অথবা–বীর কারুর অধীন নয়, ভিতরে বাইরে সে কারুর দাস নয়–সম্পূর্ণ উদার মুক্ত। পরকে ভক্তি করে, বিশ্বাস করে শিক্ষা হয় পরাবলম্বন–আর পরাবলম্বন মানেই দাসত্ব।… বল কারুর অধীনতা মানিনা-স্বদেশীরও না বিদেশীরও না। (দুর্দিনের যাত্রী)।
নজরুলের কাব্য-সাধনা ছিল একান্তভাবে মানবনিষ্ঠ। নজরুলের ধর্মও ছিল তাই মানবনিষ্ঠা। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে প্রেম করাই আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ এবাদত। এ প্রেমে ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠা থাকা প্রয়োজন। সেজন্যে আমরা দেখতে পাই বিবেক, সত্য ও মানবতাকে তিনি সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি বিবেকের নির্দেশ মেনে চলেন। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যে ঘোষণা করেছেন জেহাদ। মানুষ নির্বিশেষের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও প্রেমই তাঁকে ধর্মের গোঁড়ামি, আভিজাত্যবোধ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করেছে :
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহীয়ান,
নাই দেশকাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি;
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
অথবা
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফুটে তাজা ফুল
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে খুলে দেখ নিজ প্রাণ।
নজরুল ইসলাম কোনো বিশেষ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন বলা চলে না। তিনি দেশ-জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান উদারতায় ভালোবাসতে পেরেছেন। বিবেক-বিধৃত সত্যের উপরে সত্য নেই, এ-ই তাঁর বিশ্বাস —
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা সত্য-সিন্ধুজলে।
ওরে বেকুব, ওরে জড়, শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়।
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
বলেছি, নজরুল ইসলামকে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুরাগী বলা চলে না। এতদসত্ত্বেও তিনি ইসলামের প্রতি তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছেন। তার কারণ, কবির জীবনের যা ব্রত তা ইসলামের মতো আর কোনো ধর্ম এত দৃঢ়তার সঙ্গে এমন স্পষ্ট করে বলেনি। কবি বলেন :
চির উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির
ওই শিখর হিমাদ্রির।
কোরআন বলে–আনতুমা খয়ারে উম্মাতীন। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তির কাছে মানুষের শির অবনমিত হবে না। মানুষ আশরাফুল মখলুকাত।
কবি বলেন- এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো কাবা-মন্দির নাই।
ইসলাম বলে : মানুষের হৃদয় কাবা স্বরূপ।
কবি বলেন
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নাই কিছু মহীয়ান
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি।
ইসলাম বলে– মানুষ সব এক আদমের সন্তান এবং পরস্পর ভাই ভাই
কবি বলেন- তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।
অথবা, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হল।
ইসলাম বলে– যে-দুঃখ, যে-বেদনা, যে-লাঞ্ছনা তুমি নিজের জন্যে কামনা করতে পারো না, তা তোমার ভাইয়ের জন্যে কামনা করো না। প্রতিবেশীকে উপবাসী রেখে নিজে ক্ষুধার অন্ন গ্রহণ করো না।
কবি বলেন–সবদেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
ইসলাম বলে–মানুষকে ভালোবাসাই আল্লার শ্রেষ্ঠ এবাদত।
কবি চেয়েছেন–মানুষের ব্যক্তি-মর্যাদার সাম্য, বিত্ত-বৃত্তি নিরপেক্ষ ভ্রাতৃত্ব, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি; শোষণ, অত্যাচার ও আভিজাত্যবোধের উৎসাদন।
ইসলামের শিক্ষাও হচ্ছে :
নাই ছোট বড়–সকল মানুষ এক সমান,
রাজা প্রজা নয় কারো কেহ।
সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
কারো আঁখি জলে কারো ঘরে কী রে জ্বলিবে দীপ।
দুজনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বনসীব?
