধর্মের প্রেরণায় চালিত হয়েছেন, হৃদয়াবেগই তাঁর সম্বল। সে-আবেগ তাঁকে সংকল্পে দৃঢ়তা এবং লক্ষ্যে অটলতা দিয়েছিল, তাই প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতে তার আস্থা ছিল না। ধন উপার্জনের জন্যে সে-যুগের সর্বোচ্চ যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন–ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, কবি হয়ে যশ লাভ করবার জন্যে সে-যুগের শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলোর সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। মধুসূদনের মতো বহুভাষাজ্ঞ সাহিত্যপাঠক এদেশে আজো দুর্লভ। আর কলকাতার সম্ভ্রান্ত উকিল ধনী রাজনারায়ণের যোগ্য ছেলে বিদ্বান ও ব্যারিস্টার এম. এম. ডাট-এর সম্মানে ছিল সহজ-অধিকার।

কিন্তু জীবৎকালে ধন, যশ ও মান কোনোটাই মধুসূদনের ভাগ্যে জোটেনি। এত বড় বিড়ম্বনা মানুষের জীবনে বেশি দেখা যায় না। ধন তিনি উপার্জন করেছিলেন কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না; যশ তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু তা আশানুরূপ ছিল না; আর তাঁর প্রাপ্য সম্মানও তিনি পাননি। রোজগার করতে চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ, তার হাজারে হাজারেও হয়নি। হতে চেয়েছিলেন ভুবন-বন্দ্য ইরেজি কবি, হলেন স্বল্পপ্রশংসিত বাঙলা-কবি। আশা করেছিলেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতাপ, কিন্তু রইলেন সমাজচ্যুত হয়ে। জীবকালে বাঁচার মতো বাঁচতে পারেননি, মরে হলেন অমর।

মধুসূদনের এই চরিত্র, এই আকাঙ্ক্ষা ও হতবাঞ্ছই তার সৃষ্ট-সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত। যে-পার্থিব জীবনপ্রীতি মধুসূদন-চিত্তে চাঞ্চল্য, আবেগ ও জ্বালা সৃষ্টি করেছিল, সেই চাঞ্চল্য ও আবেগ, ভাগেচ্ছা ও হতবাঞ্ছার যন্ত্রণাই মধুসূদনের কাব্য-নাটকে অভিব্যক্তি পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর প্রত্যেকটিই জীবনবাদী, ভোগপ্রিয়, আবেগপ্রবণ ও হতবার বেদনায় কাতর ও দিশাহারা। সেখানে রূপানুরাগী সুন্দ-উপসুন্দ নারীর রূপবহ্নিতে আত্মাহুতি দেয়, ভীমসিংহ কন্যার জীবনের বিনিময়ে রাজ্যভোগ করতে চায় এবং পুত্রের বিক্রমগবী রাবণ হতমান হয়ে হাহাকার করে, পুত্র-গর্বিত চিত্রাঙ্গদা পাগল হয়, পতি-গর্বিতা সীতা রোদন করে, স্বামী-সোহাগিনী প্রমীলা সহমরণেও গর্ববোধ করে, বলবীর্যগর্বী ইন্দ্রজিতের জীবনও ক্ষোভে-অপমানে অবসিত হয়। সেখানে কৈকেয়ী-জনা-দ্রৌপদী হতবাঞ্ছার ক্ষোভে-জ্বালায় আগুন ছড়াতে চায়, অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তারা-সুর্পণখা হৃদয়ের আবেগে বিচলিত ও তার জন্যে লাঞ্ছিত। তার গোপবালা অতৃপ্ত বাসনার বেদনায় ব্যাকুল। শর্মিষ্ঠা-পদ্মাবতীও প্রমূর্ত আবেগ। তাঁর Captive lady-ও বন্দী আত্মার কান্না। তার সনেটগুলোতেও একটি বেদনাবোধ–একটি দীর্ঘশ্বাস যেন প্রচ্ছন্ন।

বেদনাহত নির্যাতিত মানবাত্মার যন্ত্রণা ও কান্নাই মহৎ সাহিত্যের অবলম্বন। মধুসূদনের কবি মনে এ সত্যটি সহজেই ধরা দিয়েছিল। কোথাও তাই তাঁর কবিদৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত জীবনে ক্ষোভ, হতবাঞ্ছার কান্না, নির্যাতিতের যন্ত্রণা, নির্দোষের লাঞ্ছনা প্রভৃতিকেই মধুসূদন তাঁর রচনার অবলম্বন করেছিলেন। অতএব, মহৎ শিল্পের কোনো উপকরণেই তাঁর অবহেলা ছিল না। বলেছি, মধুসূদনের নিজের জীবনও ছিল একটি প্রমূর্ত কান্না একটি প্রচণ্ড হাহাকার–তাঁর আত্মবিলাপে তাঁর অন্তরাত্মারই আর্তনাদ শুনতে পাই,আত্মবিলাপ কবিতাটিই তাঁর আত্মজীবনী।

তাঁর জীবনবোধ ও জগৎ-চেতনায় ছিল গ্রীক নিয়তিবাদের ও পুরুষকারের দ্বান্দ্বিক প্রভাব। তাই গ্রীক-ট্র্যাজেডির ভাব-সত্য যেমন তিনি গ্রহণ করেছেন, তেমনি Paradise Lost-এর শয়তানের স্বাতন্ত্রবুদ্ধি ও মর্যাদাবোধজাত দ্রোহকেও অভিনন্দিত করেছেন, অনুগতের শান্ত-নিশ্চিন্ত জীবনের চেয়ে দ্রোহী জীবনের মহিমময় পরাজয় এবং মহৎ-মৃত্যু তাঁর কাম্য ছিল।

আমাদের সৃজনশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদনই প্রতীচ্যের প্রথম চিত্তদূত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের য়ুরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিই ছিল তাঁর অনুধ্যানের বিষয়। তিনি ছিলেন grand and Sublime-এর অনুরাগী। grandeur ও grandoise উনিশ শতকী য়ুরোপে ছিল বিরল, তাই তাঁর মানস-পরিক্রমের ক্ষেত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগেই রইল সীমিত। আধুনিক য়ুরোপ কিংবা ভারত তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।

তবু য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব তার মধ্যেও দেখি—-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতিপ্রেম, স্বদেশপ্রীতি, পুরুষকারে আস্থা; ঐহিক জীবনবাদ, বিদ্রোহানুরাগ, ব্যক্তিসত্তায় ও মানবপ্রীতিতে গুরুত্ব এবং হৃদয়াবেগে মর‍্যা দান প্রভৃতি তাঁরও রচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। ফলে আঙ্গিকে তিনি ক্লাসিক হলেও প্রেরণায় পুরোপুরি রোমান্টিক। আমরা জানি, মধুসূদন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংরেজিতে কাব্যরচনা করে অমর হবার বাসনায়। বাজি রেখে বাঙলা রচনায় হাত দিলেন, এজন্যে তার প্রস্তুতি ছিল না। সে বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। বাঙালিকেও জিইয়ে ছিলেন নিস্পন্দ ধড়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে বাঙলার সমাজে ও সাহিত্যে, মননে ও মেজাজে মধুসূদনই প্রথম সার্থক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী, পথিকৃৎ ও যুগস্রষ্টা। ভাবে ও ভাষায়, ভঙ্গিতে ও ছন্দে এবং রূপে ও রসে অপরূপ করে তিনি নতুন জীবন ও জগতের পরিচয় করিয়ে দিলেন বাঙালির সঙ্গে। এ দক্ষতা সেদিন আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি, যদিও ইংরেজি শিক্ষিত গুণী-জ্ঞানীর সংখ্যা নেহাত নগণ্য ছিল না সেদিনকার কলকাতায়।

মধুসূদনের জন্মের আগে থেকেই য়ুরোপে এবং তাঁর সমকালে এদেশেও শিক্ষিত সমাজে বিজ্ঞানবুদ্ধির প্রভাবে জীবনবোধ ও জগৎচেতনা দ্রুত রূপান্তর লাভ করছিল। এজন্যে মধুসূদনের প্রভাব বাঙলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিশেষ করে তার সমকালীন য়ুরেপীয় জীবনচেতনার স্বরূপ তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। এ-যুগের মর্মবাণী গীতিকবিতায় অভিব্যক্তি পেয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারেননি–তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষ।

তবু আমাদের দেশে তিনি নতুনের বাণীবাহক, নতুনের ধ্বজাধারী যুগস্রষ্টা চিন্তানায়ক। আমরা তাঁকে ভুলিনি, ভুলতে পারবও না। জয়তু মধুসূদন!

মহাকবি কায়কোবাদ

আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম ধারার অন্যতম উদ্গাতা মহাকবি কায়কোবাদের এন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আশ্রয় নিল।

কায়কোবাদ যে- যুগে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, সে-যুগে মধুসূদন, সুরেন্দ্রনাথ, হেমচন্দ্র, বিহারীলাল, নবীন সেন প্রমুখ ছিলেন প্রতিষ্ঠাবান কবি। তাঁদের প্রবর্তিত রাজপথে ও তাঁদের আদর্শের অনুসরণে কায়কোবাদের সৃষ্টি রূপ লাভ করে। অতএব কায়কোবাদের সমসাময়িক কবি রবীন্দ্রনাথ বাঙলা সাহিত্যে যে-নতুন কাব্যাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করলেন, গীতিকবিতার যে-উচ্ছল বন্যা বাঙলা দেশ ও বাঙালির মন প্লাবিত করেছিল, তার সঙ্গে কায়কোবাদের যোগ ছিল না। তিনি এ ধারাকে সমর্থন করতে পারেননি। তিনি উনিশ শ তেত্রিশ সালেও কাহিনীকাব্য রচনা করেছেন। অতএব তাঁকে আমরা আধুনিক যুগে পেলেও তিনি ছিলেন বিগতযুগের শেষ প্রদীপ–সে প্রদীপ বিচিত্র অলঙ্কারে ও রূপসম্ভারে ঝড়ের ন্যায় মনোহারী আর ঔজ্জ্বল্যে সমৃদ্ধ।

সুতরাং তাঁর অবদানের মূল্য যাচাই করতে হলে উপরোক্ত কবিদের রচনার পাশে রেখেই যাচাই করতে হবে। কিন্তু বিস্তৃত আলোচনার সময় আজ নয়। আমরা আজ শুধু যুগ ও পরিবেশের নিরিখে তার সাধনার গুরুত্বটি উপলব্ধি করতে প্রয়াস পাব।

পলাশীর ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে বাঙলার মুসলিম-জীবনে নৈরাশ্যের যে সুচিভেদ্য অন্ধকার। নেমে এল, তাতে নিতান্ত জীবনধারণ প্রচেষ্টা ব্যতীত আর কোনোরূপ জীবন-স্পন্দনের সন্ধান মেলে না। এমনি যখন অবস্থা, তখন জীবনবোধ বা শিল্পপ্রচেষ্টা বা সৃষ্টিপ্রয়াস পঙ্গু অথবা স্তব্ধ হয়ে থাকারই কথা। ফলে মুসলমানরা নৈরাশ্যের পঙ্কেই কেবল মজল না, ঐতিহ্যবোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল।

এদিকে ইংরেজ শাসকমণ্ডলী স্বার্থপ্ররোচণায় সদ্যরাজ্যহারা স্বাধীনচেতা অসহযোগী মুসলমান–শোষণ ও হিন্দু-তোষণনীতি গ্রহণ করে এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ফন্দি আঁটল। ফল এই দাঁড়াল যে, নতুন ভূমিব্যবস্থায় বাঙালি মুসলমান ভূঁইয়ারা রাতারাতি ফতুর হয়ে গেল।

এরপরে অভাবে, অশিক্ষায় জড় মুসলমান আভিজাত্যের গর্ব ও অসহযোগের দৃঢ়তা ভুলে ইংরেজি শেখা আরম্ভ করল নতুন সমাজব্যবস্থায় মর্যাদা ও সম্পদ লাভের প্রত্যাশায়। প্রথম যুগের এমনি ইংরেজিশিক্ষিতদের মধ্যে কায়কোবাদ একজন, যদিও তিনি প্রবেশিকা মানের স্তরেও উঠতে পারেননি। মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে তাঁদের বিরাট ও বিচিত্র অবদানের ঐতিহ্যবোধের ক্ষীণ রশ্মিটুকুও মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না। তাই মীর মশাররফ হোসেন ও কায়কোবাদ যখন বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে সক্ষম পদক্ষেপ করলেন, তখন সেদিনকার সাহিত্যের আসরে তারা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কাছে সবিস্ময় অভিনন্দন পেলেন এবং সমালোচককে সবিস্ময়ে বলতে শোনা গেল–মুসলমান হইয়া এমন বিশুদ্ধ বাঙলা লিখিতে পারেন, তাহা আমাদের জানা ছিল না।

মুসলমানদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যবিস্মৃতি ও হিন্দুদের অবজ্ঞার সাক্ষ্য হয়ে চিরকাল ইত্যাকার কথাগুলো আমাদের জাতীয় জীবনের বেদনাদায়ক দুঃসময় স্মরণ করিয়ে দেবে।

কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন ব্যতীত কেউ তখনো প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি। সুতরাং বলা চলে কায়কোবাদের মাধ্যমেই মুসলমানদের আধুনিক বাঙলা কাব্য সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়। আশ্চর্য, প্রথম প্রচেষ্টাতেই অক্ষমতার তেমন কোনো স্বাক্ষর নেই। কায়কোবাদের অশ্রুমালা মহাশ্মশান ও অমিয়ধারা সেদিনকার বাঙলা-সাহিত্য-ইমারতে তিনটে সুদৃশ্য ও সুদৃঢ় স্তম্ভরূপে শোভা পেয়েছিল। বিস্তৃত আলোচনা করলে দেখা যাবে, মধুসূদন ও বিহারীলাল ব্যতীত সে-যুগের প্রথিতযশা কবি হেমচন্দ্র, কামিনীরায় ও নবীন সেন প্রভৃতির চেয়ে কায়কোবাদ কি মহাকাব্য রচনায়, কি খণ্ড-কবিতা সৃষ্টিতে তেমন ন্যূন ছিলেন না, বরং অসূয়াহীন ঔদার্যে তিনি পূর্বসূরীদের হার মানিয়েছেন।

কাব্যকলা সম্বন্ধে তাঁর ধারণাও ছিল অনন্য। মহৎ আদর্শ ব্যতীত উদ্দেশ্যবিহীন নিছক রসসৃষ্টির আদর্শকে তিনি ঘৃণা করতেন। এ কারণে তিনি রবীন্দ্রনাথের এবং তৎপরবর্তী সাহিত্য প্রয়াসকে সুনজরে দেখতেন না।

কায়কোবাদের নিজস্ব মহৎ আদর্শ ছিল। সে-আদর্শ রূপায়ণ লক্ষ্যে তিনি মহাকাব্য রচনায় হাত দেন। তাঁর কাব্যসাধনার গুরু ছিলেন নবীন সেন। তাঁরও সাধনা ছিল মহান আদর্শ ও নীতির কাব্যে রূপায়ণ। ফলে মহাভারতের নতুন ভাষ্য-রৈবতক-কুরুক্ষেত্র-প্রভাস নামক কাব্যত্রয়ীর সৃষ্টি ও অমিতাভ, অমৃতাভ, খ্রীস্ট প্রভৃতি মহাপুরুষের জীবনী ও শিক্ষাকে কাব্যে কথন-প্রচেষ্টাতেই সীমিত ছিল তাঁর সাধনা।

কায়কোবাদের জীবনাদর্শের তিনটে সুস্পষ্ট ধারা ছিল। সে-তিন ধারা-স্বাজাত্য ও ঐতিহ্যবোধ, জগৎ ও জীবন-জিজ্ঞাসা এবং জীবন ও প্রেম।

স্বাজাত্য ও ঐতিহ্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মহাশ্মশান, মহররম শরীফ ও অমিয়ধারায়।– জাতিবৈর-এর কবি হেমচন্দ্র বা পলাশীর যুদ্ধের কবি নবীন সেন অথবা পদ্মিনী কাব্যের কবি রঙ্গলালকে পাশাপাশি রেখে বিচার করলে, কায়কোবাদের শক্তি, আবেগ ও তেজস্বিতার প্রমাণ মিলবে। স্বদেশপ্রেমে ও স্বাজাত্যবোধে এবং প্রকাশ-প্রতিভায় কায়কোবাদ এঁদের চেয়ে কম ছিলেন না।

