তবু এই বিপ্লব, বেদনা এবং শক্তির কবির হৃদয় নারীপ্রেম বর্জিত ছিল না। যে স্পর্শ-চঞ্চলতা ও ভাবালুতা তাঁকে বিপ্লবী করেছিল, সে-প্রাণময়তাই তাঁকে প্রণয় ব্যাপারেও উচ্ছ্বাসী এবং হৃদয়ধর্মী করে রেখেছিল। নজরুলের প্রেমের কবিতার সংখ্যা কম নয়, প্রণয়-গীতিও বহু। বাঙলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কেউ অত গান লেখেন নি। নজরুলের গানের অধিকাংশই প্রেম-সংগীত।
নজরুল বিপ্লবের কবি, প্রাণপ্রাচুর্যের কবি, জীবনবাদের কবি! এদিক দিয়ে তার পৌরুষ-ব্যঞ্জনা ও দৃঢ়তার সীমা নেই। কিন্তু প্রণয়-ব্যাপারে কবি শিশুর মতো অসহায়, শিশুর ন্যায় অশ্রুর আবেদন ছাড়া তাঁর আর গতি নেই। যে-কবি শক্তির পূজারী, মনোবলের উদ্গাতা, আপনার সীমাহীন শক্তির উত্তেজনায় যিনি সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে নতুন করে গড়ার প্রয়াসী: সে-কবির প্রণয় রাজ্যে অসহায়তা ও রিক্ততার সকরুণ হাহাকার পরমাশ্চর্যের বিষয় বই কি! এই অদ্ভুত অসামঞ্জস্যের কারণ খুঁজলে বোঝা যাবে–কবির হৃদয় উচ্ছ্বাসপ্রবণ ও কোমল। ব্যবহারিক জীবন ব্যাপারে যে-উত্তেজনা রক্ত ঝরাতে প্রবুদ্ধ করে, সেই উত্তেজনাই প্রণয় ব্যাপারে ব্যর্থতার কান্না ও হাহাকার এনে দেয়। একই হৃদয় বৃত্তির দুটো দিক : উচ্ছ্বাস-উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়া আর কেঁদে লুটানোআগুন জ্বালানো আর অশ্রু-ঝরানো। এজন্যেই আমরা তাঁকে একান্তভাবেই হৃদয়ধর্মী বলেছি। বুদ্ধিজীবী তিনি নন। তাই তাঁর সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিষয়ক বিপ্লবাত্মক রচনায় হৃদয়বৃত্তির উচ্ছ্বাসময় বিকাশ ও প্রকাশ দেখতে পাই, বুদ্ধিমত্তা ও মনীষার দীপ্তির সাক্ষাৎ পাইনে। হৃদয়-উদ্ভুত সত্যনিষ্ঠাই এসব রচনার প্রাণ। তাই বিপ্লবী কবির রচনায় ভাঙ্গার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই।
নজরুল ইসলামের প্রণয়-কাব্যেও উঁচু দার্শনিকতা নেই। শেলী, ব্রাউনিং বা রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি অতীন্দ্রিয় প্রেমরাজ্যে বিহার প্রয়াসী নন। একান্তভাবে শরীর-নিষ্ঠ ভালোবাসার সাধক তিনি। এ কায়ার সাধনায় ছায়া যদি কোথাও মায়া পেতে থাকে, তবে তা আকস্মিক-সচেতন প্রয়াস নয়। যেমন :
যা কিছু সুন্দর হেরি করেছি চুম্বন,
যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর–
সে সবার মাঝে যেন তব হরষ…
অনুভব করেছেন, এবং—
কথা কও কথা কও প্রিয়া
হে আমার যুগে যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া
—[অনামিকা]
এ শরীরনিষ্ঠ প্রণয়-কথা বলবার সাহসও কম প্রশংসনীয় নয়। কবি মোহিতলালও শারীর প্রেমের কবি। সে-প্রেম অবশ্য আত্মাকে বাদ দিয়ে নয়। দেহভিত্তিক প্রেমের মানসোপভোগই মোহিতলালের কাব্যাদর্শ। যদিও মোহিতলাল শরীরনিষ্ঠ প্রণয়-পূজারী, তবু নজরুলের মতো এমন উচ্ছ্বাস ও প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ তাঁর পক্ষে সর্বত্র সম্ভব হয়নি। ইতোপূর্বে কবি গোবিন্দ দাসের একটি কবিতায় দেহনিষ্ঠার নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ দেখেছি