এ-নহে বিধান ইসলামের ॥
ইসলামের এ শিক্ষাই কবিকে মুগ্ধ করেছে। এজন্যেই কবি ইসলামকে আঁকড়ে ধরে আছেন। ইসলামের মানবতা ও সমাজ সংজ্ঞা তাঁর আদর্শের সম্পূর্ণ অনুকূল বলেই মানুষ নির্বিশেষের মিলন পীঠ কাবার ছবি তার বক্ষে অঙ্কিত; মানবতা ও সাম্যের বাণী-বাহক হজরত মুহাম্মদের নাম তাঁর জপমালা; এইজন্যেই মর্যাদার পূজারী উন্নতশির কবির হৃদয় কলেমা লাইলাহা ইলল্লাহু মুহম্মদ রসুলাল্লাহ আন্দোলন জাগায়। তাঁর এই ইসলামপ্রীতি ধার্মিকতাপ্রসূত নয়–মানবতা ও ব্যক্তি নিষ্ঠাজাত। ধর্মপ্রাণতা নয়– আদর্শানুগত্য। তাঁর আদর্শের সাধনার অনুকূল উপাদান তিনি যেখানেই পেয়েছেন, গ্রহণ করেছেন। তাই হিন্দুর দেবদেবী, পুরাণ প্রভৃতিও তাঁর কাব্যসাধনায় ও আদর্শানুসরণে প্রেরণা দিয়েছে, আশা জাগিয়েছে, ভাষা যুগিয়েছে। খলিফা ওমর, তার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন শুধু ধার্মিক বলে নয়, ইসলাম ও মুসলমানদের ভাগ্যবিধাতা বলেও নন, মানুষকে ভালোবেসেছেন বলে :
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু।
বলিয়াছ ভাই–তাই তো
মারে এখন চোখের পানিতে
স্মরি গো সর্বদাই।
এইরূপে আমপারা, মোহররম, ফাতেহা-দোয়াজদহম মরুভাস্কর প্রভৃতি রচনায় কবি ইসলামের ও হজরতের জীবনের মানবতার দিকটি উদঘাটিত করেছেন। ইসলাম ও রসুলের জীবনের এই সৌন্দর্য ও শিক্ষায় তিনি মুগ্ধ ছিলেন। নিজের জীবনে ও সমাজে এই শিক্ষার বাস্তব রূপায়ণেই তাঁর সাধনা নিয়োজিত ছিল।
অতএব নজরুলের ধর্মবোধ স্বাতন্ত্রবুদ্ধি জাগায় না। এ ধর্ম কল্যাণ ও মিলনকামী। এ ধর্ম মোক্ষের সহায় নয়জীবনের অবলম্বন-ঋজুপথের দিশারী ও স্বস্থ জীবনের পাথেয়।
নজরুল-কাব্যে প্রেম
নজরুল ইসলাম ব্যবহারিক জীবন-সমস্যার কবি। সেজন্যেই তাঁর কাব্যে সমস্যানিরপেক্ষ রসসর্বস্বতা বিরল। মানুষের ব্যবহারিক জীবনকে রাষ্ট্রিক পেষণ ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে সহজ মনুষ্যত্বের আলোকে সুন্দর ও আনন্দপূর্ণ করে তোলাই ছিল নজরুলের সাধনা। এজন্যেই তাঁর কাব্যে আমরা উচ্চ দার্শনিকতার সাক্ষাৎ পাইনে। তিনি আদর্শ ও নীতি প্রচার করেছেন, কোথাও তত্ত্ব প্রচার করেননি। তাই তিনি বিদ্রোহী কবি, বিপ্লবী কবি, জনস্বার্থের কবি, মানুষের কবি, মানবতার কবি। কিন্তু দার্শনিক বা মরমী কবি নন। মানুষের আন্তজীবনের রহস্যঘন মূর্তি তিনি অঙ্কিত করেননি, বহির্জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অভাব-অভিযোগের কাহিনী তার কাব্যের উপজীব্য যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। –এ-ই ছিল কবির ব্রত বা সাধনার আদর্শ। তিনি বহির্জীবনকে নির্বিঘ্ন করতে চেয়েছেন, অন্তৰ্জীবনকে নির্ঘ করার সাধনা তার নয়। তবে আশা ছিল–গ্লানিমুক্ত ব্যবহারিক জীবন অন্তবৃত্তিগুলোকে বিকশিত ও সুষমামণ্ডিত করে তুলবে, বহিজীবনের আনন্দ অন্তবৃক্ষের মূলে রস যোগাবে-কাণ্ডে ফোঁটাবে ফুল; দেহকে করবে পুষ্ট, আত্মাকে করবে মহিমান্বিত।