কবির আদর্শের আর একটি দিক হচ্ছে–মিথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের আপোসহীন সংগ্রাম। সর্বপ্রকার অন্যায়-অনাচার এড়িয়ে জীবনযাপন করার মধ্যেই আত্মার মুক্তি। জীবনের পথ বড় বন্ধুর; নানা মায়া-মমাহের জালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তদুপরি আছে অতৃপ্তির বেদনা ও জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের ক্ষোভ। একটানা মায়া-বন্ধন, অতৃপ্তি, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ-নৈরাশ্যের কান্নায় অশ্রুমালা গ্রথিত।

জীবন ক্ষণস্থায়ী সত্য, কিন্তু এ জীবনও সুন্দর এবং আরামদায়ক করে গড়া যায়, যদি প্রেমের সাধনা একান্তভাবে করা সম্ভব হয়। প্রেমের বীজ উপ্ত হয় ব্যক্তিকে অবলম্বন করে, কিন্তু পরিণতি বিশ্বপ্রেমে। তাই কবি তাঁর কাব্যে সর্বত্র প্রেমের মাহাত্ম্য ঘোষণা করেছেন। বলা চলে–তিনি . প্রেমকেই মানবজীবনের দিশারী বলে আন্তরিকভাবে স্বীকার করেছেন। প্রেমিক অন্যায়-অসত্য অসুন্দরকে বাইরে না হলেও অন্তরে জয় করতে সক্ষম হয়। শিবমন্দির বা শ্মশানভস্ম প্রভৃতি কাব্য এ আদর্শেরই রূপায়ণ। তাঁর কাব্যগুলোর ভূমিকা পাঠে আমাদের উক্তি আরো স্পষ্ট উপলব্ধ হবে। কবির নিজের কথায়– অধোপতিত ও নিদ্রিত জাতিকে জাগাইবার প্রকৃষ্ট উপায়ই সৎসাহিত্যের আলোচনা। নিপুণ কবি তাহার কাব্যে যেসব পুণ্যময় চিত্র অঙ্কিত করিয়া থাকেন, তাদের মধ্যে ধর্মালোকে উদ্ভাসিত পুণ্যের জীবন্ত ছবি থাকিলে সমাজ তাহারই আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া উন্নতির দিকে শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইয়া থাকে। (ভূমিকা–শিবমন্দির)। কবি এ আদর্শেই সাহিত্য-সাধনা করেছেন।

বাঙলা সাহিত্যের তিন ক্ষেত্রে যে- তিনজন শক্তিমান পুরুষ আত্মবিস্মৃত দিশেহারা জাতিকে পথের দিশা দিয়েছিলেন, তারা হচ্ছেন–মীর মশাররফ হোসেন, মহাকবি কায়কোবাদ ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। অবশ্য এঁদের সহযোগী ছিলেন আরো কয়েকজন। কিন্তু এঁরাই ছিলেন পুরোভাগে। মীর মশাররফ হোসেন গদ্য-সাহিত্যে, কায়কোবাদ কাব্যে এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের বাঙলা-সাহিত্যে মুসলিম অবদান ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জনসাধারণের পরিচয় ঘটিয়ে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম প্রভাব ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এভাবে নতুন করে মুসলমানেরা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ধারক, বাহক ও সাধক হয়ে ওঠেন। সাহিত্য জাতির প্রাণ। এইজন্যে বাঙালি মুসলমান তাঁদের মরা দেহে প্রাণসঞ্চারকারী বলে এই তিন মহাসাধকের কাছে চিরদিন ঋণী থাকবেন।

সুতরাং কবি কায়কোবাদ আধুনিক বাঙলা-সাহিত্যের মুসলিম ধারার অন্যতম প্রবর্তক, বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় জাগরণ ও জাতীয়তাবোধের উদ্বোধক এবং আধুনিক মহাকাব্য রচনায় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান।

এককথায়, আমরা তাঁর কাছে আধুনিক সাহিত্যে হাতে-খড়ি, জাতীয়তাবোধের এসম ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রেরণা লাভ করি–এ-ই তাঁর গৌরব, এখানেই তাঁর সাধনার সার্থকতা, এ কারণেই তিনি আমাদের স্মরণীয় ও বরণীয়। আজকের দৃষ্টিতে সাধারণভাবে বলতে গেলে উনিশ শতকী মুসলিম সাহিত্যিকদের সৃষ্টি প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু তাদের প্রয়াস শ্রদ্ধেয়। তারা গন্তব্যে পৌঁছেননি বটে, কিন্তু পথের দিশা পেয়েছিলেন। তাঁদের অসাফল্যের জন্যে তাঁরা নন–তাঁদের অসম্পূর্ণ প্রতীচ্য-শিক্ষাই দায়ী। তারা পথিকৃৎ, তাঁরা দিশারী–এজন্যে তাঁরা আমাদের আদর্শ নন–অবলম্বন। তাঁরাই বটতলার মজলিশের মোহ কাটিয়ে লালদীঘির প্রভাব স্বীকার করে মুসলিম সমাজে বাসন্তী হাওয়া ছড়ালেন। তাঁদের কৃতিত্ব এখানেই। আমাদের কৃতজ্ঞতাও এজন্যেই।

যুগন্ধর কবি নজরুল

সৃজনীশক্তি আর সৃষ্টিশীলতা মানুষের ব্যক্তিগত গুণ। কিন্তু সে-সৃষ্টির অবলম্বন দেশ-কাল নিরপেক্ষ নয়, পরিবেশকে আধার আর প্রতিভার অভিব্যক্তিকে আধেয় হিসাবে কল্পনা করলে, যে-কোনো প্রতিভার কিংবা সৃষ্টির স্বরূপ উপলব্ধি করা সহজ হয়।

স্থান-কালের প্রভাবেই মানুষের দেহ-মন নিয়ন্ত্রিত হয়। কাজেই মানুষের যে-কোনো আচরণে বা অভিব্যক্তিতে স্থানিক ও কালিক ছাপ না-থেকেই পারে না।

প্রতিভা মাত্রেই একাধারে যুগন্ধর ও যুগোত্তর, এতে সমকালীন মন-মেজাজের চাপ যেমন থাকে, তেমনি থাকে ভাবীকালের মন-মানসের আভাস– যা প্রাকৃতজনকে দেয় ভবিষ্যতের দিশা।

নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে বক্তব্য পেশ করার আগে এ ভূমিকাটুকু করতে হল এ জন্যে যে, আজকাল কথা উঠেছে নজরুল-কাব্য সাময়িকতা দোষে দুষ্ট, কাজেই তা কালোত্তীর্ণ হতে পারবে না। ফলে তাঁর কবিতা হবে না অমৃত আর তিনি রইবেন না অমর। এ অভিযোগ তাঁর বন্ধু ও হিতৈষীরা গোড়া থেকেই করে আসছিলেন, নজরুল জবাবও দিয়েছিলেন :

বর্তমানের কবি আমি ভাই
ভবিষ্যতের নই নবী
কবি অকবি যা বল ভাই।
নীরবে আমি সই সবি,
বন্ধুগো আর বলিতে পারি না
বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি
তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি নাতো একা
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা
বড় কথা বড় ভাব আসেনাকো মাথায়, বন্ধু বড় দুখে
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে।
প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায়
তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।

তবু হিতৈষীদের ক্ষোভ কমেনি, তাই আজো ভক্ত পাঠক-মনে বেদনা জাগে।

বালক-কিশোর কবি কবিতা লেখে, সে-লেখা যত না নিরুর্দিষ্ট পাঠকের জন্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি অবচেতন মনের অনুভূতি প্রকাশের প্রেরণায়– বেদনা-মুক্তির কারণে। কিন্তু বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে তার দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়, সে হয় প্রতিবেশ সচেতন। তখন প্রকাশের প্রেরণাই প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট বিবেচিত হয় না। তখন স্রষ্টার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে– কী লিখব, কেন লিখব, কার জন্যে লিখব এবং কেমন করে লিখব? এতেই মিলে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিশা। তখন বক্তব্য প্রাণ, পায়, অর্থপূর্ণ হয় এবং পাঠকহৃদয়ে জাগায় সমানুভূতি। মানুষের স্বভাবে রয়েছে বৈচিত্র্য, মতে আছে বিভিন্নতা এবং মননে আছে লঘু-গুরু ভেদ। এতেই ঘটে একই বস্তু সম্বন্ধে জনে জনে দৃষ্টির পার্থক্য ও মতের বিভিন্নতা।

প্রকাশের প্রেরণাবোধ করতেন, তাই নজরুল ছেলেবেলায় লিখতেন। তখন চেষ্টা ছিল কেবল সুন্দর করে বলার দিকেই, যাতে করে শ্রোতারা বলে বেশ হয়েছে, চমৎকার লাগল। তখন বক্তব্য নয়, বলার ভঙ্গি-সুষমাই লক্ষ্য।

কৈশোরুত্তীর্ণ কবির অভিজ্ঞতা অনেক দূর থেকে হলেও জগৎ-জীবনের নগ্নরূপ বড় বীভৎস আকারে তাঁর চোখে ধরা পড়েছে। সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে মানবতার লাঞ্ছনা তাঁকে ব্যথিত-ব্যাকুল করে তুলেছে। একদিকে পুঁজিপতি বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদের নর-রক্তমুণ্ড নিয়ে দানবীয় উল্লাস, অপরদিকে চির-নির্যাতিত আর্তমানবতার মরিয়া ভাবের বিপ্লব। মধ্য-য়ুরোপের যুদ্ধক্ষেত্র আর রাশিয়ার বিপ্লব ময়দান–এ দুটোর সার্বিক বৈপরীত্য কবির বক্তব্যের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করল অপরিমেয়! প্রত্যয়দৃঢ় কবি লেখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম শুরু করলেন–

রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা।
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা

এভাবেই নজরুল যুগ-জাত এবং যুগন্ধর কবি হয়ে উঠলেন। তিনি সমকালের মানুষের বুকের বেদনার অভিব্যক্তি দিলেন, তাদের রুদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল তার তীব্র লেখনী মাধ্যমে।

যদিও মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি তবু সে-রবির প্রভায় এ যুগ-আর্তি তেমন ধরা পড়ছিল না প্রাকৃতজনের চোখে। তার প্রশান্ত তীক্ষ্ণ কটাক্ষ, তাঁর তিতিক্ষা-মধুর তিরস্কার উপলব্ধি করবার যোগ্যতা ছিল না জনগণের। তাই তার মানবতার বাণী তাদের স্বস্তি দিতে পারে নি।

রবির কিরণ ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে আজ দেশান্তরে
সে কিরণ শুধু পশল না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।

নজরুল ইসলাম সাধারণের বুকের কথা তাদেরই মুখের আটপৌরে ভাষায় যখন বলা শুরু করলেন, তখন বিস্মিত বাঙালি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করল। প্রদীপ্ত সূর্য-শাসিত আকাশে তারার আবির্ভাব যেমন অদ্ভুত, রবীন্দ্র-সৃষ্ট সাহিত্যাকাশে ধ্রুব নক্ষত্রের দীপ্তি ও স্থিরতা নিয়ে নজরুলের উদয়ও তেমনি অভাবিত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আশ্বস্ত হৃদয়ে তাঁকে বরণ করে নিলেন। তিনিও তাঁকে অভিনন্দিত করলেন ভবিষ্যতের নবী হিসেবে নয়, বর্তমানের কবি– রূপে এবং সম্বোধন করেছেন ধূমকেত বলে!

আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক-রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন!

অতএব নজরুল যেমন ভবিষ্যতের নবী না হয়ে বর্তমানের কবি হবার উদ্দেশ্যে লেখনী ধরেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তাকে যুগের ধূমকেতু বলে, সমকালীন সমস্যার সংগ্রামী বলে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিশ্বমানবতার ধারক, বাহক ও প্রচারক এবং মানুষ ও প্রকৃতি রাজ্যের সার্বিক অনুভূতির প্রমূর্তরূপ রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও যার স্বাতন্ত্র স্নান করতে পারেনি, তাকে সাময়িকতার অপবাদে তাচ্ছিল্য দেখানো সহজও নয়, সম্ভবও নয়।

নজরুলের কাব্যে দীপ্তি আছে, সামগ্রিক সৃষ্টি-সুষমা নেই এবং অনুশীলন-পরিশীলন-পরিচর্যার একান্ত অভাব। তাই তাঁর হাতে আকস্মিকভাবে গুটিকয় আশ্চর্য সুন্দর কবিতা সৃষ্টি সম্ভব হলেও তাঁর প্রতিভার ক্রমবিকাশের ও পরিণতির সাক্ষ্য নেই কোথাও। ক্ষোভের কারণ এখানেই। যেভাবে বলা হল তা সূক্ষ্মবুদ্ধির পরিচায়ক হলেও যেখণ্ডদৃষ্টির ফল, তা বোঝা যায় যখন দেখি অনেক চিরন্তনত্বকামী সুকবি–যাদের রচনায় কাব্য-কুশলতার অভাব নেই কিংবা অযত্নের এতটুকু ছাপ নেই কোথাও–পাঠকের সমাদর পাননি। নজরুলের জনপ্রিয়তাই নজরুলের যোগ্যতার ও তাঁর কাব্যের সার্থকতার প্রমাণ। যদি তাঁর কাব্যে কিছু অসাময়িক না-ই থাকবে, তা হলে নজরুল আজো এত জনপ্রিয় কেন? সে কী কেবল তার তুলে-ধরা সমস্যার সমাধান হয়নি বলে, কিংবা তার শুরু-করা সংগ্রামের ইতি ঘটেনি বলে? তা-ই যদি হত, তাহলে এতসব গণসাহিত্য আবর্জনার মতো অপসৃত হচ্ছে কেন?

নজরুল যুগের চারণ-কবি, যুগের মুযাহিদ এবং চিরকালের আতমানবতার প্রমূর্ত কান্না এবং বিদ্রোহ দু-ই। তাই তাঁর কাব্যে মহাভাবের মহৎ কথা নেই, ব্যবহারিক জীবনের অনুভূত সত্যের বেদনাময়-আগুনে অভিব্যক্তি আছে, এই জ্বালাময়ী বেদনার অগ্নিক্ষরা বাণীর পেছনে একটি সুস্থ সমাজ-দর্শন কিংবা রাষ্ট্রাদর্শ আশা করেছিল পাঠক মন। তা তারা পায়নি, ক্ষোভের মূল এখানেই। এই অবচেতন অভিযোগই তারা অক্ষম-ভাষায় প্রকাশ করছে সাময়িকতার অপবাদ দিয়ে এবং আঙ্গিক সৌন্দর্যের অভাব দেখিয়ে।

যে-নজরুলের দৃষ্টিতে এমন মর্মভেদী তীক্ষ্ণতা আছে, তাঁর জীবনজিজ্ঞাসায় যদি তেমনি গভীরতাও থাকত!–পাঠক- মনে এ সক্ষোভ প্রশ্ন জাগে। অর্থাৎ তারা একটা দর্শন চায়। কিন্তু কবির কাছে দর্শন পাই তো ভালো, না পেলেও দুঃখ কী? আমার মনের কথা, ভাবনার ভাষা পেয়েছি, এই কী যথেষ্ট নয়! আর কার্য-কারণ বিশ্লেষণ না-ই বা থাকল, সিদ্ধান্ত সমাধান না-ই বা পেলাম! আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, নজরুল ইসলামে বোলশেভিকবাদ কিংবা অন্য কোনো ইজমের আনুগত্য ছিল না। তার ব্যক্ত মানবতাবোধ মানুষের সুপ্ত মানবিকতারই বিমূর্ত প্রকাশ তাই এর গতি দুর্বার, এর আবেদন ঋজু এবং আকস্মিক। আঘাত ও অনুভূতিজাত বলেই এ উচ্ছ্বাস ঝড়ের মতো কুঁসিয়ে চলে এবং এ উত্তেজনা বন্যার মতো ভাসিয়ে দেয় আর সাগরের মতো কল্লোল তোলে।

নজরুল ইসলাম আসলে রবীন্দ্রনাথেরই পরিপূরক। রবীন্দ্রনাথে যে রেনেসাঁস প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে নতুনকে সুন্দরকে গড়ার ভার ছিল রবীন্দ্রনাথেরই। ঘুণেধরা পুরোনোকে ভাঙার দায়িত্ব পড়ল নজরুলের উপর। রবীন্দ্রনাথের মনীষা (brain), আর নজরুলের হাত (action)। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতি ও প্রজ্ঞা তাঁকে কঠোর-নির্মম হতে দেয়নি, শিক্ষা-বিজ্ঞানীর মতো তার চেষ্টা ছিল পরোক্ষ। নজরুল পাঠশালার পণ্ডিত। তিনি লাঠৌষধির প্রত্যক্ষ ফল লাভে উৎসুক। দুজনের লক্ষ্য ছিল এক এবং অভিন্ন–প্রেম পাওয়া ও দেওয়া, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে অসুন্দরকে অপসারিত করে কল্যাণ ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য। অপ্রেম-অসুন্দরই নজরুলকে করেছে সংগ্রামী। বোধিপুষ্ট রবীন্দ্রনাথের ছিল সইবার ও অপেক্ষা করবার ধৈর্য। কিন্তু তারুণ্য নজরুলকে করেছিল অসহিষ্ণু ও বিদ্রোহী। আর জীর্ণ আবর্জনা সরিয়ে না ফেললে নতুন ইমারত গড়ে তোলা যে দুঃসাধ্য এ বাস্তববোধ রবীন্দ্রনাথের ছিল। যা তিনি পারছিলেন না বলে অস্বস্তিবোধ করছিলেন, তা-ই করবার ব্রত নিয়ে একজনের সদম্ভ আবির্ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ উল্লাস ও অভিনন্দন না জানিয়ে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় আর নজরুলের কর্মে বাঙালির রেনেসাঁস পূর্ণতা পেল।

সংগ্ৰামব্রতী নজরুলের হাতে ছিল রণতুর্য আর মুখে ছিল ভাঙার গান–যে-ভাঙা ধ্বংসাত্মক নয়– সৃষ্টিমূলক :

প্রলয় রাগে নয় রে এবার ভৈরবীতে দেশ জাগাতে।

এবং

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নতুন-সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন জীবন-হারা-অসুন্দরে করতে ছেদন!
ভেঙ্গে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!