আয় বালিকা খেলবি যদি এ এক নতুন খেলা,
চুপ চুপ চুপ কসনে কারো এ এক নতুন খেলা।
রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমল কাব্যে বিবসনা, স্তন, দেহের মিলন, প্রভৃতি কবিতা রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এসব কবিতা অতীন্দ্রিয় প্রণয়-রাজ্যের সোপানস্বরূপ বলা যেতে পারে, কেননা তিনি এতে তৃপ্তি খুঁজে পাননি। সুতরাং নজরুল ইসলামই দেহনিষ্ঠ মানবীয় ভালোবাসার প্রধান সপ্রতিভ স্তুতিকার। মানুষের দেহ, মন, প্রাণ, কর্ম সবকিছু যে-দেশে দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত; অধ্যাত্মপ্রেম ছাড়া যে-দেশে অন্য প্রেমের কোনো স্বীকৃতি নেই, সে-দেশে সে-সমাজে এমনি প্রণয়সাধনা কম দুঃসাহসের কথা নয়। তাঁর সমসময়ে আমরা মোহিতলালকে এবং তারপরে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতিকে পাচ্ছি। কামাক্ষীপ্রসাদ ও আরো অনেকের কবিতায় এসব বস্তুনিষ্ঠা অনুকৃত হয়েছে।
কিন্তু তাঁর শরীরনিষ্ঠ সাধনায় অসংযম বা অশ্লীলতা নেই, ক্লেদ-পঙ্কিল বীভৎসতা কোথাও প্রকট হয়ে উঠেনি। এ দেহসর্বস্ব প্রণয়েও পবিত্রতা এবং সুষমা কোথাও অস্বীকৃত হয়নি। তাঁর দোলন চাঁপা, ছায়ানট পূবের হাওয়া ও বুলবুলের কবিতা ও গানগুলোতে এবং আরো অনেক গানে আমাদের উক্তির সমর্থন মিলবে। নজরুল শারীর- প্রেমের সাধক হলেও আত্মার অস্তিত্ব ও প্রভাব অস্বীকার করেননি। এজন্যেই উদ্বেল ভাবাবেগে কবি এখানে-সেখানে শরীরের সঙ্গে আত্মাকে এবং আত্মার সঙ্গে দেহকে টেনে এনেছেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য অস্পষ্ট হয়েছে; অসামঞ্জস্য এবং অসংগতিও দুর্লভ নয়।
নজরুলের প্রণয়-সাধনা বিচিত্ররূপে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর প্রণয়তৃষ্ণারও গভীরতা এবং বিপুলতা নেই। তবু সর্বত্র ব্যর্থতার মর্মভেদী হাহাকার ও গাঢ় বেদনার মূৰ্ছনা প্রকট হয়ে উঠেছে। যে-কবির হৃদয় অগ্নিগর্ভ, বাণী অগ্নিক্ষরা এবং যাকে বলদৃপ্ত, দৃঢ়চিত্ত, দাম্ভিক ও সীমাহীন ব্যক্তিত্বশীল বলে মনে হত, তিনিই নারীর করুণার ভিখিরি হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। অশ্রুর আবেদন ছাড়া দ্বিতীয় সম্বল নেই, দ্বিতীয় অস্ত্র নেই তাঁর নারীর হৃদয় জয়ার্থ প্রয়োগ করবার জন্যে। এতে বোঝা যায়, কবি যা ই বলুন না কেন, আসলে তার হৃদয় বড় দুর্বল, বড় কোমল :
আমার দুচোখ পরে বেদনার স্লানিমা ঘনায়,
বুকে বাজে হাহাকার করতালি,
কে বিরহী কেঁদে যায় খালি সব খালি
ঐ নভ, এই ধরা, এই সন্ধ্যালোক
নিখিলের করুণার যা, কিছু তোর তরে তাহাদের অশ্রুহীন চোখে।
—(বেলা শেষে)