অথবা
কান্নাহাসির খেলার মোহে অনেক আমার কাটল বেলা,
আজকে বড় শ্রান্ত আমি আশার আশায় মিথ্যা ঘুরে।
—(উপেক্ষিত)
বিদ্রোহী-র কবির ভেতরকার স্বরূপ :
খেয়ে এনু পায়ের ঠেলা–
আর সহেনা মাগো এখন আমায় নিয়ে হেলা ফেলা।
অথবা-
চাই যারে মা তায় দেখিনে।
ফিরে এনু তাই একেলা
পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে বক্ষে বিঁধে অবহেলা
বিশ্বজয়ের গর্ব আমার জয় করেছে ঐ পরাজয়
ছিন্ন আশা নেতিয়ে পড়ে ওমা এসে দাও বরাভয়।
হৃদয়-জগতে অহঙ্কার থাকলে আর যাই হোক প্রণয়ে সিদ্ধি নেই। তাই কবির অহঙ্কারের এমন ধূল্যবলুণ্ঠিত অবস্থা–এমন লাঞ্ছনা। আমিত্ব ও ব্যক্তিত্বের বিলোপ সাধনের দ্বারাই প্রণয়ে সাফল্য সম্ভব। পূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারাই প্রণয়ের মূল্য দিতে হয়।
নজরুলের প্রণয়-সাধনা একটানা ব্যর্থতার ইতিহাস, তবু এখানে-সেখানে এক আধটু আশার আলো যে নেই, তা নয়। তবে যে-সুর তাঁর কাব্যে প্রবল তা হতাশার–ব্যর্থতার–নৈরাশ্যের ও বেদনার সুর, সে সুরে ক্ষোভও কম নয়।
বায়ু শুধু ফোঁটায় কালিকা
অলি এসে হরে নেয় ফুল।
এই ব্যর্থতাও–স্মৃতি সুখময় হয়ে হৃদয় ভরে রইল। কারণ–
না চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে
তুমি শুধু তুমি
সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া
আজ আমি শতবার করে
তব প্রিয় নাম চুমি।
শুধু তাই নয়, কবির উপলব্ধির জগৎও প্রশস্ততর হয়েছে। প্রেয়সীকে পাওয়া নাই-বা গেল, কিন্তু প্রণয়ানুভূতি তো চিরন্তন হয়ে রইল, তাই-বা কী কম লাভ?
মরিয়াছে অশান্ত অতৃপ্ত চির স্বার্থপর লোভী
অমর হইয়া আছে, রবে চিরদিন,
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি।–(পূজারিণী)
এবং
যেদিন আমায় ভুলতে গিয়ে
করবে মনে, সেদিন প্রিয়ে।
ভোলোর মাঝে উঠব বেঁচে সেইতো আমার প্রাণ
নাইবা পেলাম চেয়ে গেলাম গেয়ে গেলাম গান।
—(গোপন প্রিয়া)
কারণ,–প্রেম সত্য-চিরন্তন। প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়। জন্ম যার কামনার বীজে। (অনামিকা)
নজরুলের পূজারিণী কবিতাটিকে তাঁর প্রণয়-দর্শনের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছি। কেননা এ কবিতায় তাঁর প্রণয়াদর্শের স্বরূপ পূর্ণরূপে উদঘাটিত হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এখানে প্রেমের আদি, মধ্য ও পরিণতির একটা স্পষ্টরূপ ধরা দিয়েছে। দেহ-কামনা এবং কাম-বিরহিত প্রণয়ানুভূতির সুন্দর সুষ্ঠু প্রকাশ এমনি করে আর কোনো কবিতায় বা গানে দেখা যায়নি। পূজারিণী কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। শুধু এ কবিতাটিও কবিকে অমরতা দান করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সমর্পণ পুবের চাতক চপল সাথী কবি-বাণী, অভিশাপ, অবেলার ডাক প্রভৃতি কবিতাও স্মরণীয়। অনামিকায় কবি পরমের সঙ্গে অনন্ত প্রেমের সন্ধান পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের অনন্ত প্রেম কবিতাটি এর সঙ্গে স্মরণীয় :
প্রেম সত্য প্রেম-পাত্র বহু অগণন;
তাই চাই বুকে পাই, তবু কেঁদে উঠে মন,
মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়,
যে পাত্রে ঢালিয়া খাও, সেই নেশা হয়।
চির-সহচরি।
এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি!
আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছে গোপন
বৃথা আমি খুঁজে মরি জন্মে জন্মে করিনু রোদন।…
প্রতিরূপে অপরূপা ডাক তুমি
চিনেছি তোমায়,
যাহারে বাসিব ভালো সে-ই তুমি
ধরা দেবে তায়,
প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম
সে সরার লোহু।
–(অনামিকা)।
এরূপ অনুভূতি আরো কয়েকটা কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। চিরজনমের প্রিয়া জন্মে জন্মে প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ হেঁয়ালির মতো ঠেকে। কারণ শারীর-প্রেমের কবির, বিশেষত মুসলিম কবির পক্ষে এসব শব্দের প্রয়োগ অবান্তর ও নিরর্থক। এসব শব্দের ব্যঞ্জনা অর্থবিভ্রান্তি ঘটায় মাত্র।
মোহিতলালের মানস-লক্ষ্মী, শাহাদত হোসেনের উপেক্ষিত, গোলাম মোস্তফার পাষাণী, আবদুল কাদিরের লাবণ্যলতা, খান মঈনুদ্দিনের রহস্যময়ী আর নজরুল ইসলামের পূজারিণী ও অনামিকা প্রায় একই জাতীয় কবিতা। উপরোক্ত কবিতাগুলোতে কবিগণের স্ব স্ব প্রণয়াদর্শ অভিব্যক্তি লাভ করেছে।
নজরুলের হবের হাওয়া গ্রন্থের গানে-কবিতায় কবিমনের প্রেমবৈচিত্র্য প্রকাশ পায়নি, পেয়েছে হালকা ও অনিৰ্দেশ্য বিরহ-বিলাস। এজন্যে কবিচিত্তে যেমন, পাঠক-চিত্তেও তেমনি এসব গান ও কবিতা বিশেষ দোলা জাগায় না। নজরুলের ব্যক্তিজীবনে যেমুন একধরনের চাঞ্চল্য, অস্থিরতা, অস্বস্তি ও অতৃপ্তি ছিল; তাঁর সাহিত্যিক জীবনেও ছিল তেমনি একপ্রকারের ক্ষোভ, তৃষ্ণা, অতৃপ্তি ও বেদনাবোধ। প্রথম জীবনের বাউণ্ডেলের আত্মকথা, রিক্তের বেদন থেকে তাঁর শেষ রচনায় অবধি তা প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে উপস্থিত। কোনো পাওয়াতেই যেন তাঁর মন ওঠে না। না পাওয়ার ক্ষোভ আর পেয়ে হারানোর বেদনাই যেন তাঁর জীবনব্যাপী একটা আর্তনাদ—একটা হাহাকার রূপে অবয়ব নিয়েছে। তাই নজরুল বেদনা-বিক্ষুব্ধ ঔপন্যাসিক, বিপ্লবী সগ্রামী কবি এবং প্রত্যাখ্যান-বিক্ষুব্ধ ও বিরহী প্রেমিক।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে, নজরুল সংগ্রামে যেমন বাদপি কঠোরানি প্রণয়ে তেমনি কোমলানি কুসুমাদপি। তাঁর জীবনের স্বরূপ, তার অন্তর ও কবি-জীবনের পরিচয়, তাঁর সাধনা ও জীবনোপভোগের পদ্ধতি, তার অন্তর্জগৎ ও বাহ্যজগতের দিগদর্শন একটিমাত্র কথায় যথার্থভাবে প্রকাশ পেয়েছে :