কাজেই

তোরা সব জয়ধ্বনি, কর!

দেশের ও যুগের সে-অবস্থায় নজরুলের মতো সংগ্রামী কবির প্রয়োজন ছিল, তিনি সে-প্রয়োজন মিটিয়েছেন। তাই তিনি জনপ্রিয় ও গণহৃদয়ের রাজা। তাঁর কাব্যও তাই উপাদেয়। তাঁর কাব্যেই প্রথম এদেশের বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত ব্যথার অভিযান প্রত্যক্ষ করি আমরা।

নজরুল ইসলাম যুগন্ধর কবি। তাঁর কাব্য আমাদের এক দুর্দিনের সমাজ-সংস্কৃতি ও মন মননের ইতিহাস হয়ে রইল, আর রইল অনাগত অনেক কালের জন্যে আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে। নজরুল-কাব্য আমাদের চেতনার স্বাক্ষর, আমাদের বোধের সাক্ষ্য, আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস এবং আমাদের মন-মননের প্রতীক, প্রেরণার উৎস আর মানবতাবোধের প্রতিভূ!

রবীন্দ্রনাথ

আমাদের শিশুরা ঘনিষ্ঠজনের ছাড়া আর যে-নামটির সঙ্গে গোড়াতেই বিশেষভাবে পরিচিত হয় তা রবীন্দ্রনাথ। আমাদের শিক্ষালয়ে রোজ লক্ষ লক্ষ মুখে যে নামটি উচ্চারিত হয় সে রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তারে-বেতারে যার নাম, সুর ও সংগীত প্রতিদিন পাক-ভারতের ঘাটে-মাঠে, আকাশে-বাতাসে শোনা যায়, তিনি রবীন্দ্রনাথ।

তিনি আমাদের ভাষা দিয়েছেন, কথা যুগিয়েছেন। আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের উন্নয়ন-উপায় ও লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছেন। তার বিভিন্ন ও বিচিত্র ভাব-চিন্তা তাঁর কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে ও রম্য রচনায় প্রমূর্ত ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

আলো-বাতাসের মধ্যেই বেঁচে আছি বটে, কিন্তু এদের দান আমাদের জীবনে কতখানি, সে সম্বন্ধে আমরা যেমন সচেতন নই। তেমনি আমরা যে-ভাষা মুখে বলি, লেখায় লিখি, যে সুরে গান গাই, যে ছন্দে লিখি, যা ভাবি, যা জানি, যা উপলব্ধি করি–তার কতখানি যে রবীন্দ্রাথের, তা মনেও জাগে না। ভাষা ও ছন্দ কিংবা পুরস্কার কবিতায় কাব্য ও কবি সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন তা আমাদের জীবনে আক্ষরিকভাবে সত্য হয়েছে। অন্যের কথা জানিনে, আমার চিত্তাকাশে রবীন্দ্রনাথের রচনার দান অনেকখানি, জীবনের বহু দুঃখ-বেদনার মুহূর্তে অনেক হতাশা-নিরাশার দুর্দিনে, নানা আপদ-বিপদের দুর্যোগে, আর সুখ-সৌভাগ্যের আনন্দিত দিনে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমার জীবনপথের পাথেয় হয়ে আছে। জীবন-রস-রসিক রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় মানুষ। তিনি জানতেন, আর সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাসও করতেন সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম এবং বসুদৈবকুটুম্বকম। তিনি নিজেই বলেছেন আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে যে মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদন, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য সেই মহামানবের মধ্যে, যিনি সদা জানানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।

তিনি সর্বত্র সুন্দর ও সুন্দরের প্রশান্ত দান আনন্দকে দেখেছেন, তাঁর সাধনা ছিল এই সুন্দরকে চাওয়া ও পাওয়ার সাধনা। তিনি পরমহংসের মতো সুন্দরকে পেয়েছেন। তাই তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বাসে বলতেও পেরেছেন আমি জীর্ণ জগতে জন্মগ্রহণ করিনি, আমি চোখ মেলে যা দেখলুম, চোখ আমার কখনো তাতে ক্লান্ত হল না, বিস্ময়ের অন্ত পাইনি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত, তাকে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে, মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম।

তাই তিনি আকাশ-জল, বাতাস-আলো আর প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবেসেছেন, যে ভালোবাসায় কোনো ভেদ-বিচার ছিল না। বিশ্বের অণুপরমাণুকে জ্ঞাতি বলে মেনেছেন, যদি জানিবারে পাই ধূলিরেও মানি আপনা। এ প্রসঙ্গে প্রবাসী, বসুন্ধরা, সমুদ্রের প্রতি প্রভৃতি কবিতা স্মরণীয়। তিনি চারদিক থেকে জীবন-রস আহরণ করেছেন, দুহাত ভরে তুলে নিয়েছেন জীবনের প্রসাদ। বলেছেন : এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি। তৃপ্ত হৃদয়ে তাই জীবনসায়াহ্নে তিনি বলতে পেরেছেন :

জীবনের বিধাতার যে দাক্ষিণ্য পেয়েছি জীবনে
তাহারি স্মরণ-লিপি রাখিলাম সকৃতজ্ঞ মনে।

বলেছেন :

যাবার বেলায় এ কথাটি বলে যেন যাই
যা পেয়েছি, যা দেখেছি তুলনা তার নাই।

এবং জীবন-সায়াহ্নে যা সচেতনভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তা-ই তিনি অবচেতন ভাবে তার জীবনে রূপায়িত করেছেন :

এ-কথা যখন জানি,
মানব চিত্তের সাধনায়,
গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ
সেই সত্য সুখ-দুঃখ সবের অতীত,
তখন বুঝিতে পারি,
আপন আত্মায় যারা
ফলবান করে তারে
তারাই চরম লক্ষ্য মানব সৃষ্টির।

জীবন রসের অপূর্বতায় আর জীবন-সত্যে তার প্রত্যয় ছিল দৃঢ়, তাই বলেছেন,

এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি
এ ভালবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে
করিবে অস্বীকার।

আকাশে চন্দ্র-সূর্য একক। কিন্তু তাদের প্রসাদের দাবীদার বিশ্বচরাচর। তাই বলে টুকরো টুকরো করে তাদেরকে ভাগ করার দরকার হয় না। প্রত্যেকেই রুচি ও গরজ মতো চন্দ্র-সূর্যকে অখণ্ড স্বরূপেই পায়। কেউ পথচলার কাজে, কেউ উৎসব-পার্বণের প্রয়োজনে, কেউ সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে এদের প্রসাদ সচেতনভাবে কামনা করে এবং গ্রহণ করে। কবি-শিল্পীর সৃষ্টিও তেমনি। পাঠকের বিদ্যা-বুদ্ধি-রুচি-বিলাস কিংবা গরজ মতো তা কাজে লাগাতে অথবা উপভোগ করতে পারে। এ নিয়ে তর্ক করা বৃথা। রবীন্দ্রনাথ বড় কবি, বিশ্বমানবতার কবি। মানববোধের উচ্চতম ভাব-চিন্তার অধিকারী ছিলেন তিনি–এই হচ্ছে বিদ্বানদের মত। যার যতটুকু সাধ ও সাধ্য তা-ই সে রবীন্দ্র-সাহিত্য-সমুদ্র থেকে গ্রহণ করতে পারে। যার ঘট যত বড়, সে তত বেশি করেই পাবে। যে সে-প্রসাদ নিতে জানল না, সে বনসিব; যে পারল না, তার দুর্ভাগ্য।

সংস্কৃত আলঙ্কারিকেরা কাব্যাস্বাদনকে ব্রহ্মাস্বাদ সহোদর বলেছেন। তেমন মহৎ কাব্যরস রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষায় আমাদের দিয়ে গেছেন। আমাদের এ সৌভাগ্যের তুলনা নেই। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণের ও কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। জয়তু রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্ৰমানসের স্বরূপ সন্ধানে

০১.

১৯৬১ সনে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের উপর পাশ্চাত্য প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে বিপন্ন। হয়েছিলেন। হয়তো তাঁর উক্তিতে সৌজন্যের অভাব ছিল, হয়তো ছিল রুক্ষতা। নইলে তিনি চক্রব্যুহে পড়বেন কেন! রবীন্দ্র-পাঠক-সমালোচক সবাই জানেন, রবীন্দ্রনাথের উপর য়ুরোপের প্রভাব প্রচুর। সমালোচকরা তা কখনো গোপন রাখেননি, ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বাঁকিয়ে বলেছেন মাত্র। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ প্রভাব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন, তিনি কোথাও গোপন করবার চেষ্টা করেছেন বলে তো মনে হয় না। বুদ্ধদেব বসুর কথাগুলো বড় কাটা কাটা ছিল, তিনি রেখে- ঢেকে বলবার চেষ্টা করেননি। ঋজু-পষ্ট কথায় শক্ত বাড়ে। বুদ্ধদেব বসু তাই নিন্দা-গালি পেয়েছেন। মানস-সংকীর্ণতা যাদের রয়ে গেছে, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে প্রাচীন ভারতের ও ঔপনিষদিক ঋষির আধুনিক রূপান্তর হিসেবে গ্রহণ করে আনন্দিত ও গৌরবান্বিত হতে চান। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যে তাঁরাই হয়েছিলেন অসহিষ্ণু।

.

০২.

পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের ছোঁয়া প্রথম যে বাঙালির অন্তরে লেগেছিল তিনি রামমোহন রায়। এই রামমোহনের ভক্ত ছিলেন দ্বারকানাথ আর ভাব-শিষ্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। রামমোহনের মনীষা ও উদারতা এঁদের ছিল না বটে, কিন্তু রামমোহন পশ্চিমের যে-জানালা খুলে দিলেন, তা বন্ধ করবার সাধ্য ছিল না কারো। রবীন্দ্রনাথ আশৈশব পেয়েছিলেন পশ্চিমের এই বাতায়নিক হাওয়া। তাঁর বড়ভাইরা বাড়িটাকে পাশ্চাত্য শিল্প, সাহিত্য ও সংগীত চর্চার কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের উক্তিতে প্রকাশ: আমি এসেছি যখন … (বাড়িতে) নতুন কাল সবে এসে নামল। –এ নতুন কাল পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে। তাছাড়া য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের বিভায়, ফরাসি বিপ্লবের মহিমায় এবং তাঁর সমকালীন প্রতীচ্য বুর্জোয়া সমাজের কল্যাণবুদ্ধি ও আত্মার ঐশ্বর্য দর্শনে তিনি মুগ্ধ ছিলেন। এ মানস-সম্পদ আহরণে তাঁর প্রযত্নও কম ছিল না। ইংরেজকে তিনি জেনেছেন য়ুরোপের চিত্তদূতরূপে, মানুষের মূল্য, মানুষের শ্রদ্ধেয়তা হঠাৎ এত আশ্চর্য বড়ো হয়ে দেখা দিল কোন্ শিক্ষায়?… বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সম্বন্ধেও ঠিক সেই একই কথা।… প্রতি দিন জয় করেছে সে জ্ঞানের জগৎকে, কেননা তার বুদ্ধির সাধনা বিশুদ্ধ, ব্যক্তিগত মোহ থেকে নির্মুক্ত। (কালান্তর)।

কোনো বা কারো ভাব-চিন্তা-আচরণ নিজের মতো করে গ্রহণ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। স্বীকরণ বা স্বাঙ্গীকরণও সামর্থ্য-সাপেক্ষ কাজ। সে সবাই পারে না–সাধারণে পারে না। তার জন্যেও প্রতিভার প্রয়োজন। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলেই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রপ্রতিভার অসামান্যতা বোঝা যাবে।

.

০৩.

নতুনকে বরণ করার ব্যাকুলতা সত্ত্বেও ঈশ্বরগুপ্ত যে নতুনকে গ্রহণ করতে পারলেন না, সে তো শক্তির অভাবে নয়– শিক্ষার অভাবে। আসলে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালির চোখ ধাঁধিয়ে ছিল, মন রাঙাতে পারেনি; তাই অমন যে বিদ্বান ও প্রাণবান মধুসূদন, তিনিও পারলেন না কোলরিজ-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-শেলী-কীটস্-টেনিসনের ভাবাকাশের ভাগী হতে। বিএ পাস হেম-নবীনও পেলেন না গীতিকবিতার প্রাণের সন্ধান। বিহারীলালের সম্ভাবনাও যে তাত্ত্বিকতার মরুবালিতে দিশা হারাল, সে তো ইংরেজি না-জানার জন্যেই। দেবেন্দ্রনাথ সেন কিংবা অক্ষয়কুমার বড়ালের গীতোচ্ছাসেও কৃত্রিম অনুকৃতি যতটা আছে, আত্মার সাড়া নেই ততটা। আর কত বলব!

রামমোহনের পরে পাই বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তকে, যারা য়ুরোপীয় ভাব-চিন্তা ও বিজ্ঞানকে বরণ করবার জন্যে ছিলেন উন্মুখ, কিন্তু তাঁরা সৃজনশীল নন। সৃজনশীল প্রতিভা নিয়ে যিনি য়ুরোপকে নিজের মতো করে এবং প্রয়োজন বুদ্ধি নিয়ে গ্রহণ করতে জেনেছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। তার কথা পরে হবে। তার আগে খাস ঠাকুর পরিবারেই দেখা যাক। দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে হিন্দুয়ানীর উপরে উঠতে পারলেন না, সেকি ঔপনিষদিক জ্ঞানের অভাবে! তা হলে মানতেই হবে, গাহিকাশক্তি ও গ্রহণের আগ্রহ থাকা চাই। মনের দুয়ার খুলে দিয়ে চিত্তলোকে আসন পেতে দেবার মতো সংস্কার-মুক্তি ও উদারতা না থাকলে কোনো নতুনকেই বরণ করা যায় না পাওয়া যায় না নতুনের প্রসাদ!

নতুনের তরঙ্গাভিঘাত গায়ে দাগ কাটতে পারে কিন্তু মনে রঙ লাগাতে পারে না। তার প্রমাণ দুশ বছর ধরে ঘরে-বাইরে দেখা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য-প্রভাবিত আধুনিক জীবনের কিছুই গ্রহণ করতে পারেনি টোল-মাদ্রাসার লোক। এসব যে তারা এড়িয়ে চলে, সে কি মন্দ বলে, না বিচারশক্তির অভাবে? সে-জগতে এখনো মধ্যযুগ– এখনো বিদিশার নিশা কেন, ইংরেজি ভাষাবাহী আলোর অভাবেই তো। য়ুরোপের চিত্তদূত ইংরেজ বা ইংরেজির সঙ্গে পরিচয় না ঘটলে আমরা কি অন্তহীন মধ্যযুগ অতিক্রম করতে পারতাম, পাশ্চাত্য প্রভাব ব্যতীত আফ্রো-এশিয়ার কোথাও মধ্যযুগের অবসান ঘটেছে কি? এ সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই যে, পাঁচশ বছর আগে সূর্য উদিত হয়েছে পশ্চিমে–সেই যেদিন ইতালিতে রেনেসাঁসের শুরু। পাঁচশ বছর ধরে ভাব-চিন্তা-জ্ঞানের রশ্মি বিকীর্ণ হচ্ছে পশ্চিম থেকেই। সে-রশ্মি থেকে যে মুখ ফেরাবে সেই বেঁচে-বর্তে থাকার অধিকার থেকে নিজেকে করবে বঞ্চিত। বিজাতীয় বলে সঞ্জীবনী-রশ্মির আলোয় অবগাহনে লজ্জাবোধ করা নির্বোধের আহাম্মকি মাত্র। কেননা কল্যাণপ্রসূ ভাব-চিন্তা-জ্ঞান চন্দ্র-সূর্যের মতোই মানুষ অবিশেষের সাধারণ সম্পদ। আকাশে চন্দ্র-সূর্যের স্থিতি অনুসারে প্রভাবের তারতম্য ঘটে, কিন্তু প্রয়োজনের হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না।

.

০৪.

প্রতীচ্য প্রভাবিত জীবনচেতনা দুইভাবে প্রকটিত হয়েছে। একটা হচ্ছে প্রতীচ্য চিন্তা ও আদর্শকে সোজাসুজি স্বাঙ্গীকরণের প্রয়াস–এ প্রয়াস ছিল রামমোহন, বিদ্যাসাগর, সৈয়দ আহমদ, রবীন্দ্রনাথ ও জওয়াহেরলাল নেহেরুর।

আর একটি ছিল গ্রহণ-বর্জনের মধ্যপন্থায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় প্রয়াস–এটি মূলত নির্মাণ ক্রিয়া নয়–মেরামতি কর্ম। এ আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, সৈয়দ আমীর আলী, জালালউদ্দিন আফগানী, ইকবাল, গোখেল, তিলক, গান্ধী প্রমুখ।

এ দ্বিতীয় দলের জাতীয় অভিমান অত্যন্ত প্রবল ছিল। তারা প্রকাশ্যে য়ুরোপীয় কিছু গ্রহণ করতে অপমান বা লজ্জাবোধ করতেন। তাই তাঁরা খিড়কিদোর দিয়েই য়ুরোপকে জানালেন সম্ভাষণ, বরণ করলেন নেপথ্যে কিন্তু সমাদরে। এঁদের মধ্যে আবার বঙ্কিম, ইকবাল ও গান্ধীর স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক চেতনা ছিল প্রায় উগ্র-গোঁড়ামিরই নামান্তর। এরা আধুনিক জীবনচেতনা এবং অগ্রগতির ইঙ্গিত ও পাঠ লাভ করলেন য়ুরোপ থেকে, কিন্তু ঠাটটা রাখতে চাইলেন পুরোপুরি দেশী–যাতে মনে হবে দেশের অবহেলিত পুরানো ঐতিহ্য ও আদর্শরূপ গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়ার ফলেই যেন দেহের জরা ঘুচে এল যৌবনের উত্তাপ, মনের জড়তা ঘুচে জাগল প্রাণের সাড়া, কুটিরের জীর্ণতা ছাপিয়ে এল প্রাসাদের জৌলুস।

.

০৫.

বঙ্কিম-সাহিত্যেও মিলবে আমাদের এ ধারণার সমর্থন। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব-অনুশীলনী-কৃষ্ণচরিত্র সাম্যবাদ রচনার পেছেনে যে জীবনচেতনা, আদর্শ ও প্রেরণা ক্রিয়া করেছে, তা তিনি দেশ থেকে পাননি। তাঁর লোকরহস্য বা কমলাকান্তের দপ্তরে যে দৃষ্টির পরিচয় মেলে, তা ইংরেজি-না-জানা লোকে লভ্য নয়। বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ নিরোধ আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্র যোগ দেননি, কিন্তু য়ুরোপীয় monogamy তার মন হরণ করেছিল। নইলে, এই বহুপত্নীকতা ও উপপত্নীকতার দেশে বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষ, কপালকুণ্ডলা ও কৃষ্ণকান্তের উইল-এর মতো tragedy রচনা করতে পারতেন না। সমাজে যা সমস্যাই নয় বরং রীতি, তা-ই তাঁর উপন্যাসে জীবন-বিধ্বংসী প্রাণ বিনাশী সমস্যা হয়ে উঠল কী করে! ইংরেজ civilian ও তাঁদের পত্নীরাই ছিল বঙ্কিমের আদর্শ নারী-পুরুষ। তাই মাতৃঘটিত কলঙ্কের দায়ে যে বধূ পরিত্যক্তা হল, পরপুরুষের সঙ্গে যে দস্যুবৃত্তি বা রাজনীতি করে বেড়াল, সেই প্রফুল্ল আবার উনিশ শতকী হিন্দুর ঘরে সমাদরে বৃতা হল, প্রতিষ্ঠিতা হল সগৌরবে। এ উদারতা কি ভারতীয়? কাজেই বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুয়ানী অনেকটা ভেতরের কোট-প্যান্টালুনের উপর ধুতি-চাদর পরার মতো। ইকবালের ইসলামী জীবনও অনেকটা এরূপ। আর একটি লক্ষণীয় বিষয়–উনিশ বিশ শতকে প্রতীচী প্রভাবিত হিন্দুর জীবনচেতনা গীতার আদর্শ ও প্রভাবের প্রলেপে বিকাশ লাভ করেছে। রেনেসাঁসের মর্মবাণী, মানবমূল্য বা মানবমহিমা–তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেনি। বঙ্কিম-বিবেকানন্দ, অরবিন্দ-সুভাষচন্দ্র কিংবা গোখেল তিলক-গান্ধী সবাই গীতাপন্থী। কেবল রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, জওয়াহের লালে প্রত্যক্ষ করি ব্যতিক্রম। কেননা তারা য়ুরোপীয় রেনেসাসের আত্মার সন্ধান পেয়েছিলেন। সাগর যে দেখেছে, সরোবরে কি তার মন ওঠে!

.

০৬.

য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের চরম ফল মানবতাবোধ তথা মনুষ্যত্ব ও মানবমহিমার উপলব্ধি। একালে নিৰ্বর্ণ মানবতায় দীক্ষা খ্রীস্টান য়ুরোপ থেকেই আসে– আসলে আসে বুর্জোয়া য়ুরোপ থেকে। এই বুর্জোয়া সমাজ রেনেসাঁসের ঐতিহ্যে লালিত। য়ুরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের স্বর্ণযুগে রবীন্দ্রনাথের কৈশোর-যৌবন কেটেছে। তখন য়ুরোপীয় কবি, মনীষী, দার্শনিক বিজ্ঞানীদের ভাব, চিন্তা ও জ্ঞানের দীপ্তিতে রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট নন কেবল, একেবারে অভিভূত। য়ুরোপীয় আত্মার ঐশ্বর্যে তিনি মুগ্ধ! রবীন্দ্র প্রকৃতির অনুগ ছিল বলে বিশ্বমানবের অদ্বয় সত্তায় তার আস্থা দৃঢ়তর হয়। প্রকৃতি প্রীতি রবীন্দ্র- স্বভাবের অঙ্গ। সৌন্দর্য আমার পক্ষে সত্যিকার নেশা, আমাকে সত্যি সত্যি ক্ষেপিয়ে তোলে। (ছিন্ন পত্রাবলী পৃ. ২৫)।

বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক সত্তার বোধ তাঁর কৈশোরেই জাগে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্ভোগের মাধ্যমেই তাঁর চিত্তে বিশ্বাত্মার ধারণা দানা বাঁধে। এই ঐক্যবোধের বিকাশে প্রকৃতি ও জীবজগতে একক সত্তা এবং একাত্মার বোধ জন্মে। এ কাব্যিক-চেতনাই য়ুরোপীয় মনীষার প্রভাবে মানবাত্মার অভিন্নতায় ও মানবমহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে নির্বৰ্ণ বিশ্বমানবপ্রেমরূপে মহিমান্বিত হয়। য়ুরোপ থেকে পাওয়া এই ঔদার্যবোধ, এই বিশ্বাত্মবোধ এবং মানব নির্বিশেষের সহযোগ ও সহঅবস্থান নীতির সাদৃশ্য ও সমর্থন খুঁজে পেয়েছেন কবি উপনিষদে, বুদ্ধের বাণীতে, মধ্যযুগের সন্তদের সাধনায় ও বাউলের কণ্ঠনিঃসৃত গানে! এসব ভারতের নিজস্ব সাধনা ও মনীষার ফসল।

উপনিষদ থেকে বাউলের বাণী অবধি কোনোটাই ভারতে অজ্ঞাত ছিল না। শঙ্কারাচার্য উপনিষদকে জনপ্রিয় করেছিলেন, কিন্তু এগুলো আধ্যাত্মিক ছাড়া অন্য তাৎপর্যে কখনো গৃহীত হয়নি। এদেশে। বৌদ্ধধর্ম যেমন তার জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে; উপনিষদ যেমন স্মৃতি, পুরাণ ও গীতার চাপে পড়ে গুরুত্ব হারিয়েছে; সন্তক-পন্থীরা তেমনি সমাজচ্যুত হয়ে মঠে-মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। অতএব এগুলোকে নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করার প্রেরণা ও দীক্ষা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন য়ুরোপ থেকেই। তাঁর কাব্য-নাটকের প্রতিপাদ্য হয়েছে ঔপনিষদিক বিশ্বাত্মবাদ, বৌদ্ধ করুণা ও মৈত্রীতত্ত্ব, সন্ত-বাউলের প্রীতি ও অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা। এই বোধের আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, নির্দেশ করেছেন সমাজ সংগঠনের উপায়, আদর্শ খুঁজেছেন রাজনীতির, ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের ধর্ম, দিশা পেয়েছেন জীবনচর্যার।

মনুষ্যত্ব ও মানবমহিমা ঘোষণাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্রত। বৌদ্ধ ও হিন্দু ভারত থেকে তিনি এই মানবমহিমা প্রকাশের উপযোগী উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। তাই ত্যাগে বা ক্ষমায়, দুঃখে বা দ্রোহে, সেবা বা সহিষ্ণুতায়, চরিত্রে বা প্রত্যয়ে, প্রীতিতে বা প্রেমে, আত্মসম্মানে বা কর্তব্যনিষ্ঠায়, শ্রদ্ধায় বা অনুরাগে, আদর্শ চেতনায় বা সংকল্পে, আত্মিক বিশ্বাসে বা ন্যায়সত্যের প্রতিষ্ঠায় মানুষ যেখানে মহৎ সেই কাহিনী, ঘটনা বা চিত্ৰই তিনি তাঁর রচনার অবলম্বন করেছেন। অর্থাৎ আধুনিক য়ুরোপীয় জীবনচেতনা প্রাচীন ভারতীয় কাহিনীর মাধ্যমে আজকের বাঙালির উদ্দেশে পরিব্যক্ত। বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতির মতো মানুষ যেখানে ক্রোধ, ক্ষোভ, স্বার্থ ও হিংসাবশে বাহুবল সম্বল করে দ্বন্দ্ব সংঘাত-সংগ্রামে রত, তেমন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক কাহিনী বা ঘটনা অবলম্বনে জাতীয় শৌর্যবীর্য ও গৌরব প্রকটনে তিনি উৎসাহ বোধ করেননি।

.

০৭.

রবীন্দ্রনাথের এই জীবনদৃষ্টি–এই আদর্শচেতনা য়ুরোপ থেকে পাওয়া এবং রেনেসাঁসের দান। আমরা–বাঙালিরা জানি, গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য নয়–এমনকি জনপ্রিয় কাব্যও নয়। অথচ য়ুরোপে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা গীতাঞ্জলির কবিরূপেই। কেননা গীতাঞ্জলিতে অধ্যাত্মতত্ত্ব আছে, যা য়ুরোপে নতুন ও প্রয়োজন। বিশেষ করে বুর্জোয়াসমাজ যখন ধনে-মনে কাঙাল হয়ে উঠছে, আত্মধ্বংসী সাম্রাজ্যিক দ্বন্দ্বে যখন রাজ্যগুলো পরস্পরের উপর মরণবাণ ছোড়বার জন্যে তৈরি, বুদ্ধিজীবীরা ও হৃদয়বান মানুষেরা যখন স্বস্তি-শান্তির উপায় সন্ধানে অস্থির; য়ুরোপীয় বিবেকের সেই মৃত্যু-মুহূর্তে গীতাঞ্জলি অধ্যাত্মরস সিঞ্চন করে বিক্ষুব্ধ আত্মার জ্বালা নিবারণে ক্ষণিকের জন্যে সহায়ক হয়েছিল।

তাঁর অন্যান্য কাব্য-গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক য়ুরোপে তেমন সমাদৃত হয়নি। কেননা সেসবের মধ্যে যে বাণী আছে, তা য়ুরোপে দুর্লভ নয়–অজ্ঞাতও নয়, বরং য়ুরোপের মানস সম্পদের প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্র-রচনায় যেখানে অধ্যাত্মবুদ্ধি ও তত্ত্বরস আছে, য়ুরোপ তাকেই দুর্লভ সম্পদ জ্ঞানে বরণ করে আনন্দিত হয়েছে।

এ যুগে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখে প্রাচ্যের মহত্তম প্রতিভা, শ্রেষ্ঠ মনীষী, প্রতীচ্য আত্মার দূত, আধুনিকতার বাণীবাহক, মানবতা, মানবিকতা ও বিশ্বজনীনতার উদগাতা যুগন্ধর ও যুগস্রষ্টা। কিন্তু য়ুরোপের চক্ষে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি ও মনীষী মাত্র।

লালন শাহ্

লালন শাহ্

সাধক কবি লালন শাহর কথা বলতে হলে একটু ভূমিকা দরকার। মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন প্রশ্ন। রয়েছে, তারই মনোরম জবাব খোঁজার প্রয়াস আছে আমাদের তত্ত্ব–সাহিত্যে। বাউল গান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সুফীমতের প্রত্যক্ষ সংযোগে বাউলমতের উদ্ভব হলেও, এর মূল রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই যে-কোনো ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে মানস-শুচিতার সহায়ক বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যে উপাসনাকালে দৈহিক পবিত্রতা আবশ্যক হয়। মনে হয়, এ বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। যোগে, সাংখ্যে, বৌদ্ধদর্শনে ও সুফীসাধনতত্ত্বে দেহকে বিশেষ মূল্য দেয়া হয়েছে। দেহের আধারে যে চৈতন্য, সেই তো আত্মা। এ নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ-জিজ্ঞাসা শরীরতত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে : দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধন-তত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অসামান্য। তাই এদেশে অধ্যাত্মসাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। যোগ-সাধন পাক-ভারতের আদিম অনার্যশাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা দেখা যায়। বাঙলায় পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই মধ্যযুগে সুফীপ্রভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মতরূপে প্রসার লাভ করে। এভাবে চর্যাপদের পরিণতি ঘটে বাউল গানে ও সহজিয়া পদে।

মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু-মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথম দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তর ভারতে এবং সর্বশেষে বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ–ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দু মায়াবাদ তজ্জাত ভক্তিবাদ ও ইসলামের সুফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। উত্তর ভারতের সন্তধর্ম, দক্ষিণভারতের ভক্তিধর্ম আর বাঙলার বৈষ্ণব ও বাউলমতবাদ সুফীমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। সেদিন নির্যাতিত নিম্নশ্রেণীর মনে ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রী যে আবেগ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদের পথে না গিয়ে উদার আকাশের তলে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পাতাবার এ নতুনতর প্রয়াস মাত্র। জীবনের যে-চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা; উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজচেতনার ঊর্ধ্বে উঠতেই হয়। তখন মনে হয়, যদিও হিন্দু ধাবই দেহরা মুসলমান মসীত। কিন্তু সেখানে আল্লাহ নেই। তাদের মতে এই বিপথগামীদের আল্লাহ বলছেন–

মো কো কঁহা ছুঁড়ো বন্দে মৈ তো তেরে পাসমে।
না র্মৈ দেবল, না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাসমে।

জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপন আত্মার পরিশুদ্ধিই খোদা-প্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই এঁদের প্রাথমিক ব্রত। এঁদের আদর্শ হচ্ছে Knoweth thyself, আত্মাং বিদ্ধি–নিজেকে চেনো। হাদিসের কথায় মাআরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু।–যে নিজেকে চিনেছে, সে–আল্লাহকে চিনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা সে-খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে-পরমাত্মা হচ্ছেন–মনের মানুষ, অচিন পাখি, মানুষরতন, মমনুরা ও অলখ সাই (অলক্ষ্য স্বামী) প্রভৃতি। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে-রূপক দেহধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত।

মোটামুটিভাবে সতেরো শতকের দ্বিতীয়পাদ থেকেই বাউল-মতের উন্মেষ। মুসলমান মাধববিধি ও আউলচাঁদই এ মতের প্রবর্তক বলে পণ্ডিতগণের ধারণা। মাধববিধির শিষ্য নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্রই বাউল-মত জনপ্রিয় করেন। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ।

লালনের সঠিক জীবনকথা আজো জানা যায়নি। তাঁর সম্বন্ধে রূপকথার মতো নানা কাহিনী চালু আছে। লালন সম্বন্ধে সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য যে তথ্য পাওয়া যায়, তা এই:: লালন হিন্দুসন্তুতি। অল্প বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি শ্রীক্ষেত্রে তীর্থযাত্রা করেন। ফেরার পথে তিনি বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে পথে ফেলে বাড়ি চলে যায় এবং তাঁর মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দেয়। সিরাজ ফকির নামের এক নিঃসন্তান গরিব লকিবাহক তাঁকে পথ থেকে তুলে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। স্বামী-স্ত্রীর সেবাযত্নে লালন প্রাণে বাঁচলেন। কিন্তু একটি চোখ হারালেন। লালন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু মুসলমানের অন্ন খেয়েছেন বলে ঘরে উঠতে পারলেন না, তাঁর স্ত্রীও জাতিচ্যুত স্বামীর অনুগামী হতে অস্বীকার করলেন। এতে লালনের বিক্ষুব্ধচিত্তে বৈরাগ্য দেখা দেয়। তিনি আশ্রয়দাতা সাধক সিরাজের কাছে ফিরে আসেন ও তাঁকে গুরুপদে বরণ করেন। ১৮২৩ সালের দিকে লালন নানা তীর্থ পর্যটনের পর কুষ্টিয়ার গোরাই নদীর ধারে সেঁউড়িয়া গায়ের জোলাজাতীয় মুসলিম-স্ত্রী গ্রহণ করে এখানেই বাস করতে থাকেন।

কুমারখালির কাছাকাছি কোনো গায়ে লালনের পৈত্রিক নিবাস ছিল। আর সিরাজ সাঁইয়ের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার কালুখালি স্টেশনের কাছাকাছি কোনো গায়ে। ১৭৭৪ খ্রীস্টাব্দে(?) দীর্ঘজীবী লালনের জন্ম এবং ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর শুক্রবারে(?) তাঁর মৃত্যু হয় বলেই অধিকাংশ পণ্ডিতের মত। লালন কায়স্থ সন্তান ছিলেন। কেউ বলেন তাঁর কুল-বাচি ছিল কর, আবার কারুর মতে, দাস। সেঁউড়িয়ায়ই লালন দেহত্যাগ করেন। এখানে তার মাজার আছে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত দুদুশা রচিত লালন চরিত-এর অকৃত্রিমতা নানা কারণে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমী, জামী ও হাফেজের সগোত্র এবং কবীর, দাদু ও রজবের উত্তরসাধক। লালন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তাঁর গান লোকসাহিত্য মাত্র নয়–বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর। আমাদের উনিশ শতকী পাশ্চাত্যমুখিতার জন্যেই তাঁর যথাযোগ্য আদর-কদর হয়নি। তবু আড়াই লক্ষ বাউলের তিনি গুরু–জীবনপথের দিশারী।

লালন বলেন—

এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।
ডুবে দেখ দেখি মন তারে; কিরূপ লীলাময়।
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ এই দেহে তিনি রয়।

অথবা,

দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ।
ডাকলে কথা কয়
তোমার মনের মধ্যে আর এক মন আছে গো
তুমি মন মিশাও সেই মনের সাথে।

রবীন্দ্রনাথও বলেন–

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি
হৃদয় পানে চাইনি।

অথবা,

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারি সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।

কিংবা,

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।

রুমীও বলেন—

-I gazed into my own heart
There I saw Him, He was nowhere else.

আনল হক ধারণার প্রতিধ্বনি শোনা যায় লালনের মুখে–

আপন সুরতে আদম গড়লেন দয়াময়
নইলে কী আর ফেরেস্তারে সেজদা দিতে কয়।…
লালন বলে আদ্য ধরম আদম চিনলে হয়।
এবং আত্মা আর পরমাত্মা ভিন্ন ভেদ জেনো না।

আসল কথা

আপনার আপনি যদি চেনা যায়।
তবে তার চিনতে পারি সেই পরিচয়।

কেননা,

যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন
যেমন বাজায় বাজে তেমন
তেমনি যন্ত্র আমার মন
বোল তোমার হাতে।

জাত-বিচার সম্বন্ধে লালন প্রশ্ন করেন–

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন কয়, জেতের কী রূপ, দেখলাম না নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী-লোকের কী হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনী চিনি কী ধরে?

দেহাত্মবাদী লালন বলেন :

উপাসনা নাইগো তার
দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থ ব্রত যার জন্য।
এ-দেহে তার সব মিলে।

কাজেই

ক্ষ্যাপা, তুই না-জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না-বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।
আমি যেরূপ, দেখ না সেরূপ দীন দয়াময়।

পরমাত্মা এ আত্মারই দোসর। কাছে থাকে, দেখা দেয় না, ধরা যায় না, এ জ্বালা কী হৃদয়ে সয়! তাই ক্ষোভ, তাই বেদনা :

আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
তারে জনম ভর একবার দেখলাম নারে।
কথা কয়রে দেখা দেয় না
নড়ে-চড়ে হাতের কাছে।
খুঁজলে জনম-ভর মেলে না

তাই—

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশী নগর।
এক পড়শী বসত করে।

তার কারণ

জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়,
ধরতে গেলে হাতে কে পায়।
তেমনি সে থাকে সদায় আলেকে বসে।

লালণের কণ্ঠে মানব মনের চিরন্তন কামনা ধ্বনিত হয়েছে :

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

কিংবা

কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশ বেড়াই ঘুরে।

লালনের ও বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনায় বাউল প্রভাবও কম নয়। তাঁর ভাষাতেই আলোচনা শেষ করছি : (বাউল গান) থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়।… এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে।–এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।

লালনের গান আমাদের মূল্যবান সাহিত্য ও মানস-সম্পদ।

শাহাদাৎ-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য

সবদেশেই পাঠ্যপুস্তক অবলম্বন করেই বিদ্যার্জন শুরু হয়। কিন্তু কোনো কোনো দেশে এর বাইরের বিদ্যাও আয়ত্ত করবার সহজ সুযোগ ঘটে। বাঙলাদেশে আমরা যে-পরিবেশে লেখাপড়া করেছি বা এখনও পল্লী অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে যে-আবহাওয়া বিদ্যমান, তা পাঠ্যবইএর বাইরের বিদ্যার্জনের পক্ষে খুব অনুকূল নয়। কাজেই পাঠ্যবই-এ যাঁদের রচনা থাকে না, তাঁরা যতবড় প্রতিভাই হোন না কেন, নেহাত সাহিত্যানুরাগী ব্যতীত আর কারো কাছে তাদের লেখা দূরে থাক, নামও পৌঁছে না। এজন্যেই শক্তিমান কবি হওয়া সত্ত্বেও মোহিতলাল মজুমদার ও শাহাদাৎ হোসেন শিক্ষিত-সাধারণের কাছে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না।

স্কুলপাঠ্যবইএর উপযোগী কবিতার অভাবহেতু শাহাদাৎ হোসেন বা মোহিতলাল জনপ্রিয় বা প্রখ্যাত কবি হয়ে উঠতে পারেননি। অথচ রবীন্দ্র-যুগে যে-কয়জন বিশিষ্ট কবি বাঙলা কাব্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছেন, এঁরা তাঁদেরই সমস্থানীয়।

যখন স্কুলে পড়ি, তখন পাঠ্যপুস্তকে যাদের রচনা থাকত, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। তাদের এক-একজন মনশ্চক্ষে বিস্ময়কর ব্যক্তিরূপে প্রতিভাত হতেন। এখন বয়োধর্মে শ্রদ্ধাবিগলিত চিত্তের সে-উচ্ছ্বাস হ্রাস পেয়েছে অবশ্য, কিন্তু শ্রদ্ধা জাগরূকই রয়েছে। বাল্যে ও কৈশোরে যে কয়জন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের নাম ও লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, কবি শাহাদাৎ হোসেন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ মৃদঙ্গ এবং উপন্যাস রিক্তার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। মৃদঙ্গের ভাষা বা বক্তব্য বুঝবার বিদ্যা বা বয়স আমার ছিল না। তবু কবির কাব্য! শ্রদ্ধা জাগাবার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট ছিল। রিক্তা গদ্য-বই, উপন্যাস, সুতরাং ভালো তো বটেই!

নানা ব্যাপারে শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলালের মধ্যে মিল আছে, সেজন্যেই শাহাদাৎ হোসেন প্রসঙ্গে মোহিতলালের কথাও মনে জাগে। শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলাল ক্লাসিকধর্মী কবি। তবু তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং য়ুরোপীয় ভাবাদর্শের প্রভাব কম নয়। এতৎসত্ত্বেও তাদের কাব্যে যে-বস্তুটা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে কাব্যের আঙ্গিক বা কবিতার diction। শব্দ চয়নে আশ্চর্য নৈপুণ্য, ছন্দে গাম্ভীর্য ও লালিত্য, ভাবাদর্শের আভিজাত্য, প্রকাশভঙ্গির সৌষ্ঠব ও সংযম তাঁদের কাব্যকে শ্রীমণ্ডিত করেছে। তারা উভয়েই আদর্শবাদী ও শিল্পী। ব্যবহারিক জীবনের রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু-ব্যথা, অথবা নিজের বা মনুষ্য-সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভাব-অনটন, অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনী মোহিতলালের কাব্যে স্থান পায়নি। শাহাদাৎ হোসেনেও খুবই কম। তার কারণ, তাঁরা ছিলেন রোমান্টিক কবি বাস্তব বিমুখ, কল্পলোকবিহারী! তাঁদের কাব্য প্রেরণার উৎস এ জগৎ ও জীবন নয়! প্রত্যক্ষ বাস্তবজীবনের হাজারো দুঃখ-বেদনা-লাঞ্ছনা-হতাশা-গ্লানি ভুলে থাকবার তাগিদে তাঁরা মনোময় কল্পলোক রচনা করে তাতে নির্দ্বন্দ্বে ও নির্বিঘ্নে সানন্দে জীবন উপভোগ করেন–জীবনে; যে কল্পসাধ মিটানো যায়নি, সে সাধ মিটেছে গানে, জীবনে যা অসম্ভব, কল্পনায় ও স্বপ্নে তা-ই সম্ভব ও সার্থক হয়ে উঠেছে। সুতরাং কবি হিসেবে শাহাদাৎ হোসেন মুখ্যত বাস্তবমুখী নন–কল্পাশ্রয়ী। তাঁর সমধর্মী কবি মোহিতলাল বলেন :

জীবন যাহার অতি দুর্বহ, দীন দুর্বল সবি
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সেইজন বটে কবি।

কারণ—এতে

ঘুচে যাবে খেদ, যত ভেদ ভয়,
কায়া আর ছায়াবৃথা সংশয়।
স্বর্গ হইবে ধরা।

শাহাদাৎ হোসেনের হৃদয়েও অমৃতের তৃষ্ণা, তিনিও মর্ত্যের সৌন্দর্যে, ধরিত্রীর যৌবন-লাবণ্যে বিমুগ্ধ হয়ে নেমে আসেন দেবতাদের মতো মর্তবিহারে। ধরণীর আবিলতা ও গ্লানি তাঁকে স্পর্শ করবার পূর্বেই তিনি চলে যান কল্পলোকবাসে। ধুলার ধরায় তিনি অতিথি। ধরণীর বনকুঞ্জে তাঁর আনন্দ প্রবাস চলেছিল মাত্র। কারণ, শ্যামায়িত সৌন্দর্যের ফুল্ল শতদল কবির রূপ-সৌন্দর্য-পিপাসু হৃদয়কে যে আকুল করে তুলেছিল!

মানসের কল্পদলে চিত্রিত মায়ায়
অনন্ত বসন্ত জাগে সান্দ্র নিরালায়।

তাই প্রকৃতির শ্যামল মায়ার বশে কবি কল্পতুলিকায় রূপচ্ছবি আঁকছিলেন। এছাড়া বিমুগ্ধ কবির উপায় ছিল না। কারণ–

যত দেখি, বাড়ে সাধ কী অপূর্ব প্রাণরসে
হয়ে থাকি ভোর,
অনুভূতি জেগে উঠে, শুষ্ক আঁখি ভিজে যায়,
গলে যায় হিয়া খানি মোর।

এজন্যেই বোধহয় প্রকৃতি (ঋতুপর্যায়) বিষয়ক কবিতায় শাহাদাৎ হোসেনের কবিপ্রাণ উচ্ছল হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে পাঠকের স্ব-স্ব মত-পথ-আদর্শ ও রুচি অনুসারে এ-কাব্যাদর্শের বিচার হবে। আজ সে বিতর্কের সময় নয়। তবে এ-কথা স্বীকার্য যে, জীবনবোধ মানুষ অবিশেষে কোনোকালেই একরূপ ছিল না এবং হয়তো মানুষ কোনোকালেই একমত হবে না।

মধুসূদন-প্রবর্তিত উনিশ শতকের ক্লাসিক-ধারার অনুসারী ছিলেন শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলাল। অর্থাৎ এরা মূলত রোমান্টিক কবি হয়েও বাহ্যত ক্লাসিকরীতির ধারক ছিলেন। তাঁদের উচ্ছ্বসিত কল্পনা, অনুভূতির তীব্র-গভীর আবেগ সংযমের আবরণে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভাস্করের মূর্তির ন্যায় তাঁদের কবিতার বহিঃরূপই অধিকতর ভাস্বর হয়ে উঠেছে। এজন্যে তাদের কাব্যকলাকে ভাস্কর্য ও তাঁদের ভাস্কর বলা চলে। এক কথায়, তাঁদের কবিতা Romantic in spirit এবং Classical in form. Romantic ভাবকল্পনাকে সুসংযত কথার ছাদে ও সুনির্বাচিত শব্দের নিগড়ে বেঁধে ভাবগর্ভ ও বর্ণাঢ্য করে তোলার মধ্যে আশ্চর্য শক্তির পরিচয় রয়েছে।

বিশ শতকে মোহিতলাল ও শাহাদাৎ হোসেন এবং আরো দুচারজন কবি কাব্যক্ষেত্রে এ দুস্তর সাধনা ও কলাকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। ভাষার ওজস্বিতায় ও লালিত্যে, উপমার ঘটায়, অলঙ্কারের ছটায়, ছন্দের ঝঙ্কারে, শব্দের সুনিপুণ চয়নে এঁদের কবিতাগুলো রসজ্ঞ রসবেত্তার আদরণীয় হয়ে থাকবে।

কবি শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে আমার যখন চাক্ষুষ পরিচয় হয়, তখন লক্ষ্য করেছি তাঁর চলনে-বলনে-পোশাকে একটা আভিজাত্যবোধের ছাপ ছিল। আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রবল; স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল সজাগ। তাঁর মন-মননেও এ আভিজাত্য ও স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল স্পষ্ট। এক কথায় তাঁর জীবনে ও মননে Love for grandeur ছিল। নাটক ও অভিনয়ের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণের মূলেও ছিল এই grandeur প্রবণতা।

আশ্চর্য, কৈশোরে কবিতার ডালি নিয়েই তাঁর সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ, যৌবনে যাত্রা-থিয়েটারের আকর্ষণই ছিল বেশি, তবু তিনি কবিতা ও নাটক লিখেছেন কম, অথচ উপন্যাস লিখেছেন বহু এবং উপন্যাসে তিনি আদর্শে ও রূপায়ণে বঙ্কিমচন্দ্রকেই অনুসরণ করেছেন; যেমন নাটকে করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে আর কাব্যের ভাষার ক্ষেত্রে করেছেন ভুজঙ্গর রায় চৌধুরীকে।

আনন্দকামী শাহাদাৎ হোসেন ও দেহাত্মবাদী মোহিত মজুমদার রস-সর্বস্ব (Art for arts sake) আদর্শের কবি। এরূপ কল্পনাশ্রয়ীদের জীবন সংঘাতমুখী নয়–একেবারে নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন। কিন্তু তবু তাদের অনুভূতির সে-জগৎ প্রশস্ত নয়। তাই তাঁদের কাব্যজগতে জীবনলীলার বৈচিত্র্য বিরল। নানাভাবে, বহুবিচিত্র ধারায় জীবনকে উপলব্ধি করবার প্রয়াস সেখানে নেই। তাদের প্রাণও তেমন উচ্ছল নয়–এ জন্যে তাদের ভাবাবেগেও উদ্দামতা নেই। স্বল্প পরিসরে অবশ্য অনুভূতি তীক্ষ্ণ ও গভীর। এ-কারণেই তাদের কবিতার ভাব গুপ্ত ও মন্দ-প্রবাহিণী।

শাহাদাৎ হোসেনের কবিতায় কল্পনার প্রসার ও ভাবের আশানুরূপ গভীরতা না থাক, কিন্তু তিনি ভাষার জাদুকর, ছন্দযোজনায়ও নৈপুণ্য আছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বহিঃরূপ ও গঠনসৌন্দর্যই তাজমহলকে মনোহারী ও বিশ্ববিখ্যাত করেছে–এর প্রসার বা বিস্তার নয়। তাই এসবের আলোচনা অবান্তর। শাহাদাৎ হোসেনের কবিতাও ছন্দ এবং শব্দের মহিমায় মনোহারী, পড়বার সময় ভাব-সৌন্দর্য বিচার করবার অবকাশ হয় না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা যে-কারণে সুন্দর ও সুখপাঠ্য; শাহাদাৎ হোসেনের কবিতাও সে-কারণে প্রশংসনীয়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যদি ছান্দসিক কবি বলে কীর্তিত হন, তবে শাহাদাৎ হোসেনও রূপকার বা ভাস্কর কবি বলে মর্যাদা পাবেন। কবিও হয়তো এ-বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তাই তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন রূপচ্ছন্দা।

কবি শাহাদাৎ হোসেন মুখ্যত রসলোক-বিহারী হলেও বাস্তব জীবনকে একেবারে উপেক্ষা করেননি। দেশ, জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অনুরাগও বহু কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। ইতিহাস-সচেতনতাও তাঁর তীক্ষ্ণ ছিল। আজাদী-প্রীতি এবং স্বদেশ-বাৎসল্যও তাঁর কম তীব্র ছিল না। তিনি যে বিশ্ব-মুসলিম জাতীয়তাবাদী (Pan-Islamist) ছিলেন, তা-ও তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে।

মোহিতলাল ও শাহাদাৎ হোসেন উভয়েরই আত্মবিশ্বাস ছিল অকৃত্রিম ও দৃঢ় এবং এঁদের কেউ আত্মপ্রচারে বা আত্মপ্রসারে আগ্রহশীল ছিলেন না। তাই তারা জনপ্রিয় হননি সত্যি, কিন্তু তারা যাদের কাছে যতটুকু সমাদর বা কদর পেয়েছেন, তাতে খাদ নেই, তা একান্তই খাঁটি। তাদের শক্তি ও প্রতিভার যে-স্বীকৃতি পাওয়া গেছে–তাপ্রচারে আদায় করা নয়; তা রসগ্রাহী চিত্তের। স্বেচ্ছানিবেদিত অভিব্যক্তিমাত্র। তাই Tennyson-এর কথায় উভয়েই বলতে পারেন–We shall dine late, but the dining room will be well-lighted, the guests few and select.

সৈয়দ এমদাদ আলীর সাধনা

উনিশ শতকের শেষদিককার আবহাওয়ায় ও ধ্যান-ধারণায় যাঁদের মন-মনন প্রভাবিত, বিশ শতকের গোড়ার দিকের সেসব সাহিত্যিকের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র ক্রমশ ছিন্ন ও অবলুপ্ত হয়ে আসছে। সৈয়দ এমদাদ আলীর প্রয়াণে আর একটি সূত্র ছিন্ন হল।

নতুনের সঙ্গে পুরাতনের সম্পর্ক এভাবেই ছিন্ন ও লুপ্ত হয়। নতুনকে ঠাই করে দিয়ে পুরাতন চিরকাল এভাবেই অতর্কিতে সরে পড়ে। পুরোনো বিবর্ণ পাতা কিশলয়কে অভিনন্দন জানিয়ে দায়িত্বমুক্ত হয়। বস্তুত জগৎ নিত্যনতুনের মেলা। একে ধরে রাখবার–ভরে থাকবার অধিকার কোনো পুরাতনেরই নেই। নতুন সূর্যের উদয়ে, নবতররূপে পৃথিবী উদ্ভাসিত ও সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে–এ-ই নিয়ম।

সৈয়দ এমদাদ আলী পরিণত বয়সেই ইন্তিকাল করেছেন! তবু আত্মীয়-বন্ধুর প্রাণে হারানোর বেদনা বাজবেই। কিন্তু আমরা যারা দূরের মানুষ, আমাদের দুঃখ অন্য কারণে।

পলাশীর পরাজয়ের পর সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের প্রথম আবির্ভাব উনিশ শতকের অষ্টম দশকে মীর মশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে। নবম দশকে পেলাম মোজাম্মেল হককে এবং শেষদশকে এগিয়ে এলেন কবি কায়কোবাদ ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এ সময়টাতে এঁদের যারা সহযোগী ছিলেন, আজ তাদের অবদানের বাহ্য-নিদর্শন বিশেষ কিছু নেই সত্যি; কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সমাজ-জীবনে ও অন্তর্লোকে তাঁদের প্রচেষ্টার প্রভাব প্রায় অপরিমেয়। এসব বিষয় যে আমরা শুধু ভুলে গেছি তা নয়, আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবার প্রয়াস পাচ্ছিনে, দুঃখ এজন্যেই। আর একজন যিনি জাতিকে গ্লানিমুক্ত ও অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন এবং বিজাতিকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাবান করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন, তিনি সৈয়দ আমীর আলী। কিন্তু সমাজ তখনো অশিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল বলে, তাঁর রচনার প্রভাবসুদূর প্রসারী হতে পারেনি। তাই তিনি শক্তিমান হয়েও মেঘলাদিনের মধ্যাহ্ন মার্তণ্ড-রূপেই আমাদের মনের আকাশে অস্পষ্ট হয়ে রইলেন। তাঁর সাধনা ছিল ইংরেজি ভাষা নির্ভর।

অপরদিকে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, স্যার সৈয়দ আহমদ, জামালউদ্দীন আফগানী, মওলানা কেরামত আলী প্রমুখ বহিবঙ্গীয় মনীষীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তিতুমির থেকে দুদুমিয়া অবধি অনেক স্বজাতিপ্রাণ ও কল্যাণকামী মনীষী মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে শোধন ও বোধনের জন্যে প্রাণপণ সাধনা করে গেছেন। আমাদের ভাগ্যদোষে এসব আজ রূপকথায় পরিণত হয়েছে।

মোটের উপর, এইসব মহাপ্রাণ মনীষীর প্রচেষ্টাতেই আমাদের জাতীয় জীবনে প্রাণস্পন্দন ফিরে আসে। বিদেশী শাসকের প্রতিকূলতা-লাঞ্ছিত ও প্রতিবেশীর শোষণ ও অবজ্ঞাপীড়িত সেদিনকার মুসলিমে নতুন করে জীবন-জিজ্ঞাসা জাগানো কিরূপ কষ্টসাধ্য সাধনার ব্যাপার ছিল; আজ তা, আমরা সম্যক উপলব্ধি করতে পারব না।

মুসলমানদের পদক্ষেপ যখন প্রাথমিক পর্যায়ের ভীরুতাও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তখন বাঙালি হিন্দুরা তাদের ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের ঐতিহ্য-সম্বল রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণকে অবলম্বন করে সাহিত্যে, সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্র-চেতনায় হিন্দুত্ব ও হিন্দুয়ানির পতাকা অনেক উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। মুসলমান সাহিত্যিকগণ অনুরূপ আদর্শ ও নীতি অনুসরণ করে জাতীয়সত্তা দৃঢ়মূল করবার প্রয়াসী হলেন। ফলে হযরত মোহাম্মদ কাব্য, হযরত মোহাম্মদের জীবন চরিত, শাহনামা, সৌভাগ্য স্পর্শমণি, বিষাদসিন্ধু, মহাশ্মশান, জাতীয় ফোয়ারা শ্রেণীর রচনা আমরা পেলাম। তাঁদের ধারণায় জাতীয় ঐতিহ্যভিত্তিক সাধনাই প্রগতির পথ! এজন্যে বাঙালি হিন্দুর অবলম্বন হয়েছে আর্যাবর্ত রাজস্থান তথা উত্তরভারত আর বাঙালি মুসলমান প্রেরণা খুঁজেছেন আরবে-পারস্যে।

আমরা আত্মবিস্মৃত ও আত্মসম্বিৎহীন জাতি বলেই সৈয়দ এমদাদ আলী সম্বন্ধে দুটো কথা বলবার জন্যে এত দীর্ঘ ভূমিকার দরকার হল। নতুবা কবিতার বই ডালি, পত্রোপন্যাস হাফেজা ও জীবন-কাহিনী রাবেয়ার লেখক এমদাদ আলী সম্বন্ধে সোজাসুজি দুটো কথা বললে, যে-কেউ ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার বাঁকা হাসি টেনে কথাগুলো এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে পারেন। কেননা এসব রচনার যথার্থ সাহিত্যমূল্য বেশি নয়।

আমাদের নজরুল-পূর্ব যুগের সাহিত্য-প্রচেষ্টা সম্বন্ধে বলা চলে, সেখানে সার্থক সাহিত্য-সৃষ্টি বিরল। কিন্তু তারা উত্তরপুরুষ ও উত্তরসাধকের জন্যে যে-ক্ষেত্ৰ কৰ্ষণ ও তৈরি করে রাখলেন, তার যথার্থ মূল্য নিরূপিত হলে একদিন আমরা শ্রদ্ধায় ও বিস্ময়ে অভিভূত হব–এ নিশ্চিত জানি।

১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে সৈয়দ এমদাদ আলীর জন্ম। তিনি উনিশ শতকের শেষ পাদে মুসলিম জাগরণের উন্মেষকালের আবহাওয়ায় বর্ধিত। তাঁর মন-মননের উপর জাতীয় হিতৈষণা ও কল্যাণকামিতার যে-প্রভাব পড়ে, তার তাগিদে-অন্তরজাত প্রতিভার আবেগে নয়–তিনি সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর মনের পরিচয় মিলবে তাঁর বাঙলা ও ইংরেজি প্রবন্ধগুলোতে আর তাঁর নবযুগ নামক অসমাপ্ত উপন্যাসে। এদিক দিয়ে বিচার করলে তার আদর্শ ও অবদানের আভাস পাওয়া যাবে তার মাসিক নবনূর পত্রিকার প্রকাশ ও পরিচালনায়। এ পত্রিকাখানি তার স্বল্পকাল-স্থায়ী জীবনে জাতির আলোকবর্তিকা ও দিশারী স্বরূপ ছিল। এজন্যে কেউ কেউ একে বঙ্গদর্শনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর সাধনার স্বরূপ সাহিত্যসৃষ্টিতে নয়–জাতিকে অনুপ্রাণিত করে গড়ে তোলার কাজের মধ্যেই খুঁজতে হবে।

এ ব্যাপারে আর একটি কথা আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে সে-যুগে যারা সাহিত্যক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন, তাঁদের কেউ উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, তেমন শক্তিমান লেখকও ছিলেন বিরল। প্রায় সকলেই হিন্দুলেখকদের বাঙলা রচনা পড়েই সাহিত্য সৃষ্টি করতেন। আরবি-ফারসি ভাষায়ও বিশেষে ব্যুৎপত্তির পরিচয় তাঁদের রচনা বহন করে না।

এমনি অবস্থায় তারা যা বলতে বা করতে চেয়েছেন, তাতে তাদের প্রাণগত সাধনা ও স্বজাতিবাৎসল্যের অপরিমেয় আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের সাধ যত ছিল, সাধ্য ততটুকু ছিল না। তাই তাঁদের হাতে তাঁদের অবদানের বাহ্য নিদর্শনস্বরূপ উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু পাইনি। কিন্তু যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য, যে আন্তরিকতা, উদ্যম ও অক্লান্ত সাধনা তাঁদের প্রচেষ্টাকে মহিমান্বিত করে রেখেছে, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধান্বিত না হলে, তাঁদের ঋণ স্বীকার না করলে, আজকের দিনে শুধু জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি নয়, নিজেদের প্রতিও অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের কাছে লিখিত এক পত্রে সৈয়দ এমদাদ আলী বলেছিলেন, যতই ক্ষুদ্র হই না কেন, আমরা সে-যুগে জাতির ভাগ্যাকাশে জ্যোতিষ্কস্বরূপ উদিত হয়ে জাতিকে দিশা দিতে চেষ্টা করেছি। অবিকল কথাগুলো আমার মনে নেই তবে ভাবটা এ-ই। একে কেউ তাঁর অহমিকার অভিব্যক্তি বলে ভাবলে তাঁর উপর অবিচার করা হবে। এতে তাঁর বা তাঁর সতীর্থদের সাধনার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই প্রকাশ পেয়েছে। পুরাতন ও প্রবীণদের আমরা ধরে রাখতে পারব না। কিন্তু পুরোনো ও প্রবীণের অবদানকে আমরা মহামূল্য পাথেয় করে রাখব। তা আমাদের জীবনে ও জাগরণে, সাধে ও সাধনায় কাজে লাগবে।

সৈয়দ এমদাদ আলী গেলেন কিন্তু তার আদর্শ আমাদের মধ্যে চিরন্তন হয়ে থাক–এ-ই কামনা করি।

সৌন্দর্যবুদ্ধি ও রবীন্দ্রমনীষা

০১.

রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য মানুষ। জীবন-প্রভাত থেকে মৃত্যু-মুহূর্ত অবধি তিনি নব নব রাগে বিচিত্র অনুভবে নিজেকে রচনা করে গেছেন। চিন্তার ও কর্মের বহুধা ও বর্ণালি অভিব্যক্তিতে তার জীবন বিপুল, বিচিত্র ও জটিল হয়ে প্রকটিত হয়েছে। বয়স তার যতই বেড়েছে, তার মনের দিগন্তও ততই হয়েছে প্রসারিত। বেড়ে গেছে তার ভাবাকাশের উচ্চতা ও পরিধি এবং সেহেতু হয়তো সরে গেছে সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই বলাকা-পূর্ব কাব্যের, গোরা-পূর্ব উপন্যাসের, অচলায়তন-পূর্ব নাটকের এবং গল্পসপ্তক-পূর্ব ছোটগল্পের পাঠকসংখ্যা যত বেশি, তার পরবর্তী রচনার সমজদার তত কম।

অতএব রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের শুরু আর শেষ একভাবে হয়নি। কোনো সত্যিকার প্রতিভাই ধ্রুবতায় অবসিত হয় না– হতে পারে না। কেননা অভাবিতকে ভাববদ্ধ করা, অচিন্ত্যকে চিন্তাগোচর করা, নিরবয়বকে অবয়ব দান করা প্রতিভার কাজ। প্রতিভা যুগের দান নয়– যুগের স্রষ্টা; অর্থাৎ প্রতিভা যুগের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, যুগকে প্রভাবিত করে। আমরা রবীন্দ্রনাথকে প্রতিভা বলে মানি। তাই তাঁর বক্র, বিপুল ও বিচিত্র সৃষ্টিপ্রবাহ যে-কোনো ঋজু সিদ্ধান্তের প্রতিকূল। আবার ভক্তি ও বিদ্বেষ–দু-ই যথাযথ ধারণা লাভের অন্তরায়। তাই কবির তিরোভাবের পঁচিশো বছর পরে রবীন্দ্র-বিচারে সতর্কদৃষ্টি ও অবিচলিত মন-মননের প্রয়োজন।

.

০২.

রবীন্দ্রনাথ আশৈশব সৌন্দর্যপিপাসু। এ পিপাসায় অনন্যতা আছে। কেননা এ সৌন্দর্যবোধ প্যাগান নয়, গ্রীক নয়, আধ্যাত্মিকও নয়। শৈশবে চাকর নির্দিষ্ট খড়ির গণ্ডি তার শারীর- বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করত বটে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিবাহী মানস-বিহার রোধ করা যায়নি। ফাঁক-ফুকরে প্রকৃতি-নিসর্গ তার হৃদয়দুর্গ দখল করে নিয়েছিল। বাধা ছিল প্রবল, তাই আগ্রহ হল তীব্র, অনুভূতি হল তীক্ষ্ণ। ফাটা দেয়ালের গুল্মফুল, পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছ, আকাশে মেঘের লীলা আর তারার অব্যক্ত বাণী শৈশবে-বাল্যে কবির মন ও হৃদয় হরণ করেছে। তাই আকাশচারিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের শুরু। আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নেমেছেন, ভূমি থেকে ব্যোমযাত্রা করেননি। গোড়া থেকেই অবশ্য মেশামেশি হয়ে গেছে ভূম আর ভূমায়, মাখামাখি ছিল জীবনে আর জগতে। কবি একেই জেনেছেন সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধন বলে। এ বোধের অনুগত ছিল বলেই বিহারীলালের কাব্য বালক-কবির মন জয় করেছিল। আর এ উপাদানের অভাবে মধূসূদনের কাব্য পেল তাঁর অবজ্ঞা।

.

০৩.

প্রকৃতি ও নিসর্গের সৌন্দর্যে মানুষ মাত্রই অম্লাধিক মুগ্ধ। কবিরা অনুভূতিপ্রবণ বলে তাদের উপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রভাব প্রবল। কিন্তু সাধারণ কবিতে তা যতখানি অর্জিতচেতনা, ততখানি অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যানুভূতি নয়। কিন্তু কোনো কোনো কবি-মনে সেরূপ চেতনা গভীর, ব্যাপক ও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। যে প্রকৃতি-চেতনা Words-worth-এর মনে বেদনাবোধ জাগিয়েছে, যে রূপ-অন্বেষা ও প্রেমানুভূতি শেলীকে আকাশচারী করেছে, যে সৌন্দর্যানুভূতি Keats-কে আনন্দিত করেছে, যে রূপমুগ্ধতা বিহারীলালকে তাত্ত্বিক করেছে, সেই সৌন্দর্যচেতনা রবীন্দ্রনাথে এনেছিল এক অনন্য অনুভূতি, একপ্রকারের মুগ্ধতা বা অভিভূতি, সারা জীবনেও কবি যার সীমা-শেষ খুঁজে পাননি। সে রূপ-মাধুরীর অনুভব কবিকে তিলে তিলে নতুন করে তুলেছে।

কৈশোরে কবির একদিন সত্যি সত্যি সৌন্দর্যে সচেতন দীক্ষা হয়েছিল। এক ঊষালগ্নে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়ে গেল, দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দ ও সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল, তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। [জীবনস্মৃতি] –এই সৌন্দর্যানুভূতি তাঁর চারদিন ছিল–এমনি অনুভূতি জেগেছিল আরো একদিন পূর্ণিমা রাতে–সৈকতে, তখন তিনি আমেদাবাদে।

আমার শিশুকালেই বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে আমার খুব একটি সহজ ও নিবিড় যোগ ছিল। বাড়ির ভিতরের নারিকেল গাছগুলি প্রত্যেকে আমার কাছে অত্যন্ত সত্য বলিয়া দেখা দিত।… সকালে জাগিবামাত্রই সমস্ত পৃথিবীর জীবনোল্লাসে আমার মনকে তাহার খেলার সঙ্গীর মতো ডাকিয়া বাহির করিত, মধ্যাহ্নে সমস্ত আকাশ এবং প্রহর যেন সুতীব্র হইয়া উঠিয়া আপন গভীরতার মধ্যে আমাকে বিবাগী করিয়া দিত এবং রাত্রির অন্ধকার যে মাঝপথের গোপন দরজাটা খুলিয়া দিত, সম্ভব-অসম্ভবের সীমানা ছাড়াইয়া রূপকথার অপরূপ রাজ্যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করিয়া লইয়া যাইত। এবং গঙ্গার পালতোলা নৌকায় যখন-তখন আমার মন বিনা ভাড়ায় সওয়ারি হইয়া বসিত এবং যে সব দেশে যাত্রা করিয়া বাহির হইত ভূগোলে আজ পর্যন্ত তাহার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নাই।

কি মাটি, কি জল, কি গাছপালা, কি আকাশ সমস্তই তখন কথা কহিত, মনকে কোনো মতেই উদাসীন থাকিতে দেয় নাই। –[জীবনস্মৃতি]।

আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালোবাসি(ছিন্ন পত্রাবলী ১৩)। পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। (ছিন্ন পত্রাবলী ৯৩)। সৌন্দর্য যখন একেবারে সাক্ষাত্তাবে আত্মাকে স্পর্শ করতে থাকে, তখনই তার ঠিক মানেটি বোঝা যায়, আমি একলা থাকি, তখন প্রতিদিনই তার সুস্পষ্ট স্পর্শ অনুভব করি, সে যে অনন্ত দেশ কালে কতখানি জাগ্রত তা বুঝতে পারি। (-ছিন্ন পত্রাবলী ১৯৭)।

সৌন্দর্য আমার পক্ষে সত্যিকার নেশা। আমাকে সত্যি ক্ষেপিয়ে তোলে।…. সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ার শক্তিরও অতীত; কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাকে, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না। (ছিন্ন পত্রাবলী ২৫)।

শৈশবে-বাল্যে তার মন-আত্মা সৌন্দর্য-সমুদ্রে অবগাহন করে করেই পুষ্ট হতে থাকে। তাঁর নিজের জবানীতে এমনি আরো উদ্ধৃতি দেয়া সহজ, কিন্তু অশেষের পথে এগুব না। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে এমনি রূপদর্শী ও রসগ্রাহী ছিলেন, ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী তার সাক্ষ্য।

.

০৪.

প্রকৃতি বা নিসর্গ অখণ্ড কোনো বস্তু নয়– খণ্ড, ক্ষুদ্র ও বিচিত্র বস্তু ও বর্ণের সমষ্টি মাত্র। কিন্তু তার সৌন্দর্য অখণ্ড সত্তার স্বীকৃতিতেই লভ্য। অতএব, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যানুভূতিই এ সৌন্দর্যবোধের উৎস। শৈশব-বাল্যেই এ বোধে অবচেতন দীক্ষা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

খণ্ড-ক্ষুদ্রকে সামষ্টিক সমগ্রতায় উপলব্ধি করার জন্যে দৃষ্টি ও মননের যে-প্রসার প্রয়োজন, অন্যের পক্ষে যা পরিশীলনেও সম্ভব হয় না–রবীন্দ্রনাথে তা প্রায় অনায়াসলব্ধ। অন্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : The first.stage of my realization was through my feeling of intimacy with nature. (Religion of man). apfo fesat fantas সবকিছুই সুন্দর নয়—হ্রস্ব-দীর্ঘ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সুগন্ধী-দুর্গন্ধী, মরা-তাজা, ভাঙা-মচকানো, ঋজু-বাঁকা, বর্ণালি-বিবর্ণ সব রকমই আছে। কিন্তু সৃষ্টির কিছুই তুচ্ছ নয়, নিরর্থক নয়–এ বোধের বশে যদি কেউ প্রকৃতি-নিসর্গের দিকে তাকায়, তাহলে সর্বত্র একটা রহস্য, একটা কল্যাণচিহ্ন প্রত্যক্ষ করা সহজ হয় :

এ মাঝে কোথাও রয়েছে কোনো মিল
নহিল এত বড় প্রবঞ্চনা।
পৃথিবী কিছুতেই সহিতে পারিত না।

–এই আস্তিক্যবুদ্ধিই মানুষকে জীবন-রসরসিক করে তোলে তখন বিষ আর অমৃতের আপাত বৈপরীত্য ঘুচে যায়–দু-ই জীবনের অনুকূল বলে অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের মুখে তাই শুনি আমি স্বভাতই সর্বাস্তিবাদী–অর্থাৎ আমাকে ডাকে সকলে মিলে, আমি সমগ্রকে মানি। গাছ যেমন আকাশের আলো থেকে আরম্ভ করে মাটির তলা পর্যন্ত সমস্ত কিছু থেকে ঋতু পর্যায়ের বিচিত্র প্রেরণা দ্বারা রস ও তেজ গ্রহণ করে তবেই সফল হয়ে ওঠে– আমি মনে করি আমার ধর্মও তেমনি–সমস্তের মধ্যে সহজ সঞ্চরণ করে সমস্তের ভিতর থেকে আমার আত্মা সত্যের স্পর্শ লাভ করে সার্থক হতে পারবে। (রবীন্দ্র-জীবনী-৩: পৃ. ২৯৪)। জগতের সঙ্গে সরল-সহজ সম্বন্ধের মধ্যে অনায়াসে দাঁড়িয়ে যেন বলতে পারি, আমি ধন্য। যা কল্যাণকর তা-ই সুন্দর, তা-ই শ্রদ্ধেয় এবং তা-ই প্রিয়। এ অনুভবের গভীরতাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর সঙ্গে একত্ব ও একাত্মবোধ জন্মায়। তখন সহজেই বলা সম্ভব যদি জানিবারে পাই ধূলিরেও মানি আপনা। যাকে বিষ বলে জানি, সুপ্রয়োগে তা-ই প্রাণ বাঁচায়, অপপ্রয়োগে অমৃত হতে পারে জীবনঘাতী। দুর্ব্যবহারে ভাইও হয় প্রাণের বৈরী, আবার প্রীতি দিয়ে অরিকেও মিত্র করা সহজ। এ তত্ত্ব একবার উপলব্ধ হলে বিশ্বজগতের প্রাণী ও প্রকৃতির আপেক্ষিকতা তথা জীবনধারণ ব্যাপারে পারস্পরিক উপকরণাত্মকতা হৃদয়-গোচর হয়। তখনই বলা চলে, আমি আছি এবং আমার সঙ্গে আর সমস্তই আছে, আমাকে ছেড়ে এই অসীম জগতের একটি অণুপরমাণুও থাকতে পারে না (ছিন্ন পত্রাবলী ২৩৮)। বোধের এমনি স্তরে প্রাণী, প্রকৃতি ও মানুষকে অভিন্ন সত্তার অংশ বলে না-ভেবে পারা যায় না। এরই নাম বিশ্বানুভূতি, এ তত্ত্বের ধর্মীয় নাম অদ্বৈতবাদ। এমনি করে রবীন্দ্রনাথে বিশ্বানুভূতি বা বিশ্বাত্মবোধ জাগে। প্রভাত উৎসব, বিশ্বনৃত্য, অহল্যার প্রতি, বসুন্ধরা, সমুদ্রের প্রতি, মধ্যাহ্ন, প্রবাসী, মাটির ডাক প্রভৃতি কবিতায় তা সুপ্রকট।

এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে
ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে।

অতএব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-চেতনাই রবীন্দ্রচিত্তে বৈচিত্র্যে ঐক্য-তত্ত্বেরও বীজ বুনেছিল। এরই বিকাশে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একত্ব ও একাত্ম অনুভব করেছেন; আর এরই বিস্তারে তার ব্যবহারিক জীবনে তথা সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় বোধে মানবিকতা, মানবতা, সর্বমানবিকবাদ বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা পায়। তাঁর এই মানবধর্মের সমর্থন রয়েছে বলেই উপনিষদ তাঁর প্রিয়। আর ঐক্যতত্ত্বের বিরলতার দরুনই স্মৃতি, পুরাণ ও গীতায় তাঁর অনুরাগ সীমিত।

এই সৌন্দর্যবুদ্ধি কীভাবে তার স্বদেশ, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে ও নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে, তার পরিচয় নেয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

.

০৫.

স্বদেশের ও য়ুরোপের এক যুগসন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এদেশে তখন বুর্জোয়া আদর্শে নগরকেন্দ্রী জীবনচর‍্যা শুরু হয়েছে। আমি এসেছি যখন … নতুন কাল সবে এসে নামল। ওদিকে সামন্ততন্ত্রী সমাজ ও নৈতিক জীবনবোধ গায়ে গায়ে তখনো অটল। কেননা তখনো গাঁয়ের নিয়তি নির্দিষ্ট জীবনে ইংরেজিশিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি।

বৃটিশ তখন দেশের মালিক, গ্রেট বৃটেনই তখন আমাদের বিলেত। সে বিলেতে শিল্পবিপ্লবের ফলে ফিউডেল সমাজ লুপ্ত; গড়ে উঠেছে বুর্জোয়া সমাজ এবং এই ধনিক সভ্যতা তখন সাম্রাজ্যবাদে পরিণত। সামন্ত ও বুর্জোয়া সমাজে পার্থক্য সামান্য নয়–সামন্তরা ছিল সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু দেশের মানুষের ধন-প্রাণের মালিক, শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক, মান ও ঐশ্বর্যের প্রতিভূ, তারাই সব; আর সব তাদের প্রজা ও মজুর-ক্ষেতমজুর ও আফিসি মজুর।

আর বুর্জোয়াদের আছে বৃত্তি, বিত্ত ও বেশাত। তাদের মুখে হাসি, বুকে বল আর সংকল্পে ভরা মন। তারা আত্মরচনায় ও আত্মপ্রসারে ব্যাকুল। তারা ধনে কেবল ধনী নয়, মানস-সম্পদেও ঋদ্ধ। তারা জিজ্ঞাসু এবং বিজ্ঞান ও যন্ত্রপ্রিয়; কিন্তু কলারসিক, সংস্কৃতিপ্রাণ, কল্যাণকামী, সেবাধর্মী আর মহৎ ও বৃহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ। সামন্ত ছিল কয়েকজন, বুর্জোয়া হল কয়েক লক্ষ। তাদের ঐশ্বর্যের সীমা নেই, তাদের সৌজন্য অতুলনীয়।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ হচ্ছে বুর্জোয়া জীবনের ও ঐশ্বর্যের সোনার যুগ। দ্বিতীয়ার্ধ এর ক্ষয়ের যুগ– আত্মধ্বংসী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও হানাহানির কাল। য়ুরোপে বুর্জোয়া জীবনের অবক্ষয়কালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। কিন্তু বাঙলাদেশে সে অবক্ষয়ের সংবাদ তখনো পৌঁছেনি। বুর্জোয়া সমাজের আত্মিক ও আর্থিক ঐশ্বর্যের পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ লালিত। বুর্জোয়ার এই প্রাণময়তা, উদারতা, সংস্কৃতিবানতা ও বিলাস-বাঞ্ছ শহুরে বাঙালির হৃদয়-মন হরণ করেছিল।

রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এঁদের মধ্যে প্রধান। এঁরা উভয়েই চাকরি ও ব্যবসা করে সম্পদ অর্জন করেন এবং সবটা সদুপায়েও নয়। এঁরা দুজনেই ছিলেন সাহেব-ঘেঁষা এবং ইংরেজ-প্রীতি এঁদের মজ্জাগত হয়ে উঠেছিল। তবু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল। রামমোহন ছিলেন বিদ্বান ও প্রজ্ঞাবান–এই বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রাণের বাণীটি তিনি বুঝেছিলেন। তাঁর উদারতা, গ্রহণশীলতা ও আন্তর্জাতিক চেতনা তা-ই ছিল সে-যুগে অতুলনীয়।

দ্বারকানাথ বিদ্বান না হলেও বুদ্ধিমান ছিলেন। নতুন যুগের বৈষয়িক প্রসাদে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। তাই শৌখিনতায়, বিলাসিতায়, দানশীলতায় ও সাহেব-প্রীতিতেই তাঁর নতুন জীবনচেতনা অবসিত। মনের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বর্জনশীল, গ্রহণশীল ছিলেন না। তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও আমরা এই রক্ষণশীলতাই কেবল লক্ষ্য করি, তার অধ্যাত্মবুদ্ধি তাকে ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ করেছিল, কিন্তু উদার করেনি। এই অনুদারতার জন্যেই তিনি সাহেবদের এড়িয়ে চলতেন, ব্রাহ্ম হয়েও ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যের ধারক ছিলেন; রামমোহন চরম তাচ্ছিল্যে যে-পৈতার শিকল ছিড়লেন, তিনি নতুন করে সেই পৈতার-বন্ধন স্বীকার করেই গর্ববোধ করলেন। অতএব, রবীন্দ্রনাথ পিতা থেকে উদারতার কিংবা প্রতীচ্য প্রাণময়তার দীক্ষা পাননি।

দ্বিজেন্দ্রনাথ অনেকটা বাপের মতোই ছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বাজাত্যবোধ তাকে অনুদার রেখেছিল, অতএব পারিবারিক প্রভাব রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতা বা সর্বমানবিক বোধের অনুকূল ছিল না। তাই ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম পঁয়তাল্লিশ বছর কেটেছে অন্যের প্রভাবে। এ সময়েও অবশ্য কাব্যের ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্ববোধের প্রকাশ ও বিকাশ নির্দ্বন্দ্ব ও নির্বিঘ্ন ছিল। যদিও কালিদাসের প্রভাবে প্রাচীন ভারত, তপোবন আর ব্রাহ্মণ্য মহিমায়ও তিনি প্রায় সমভাবেই মুগ্ধ ছিলেন, তবু তাতে বিরোধ ঘটেনি, কেননা সেখানেও তিনি ঐশ্বর্যের মধ্যে ত্যাগ; ভোগের মধ্যে সংযম এবং প্রেমের মধ্যে তপস্যার বীজ ও মহিমা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে স্বাদেশিক, স্বাজাতিক ও স্বধর্মীয় গোঁড়ামি তারও প্রশ্রয় পেয়েছে। কৈশোরেই তিনি সঞ্জীবনী সভার সদস্য, হিন্দুমেলার উৎসাহী কর্মী, স্বজাতির ঐতিহ্যগর্বী ও গানের মাধ্যমে স্বদেশপ্রীতি প্রচারে ব্রতী। পারিবারিক জীবনেও অশিক্ষিতা বালিকাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণে কিংবা নিজের বালিকা কন্যার বিবাহদানে কোনো সংকোচ ছিল না তার। তার এই ব্যবহারিক ভুবনে তাঁর চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে–তাঁর পিতা ও তাঁর অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-তিলক প্রমুখ উগ্র স্বাজাত্যগর্বীদের প্রভাবে।

এ প্রভাব থেকে মুক্ত হতে তাঁর সময় লেগেছে। জীবনের পঁয়তাল্লিশটি বছর কেটে গেছে দেশ-জাত-ধর্মের খোলসমুক্ত হতে। অবশ্য এর মধ্যেও যে তার বিদ্রোহ দেখা দেয়নি তা নয়। এ সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক স্মরণীয়। এ যেন বাল্যের সেই খড়ির গণ্ডি থেকে বাইরের পানে তাকানো। তাঁর নিজের উক্তিতে প্রকাশ: নানা কাজে আমার দিন কেটেছে, নানা আকর্ষণে আমার মন চারিদিকে ধাবিত হয়েছে। সংসারের নিয়মকে জেনেছি, তাকে মানতেও হয়েছে, মূঢ়ের মতো তাকে উচ্ছখল কল্পনায় বিকৃত করে দেখিনি। কিন্তু এই সমস্ত ব্যবহারের মাঝখান দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আমার মন যুক্ত হয়ে চলে গেছে সেইখানে, যেখানে সৃষ্টি গেছে সৃষ্টির অতীতে। এই যোগে সার্থক হয়েছে আমার জীবন। (আত্মপরিচয়)।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে সত্যই প্রতিভাসুলভ কোনো উচ্ছলতা কিংবা বৈচিত্র্য নেই। সেদিক দিয়ে তার নিতান্ত সাধারণ জীবন। ব্যারিস্টার হবার চেষ্টা, জমিদারি কাজে নিষ্ঠা, ব্যবসায়ে প্রবণতা, সমিতির কর্মে আগ্রহ, শিক্ষকতায় ও স্কুল পরিচালনায় উৎসাহ, গার্হস্থ্য কর্তব্যে প্রযত্ন প্রভৃতি তার বৈষয়িক জীবন-নিষ্ঠার পরিচায়ক–প্রতিভার সাক্ষ্য নয়। এমনকি প্রেমের ব্যপারে তার চিত্ত বিভ্রান্তির পরিচয়ও দুর্লভ। যদিও তিনি বলেছেন, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি। (রবীন্দ্র জীবনকথা, পৃ. ২৬)। অতএব তিনি প্রতিভা-দুর্লভ অসামান্য স্থিতধী এবং আত্মিক শক্তিসম্পন্ন ছিলেন, এমন অবলীলায় আত্মনিয়ন্ত্রণের নজির প্রতিভাবানদের চরিত্রে দুর্লক্ষ্য। কাজেই রবীন্দ্রনাথের ভাবের জীবনে ও বাস্তব জীবনে সুস্পষ্ট সীমারেখা ছিল। একটি অপরটিকে কখনো লঙ্ঘন করেনি, করেনি আচ্ছন্ন।

.

০৬.

স্বাজাত্য ও স্বাদেশিকতার নির্মোক মুক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৌন্দর্যবুদ্ধি-প্রসূত বিশ্বচেতনা দিয়ে তাঁর কাব্যজগৎ যেমন রচনা করেছিলেন, তেমনি করে তার ব্যবহারিক ভুবন নির্মাণে মনোনিবেশ করলেন। বিশ্বপ্রকৃতিতে তিনি বৈচিত্র্যের মধ্যে যে-ঐক্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, মানব-জগতেও পেলেন সে-তত্ত্বের সন্ধান। যে-তত্ত্বচিন্তা প্রকৃতির মধ্যে কল্যাণচিহ্ন ও সুষম সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছিল, সে-তত্ত্ববুদ্ধিই দ্বন্দ্ব-সংঘাত-স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও মানুষের একত্বে ও একাত্মতায় বিশ্বাস রাখতে অনুপ্রাণিত করেছিল; এ অভিন্ন সত্তাবোধে উৎসাহিত হয়েই তিনি বিশ্বমানব ঐক্যে আস্থা রেখেছিলেন। অবশিষ্ট জীবনে তাঁর চিন্তা ও কর্ম এ-বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। একালে ঔপনিষদিক বিশ্বচিন্তা আর গৌতমবুদ্ধের করুণা ও মৈত্রীতত্ত্ব তাঁকে বিশেষ করে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ বোধের অঞ্জন চোখে মেখেই তিনি প্রাচীন ভারতের দিকে তাকিয়েছিলেন, ফলে সেকালের সমাজে দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-দ্রোহ কিছুই তার চোখে পড়েনি; তিনি দেখেছেন বহুত্বেও একের অবয়ব, স্বাতন্ত্রেও সামঞ্জস্য, শ্ৰেণীসমন্বিত ও বর্ণেবিন্যস্ত সমাজে প্রীতিপ্রসূত কর্তব্য ও দায়িত্ব-সচেতন ব্যষ্টি। তার এ দৃষ্টিতে ইতিহাস চেতনা নেই, কিন্তু সৌন্দর্যবুদ্ধিজাত আদর্শিক প্রেরণা আছে। তার মতে :

‘আসল কথা, মানুষের ইতিহাসে মানুষের মনটা সবচেয়ে বড় জিনিস (মনস্তত্ত্বমূলক ইতিহাস), ইতিহাস কেবলমাত্র তথ্যের ইতিহাস নহে, তাহা মানব-মনের ইতিহাস, বিশ্বাসের ইতিহাস’ (ঐতিহাসিক চিত্র)। ‘ইতিহাস কেবল জ্ঞান নহে, কল্পনার দ্বারা গ্রহণ করলে তবেই তাহাকে যথার্থভাবে পাওয়া যায়’ (ইতিহাস কথা)।

আজকের ভারতের রাষ্ট্ৰিক Secularism-এ এ-বোধের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। এ বোধই প্রবর্তিত ও প্রচারিত আচারিক ধর্মের প্রতি তাঁকে বীতরাগ করেছে; মানুষের ধর্ম বলতে তিনি বুঝেছেন মানুষের চিত্তোথিত কল্যাণবুদ্ধি ও আত্মাজ প্রীতি– যে-প্রীতি চরাচরের সবকিছুকে আপন বলে গ্রহণ করতে প্রেরণা দেয়, যে-প্রীতি কর্তব্য ও দায়িত্ববুদ্ধি জাগিয়ে রাখে।

অদ্বৈতবাদী তথা বিশ্ব-ঐক্যে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের এসব মৌলিক চিন্তা। এ চিন্তা থেকেই তাঁর স্বাদেশিকতা বিশ্বচিন্তায় এবং তার জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতায় পরিণত, আর ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিশ্বভারতীতে উন্নীত। এজন্যেই দেশের স্বাধীনতার চেয়ে সমাজ-গঠনকে তিনি জরুরি ভেবেছেন, সরকারি সাহায্যের চেয়ে আত্মশক্তির প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন, আর ঐশ্বর্যের চেয়ে মর্যাদাবোধের এবং সচ্ছলতার চেয়ে সতোর দাম তার কাছে বেশি ছিল। এজন্যেই খেলাফত আন্দোলনকালে গোঁজামিলে হিন্দু-মুসলিম মিলন প্রতিষ্ঠার নিন্দা করেছেন তিনি, গান্ধীর যন্ত্র ও যন্ত্রশিল্প-বিমুখতা পছন্দ করেননি, পারেননি য়ুরোপীয় শিক্ষা বর্জনে সায় দিতে। কেননা য়ুরোপের রেনেসাঁসের দানকে তিনি মানব-নির্বিশেষের জন্যে আশীর্বাদ বলে মনে করতেন, একে গ্রহণ করেছিলেন মানুষ অবিশেষের ঐতিহ্য বলে। একে মানুষের আত্মার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে জানতেন ও মানতেন। তাই আধুনিক য়ুরোপ ও ঔপনিষদিক ভারত তার মন হরণ করেছিল।

ফাঁকির দ্বারা কোনো ফাঁক পূরণ ছিল তাঁর আদর্শ-বিরোধী। কেননা তিনি গৌতমবুদ্ধের মতো কারণ নিরূপণ ও উপায় নির্ধারণ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, অর্থাৎ যে-কোনো কিছু গোড়া থেকেই শুরু করতে হবে। এটি তার সেই সৌন্দবুদ্ধিজাত ঐক্যতত্ত্বেরই প্রভাবের ফল। তাঁর শেষজীবনে ইতিহাস-চেতনা, বিজ্ঞানবুদ্ধি, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা প্রবল হয়। এখানেও তিনি সমাধান খুঁজেছেন। সৌন্দর্যবুদ্ধিপ্রসূত একত্ব ও একাত্মতত্ত্বে তথা বিশ্বজনীনবোধের স্বীকৃতিতে। অতএব এখানেও তিনি অধ্যাত্মবাদী ও অদ্বৈতবাদী। তাই কামনা করেছেন মহামানবের আবির্ভাব, মিশু-বুদ্ধের মতো প্রেম ও মৈত্রীবাদীর নেতৃত্ব। তাঁর এ অধ্যাত্মবুদ্ধি বিজ্ঞান-বর্জিত নয়। তাই ঔপনিষদিক জ্যোতির্মান পুরুষস্বরূপ সবিতা আর বিজ্ঞানীর জগৎ-কারণ সূর্য তাঁর চিন্তায় অভিন্ন হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবনের শেষ দশকের রচনা তাই সবিতা-কেন্দ্রী। তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানবুদ্ধি ও ইতিহাস-চেতনা এখানে প্রজ্ঞার স্তরে উন্নীত; এই প্রজ্ঞার আলোকে তিনি সমাধান খুঁজেছেন বর্তমানের বিশ্বমানব সমস্যার।

রবীন্দ্রজীবনের অন্তিম মুহূর্তে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের মরণ কামড় আবার শুরু হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রবাদ প্রসার লাভ করেছে। ধনিক সভ্যতার অবসান-প্রায় সোনার যুগে তার আবির্ভাব আর সমাজতন্ত্রের বিকাশ মুহূর্তে তার তিরোভাব–তাই ইতিহাস ও বিজ্ঞান-সচেতন না হয়ে পারেননি তিনি।

তাঁর ধারণায় : যেখানে symmetry, harmony ও symphony নেই, সেখানে সত্যও নেই। সত্য ও কল্যাণের পথ দুরূহ কিন্তু গন্তব্য নিশ্চিত শান্তির। সত্য যে কঠিন–সে কখনো করে না বঞ্চনা।

কিন্তু সাধারণ লোক যতটা আপাত-প্রয়োজন-সচেতন, ততটা দূরদর্শী নয়–আশু ফল প্রাপ্তিই তাদের লক্ষ্য। এ কারণেই কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্যে তিনি যা-কিছু করেছেন ও করতে চেয়েছেন, তা কৃষকদের মধ্যেও সমাদৃত হয়নি। তাঁর রাজনৈতিক মতও উপহাস পেয়েছে, তার সমাজচিন্তা পেয়েছে অবহেলা।

.

০৭.

আজকের দিনে কে না স্বীকার করে যে, খণ্ড-ক্ষুদ্র হয়ে এ-যুগে কেউ বাঁচতে পারে না। বাঁচবার পক্ষে সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য-ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র সম্বন্ধে এ সত্য সমভাবে প্রযোজ্য। জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে যৌথ রাষ্ট্রব্যবস্থা অবধি সংহতি ও সহযোগিতা লক্ষ্যে গঠিত অসংখ্য সংস্থায় দুনিয়া ভরে গেছে। এ তো সেই বিশ্বানুভূতিরই ফল–সেই বৈচিত্র্যে ঐক্য সন্ধানের, স্বাতন্ত্রে সমন্বয় সাধন প্রয়াসের ও সর্বমানবিকবাদের স্বীকৃতি। অথচ অর্ধশতাব্দী আগে এ তত্ত্ব উচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথ উপহাসই পেয়েছেন। একটি মহাযুদ্ধের তুর্যধ্বনিতে আজ যুগারম্ভের দ্বার খুলেছে।… মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্বন্ধ এক মহাদেশে ব্যাপ্ত, তার মধ্যে সত্যের সামঞ্জস্য যতক্ষণ না ঘটবে ততক্ষণ এই কারণের নিবৃত্তি হবে না। এখন থেকে যে-কোনো জাত নিজের দেশকে একান্ত স্বতন্ত্র করে দেখবে, বর্তমান যুগের সঙ্গে তার বিরোধ ঘটবে, সে কিছুতেই শান্তি পাবে না। এখন থেকে প্রত্যেক দেশকে নিজের জন্যে যে-চিন্তা করতে হবে, সে-চিন্তার ক্ষেত্র হবে জগৎজোড়া। চিত্তের এই বিশ্বমুখী বৃত্তির চর্চা করাই বর্তমান যুগের শিক্ষার সাধনা। (সত্যের . আহ্বান)।

অতীতে আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিত্বকে মনীষা আর মনীষাকে কবিত্ব বলে জেনেছি। তাঁর বিশ্বচেতনা ও অদ্বৈতবোধ Mysticism বলে অবহেলা পেয়েছে আমাদের। তার যুগচেতনা ও যুগসমস্যার সমাধান প্রয়াস কবির স্বাপ্নিক-কাক্ষা বলে হয়েছে উপেক্ষিত। ফলে রবীন্দ্রচিন্তা তাঁর স্বদেশেও গুরুত্ব পায়নি।

আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, নানা বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তাঁর ঔপনিষদিক বসুবৈধ কুটুম্বকম-বাদ আজকের দুনিয়ায় কবি-কল্পিত তত্ত্বমাত্র নয়, অতি গুরুতর তথ্য এবং মানবজীবনের নিরেট সত্য। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের সেই মানবতা, সর্বমানবিকতা বা বিশ্বজনীনতা ও সেই মৈত্রীধর্ম আজ জয়ের পথে, দেখতে পাই।

.

০৮.

পৃথিবীর কোনো একক ব্যক্তির রচনার এমন বিপুল ও বিচিত্র বিস্তার আর দেখা যায়নি। এমন সর্বতোমুখী ও সর্বত্রগামী ভাব-চিন্তা-কর্মও অদৃষ্টপূর্ব। অবশ্য গল্পে-উপন্যাসে-নাটকে-প্রবন্ধে তার সমকক্ষ কিংবা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখক য়ুরোপখণ্ডে বিরল নয়, কিন্তু কাব্যজগতে বিশেষ করে গীতিকবিতার ও গানের ভুবনে তার তুলনা বিরল। অনুভূতির সূক্ষ্মতায়, বৈচিত্র্যে, চিত্রায়ণে, মাধুর্যে, তাৎপর্যে, উৎকর্ষে আর অনেকতায় তাঁর গান ও গীতিকবিতা প্রায়-অনুপম। তাঁর স্বভাষী তার কাছে পেয়েছে সৌন্দর্য দেখার চোখ, সুরুচির পাঠ, মানবতার বোধ ও বিশ্বজনীনতায় দীক্ষা। তার কাছে পেয়েছে তারা মুখের ভাষা, কণ্ঠের সুর, প্রাণের প্রীতি, চরিত্রের দার্ট, আত্মসম্মান বোধ, আনন্দের কাক্ষা ও জীবনে প্রত্যয়। আজকের সংস্কৃতিবান মানবতাবাদী বাঙালি মাত্রই রবীন্দ্রনাথের মানস সন্তান।

Exit mobile version