নজরুল আসলে প্রেমিক, প্রতিকূল পরিবেশই তাঁকে সগ্রামী ও মারমুখো করেছে। সে খবর তাঁর মুখেই শোনা যাক্ : যার ইচ্ছায় আজ দেহের মাঝে দেহাতীতের নিত্য-মধুর রূপ দর্শন করেছি, তিনি যদি আমার সর্ব অস্তিত্ব গ্রহণ করে আমার আনন্দময়ী প্রেমময়ী শক্তিকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে এই বিদ্বেষ জর্জরিত…. ভেদজ্ঞানে কলুষিত, অসুন্দর অসুরনিপীড়িত পৃথিবীকে সুন্দর করে যাব। এই তৃষিতা পৃথিবী বহুকাল যে প্রেম, যে অমৃত, যে আনন্দরসধারা থেকে বঞ্চিত; সেই আনন্দ, সেই প্রেম সে আবার পাবে। আমি হব উপলক্ষ্যমাত্র। সেই সাম্য, অভেদ শান্তি, আনন্দ, প্রেম আবার আসবে আমার নিত্য পরম সুন্দর পরম প্রেমময়ের কাছ থেকে। …. বিশ্বাস করো, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসেনি– আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না ….।
এ কারণেই কবির বেদনা-করুণ কণ্ঠে শোনা গেল-বীণা মোর শাপে তব হল তরবার। মানুষের বিরুদ্ধে–সমাজাদির বিরুদ্ধে কবির যে অভিযোগ, তা আজকের মানুষ আমাদেরও। তাই নজরুল, আমাদের হৃদয়রাজ্যের রাজা, নজরুল আমাদের প্রিয় সেনাপতি। নজরুল যেসব সমস্যা তুলে ধরেছিলেন, সেসবের সমাধান-পন্থা আজো আমাদের দৃষ্টির বাইরে। তাই নজরুলের কাব্যে আমাদের মনের কথা–প্রাণের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এসব কারণেই নজরুল-কাব্য আমাদের প্রিয় ও পাঠ্য এবং আমাদের প্রেরণার উৎস। চিত্ত-বিক্ষোভের নিঃসঙ্কোচ প্রকাশান্তের যে দাহ-শান্ত ভাব–তাও হয়তো তাঁর কাব্য থেকে পাই।
—-বিবৃত কথাগুলো আমার বন্ধুরই উক্তি। এগুলোর সঙ্গে আমার মনের বা মতের মিল আছে। মনে না-করাই বাঞ্ছনীয়। এও বলে রাখছি, তার কোনো কথাই আমি বানিয়ে-বাড়িয়ে বা কমিয়ে লুকিয়ে বলিনি।
নজরুল ইসলামের ধর্ম
নজরুল ইসলাম দার্শনিক ছিলেন না। বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞানির্ভরও তিনি নন। একান্তভাবে হৃদয়ধর্মী কবি নজরুলের মধ্যে আমরা যে-শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ দেখতে পাই তা নিতান্ত স্পর্শ-চঞ্চলতা ও অনুভূতিপ্রবণতার দুর্বার গতিজাত। এজন্যেই তাঁর কাব্যে সমাজ ও রাষ্ট্রসচেনতার স্পষ্ট ও ঋজু মূর্তি প্রকাশ পায়নি, ভাঙার গানই তিনি গেয়ে গেলেন, জোড়ার কাজে হাত দিতে পারেননি। তাঁর মধ্যে সুন্দর সুষ্ঠু সমাজজীবনের পরিকল্পনা ছিল না। শুধু সমস্যাই তিনি দেখেছেন, সমস্যার সমাধানও তিনি চেয়েছেন আন্তরিকভাবে, কিন্তু পথের সন্ধান তিনি বাতলিয়ে দেননি। রক্তঝরানোই কর্তব্য বলে মেনে নিয়েছেন : রক্তঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা। কারণ যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস তাদের উৎসাদনই হচ্ছে আশু কর্তব্য। সেইজন্যেই কবির অভিলাষ যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ। তিনি চেয়েছেন মানুষ নির্বিশেষের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও কুসংস্কার মুক্তি। এই মুক্তিকামনার উৎস সমাজবোধ নয়, হৃদয়বৃত্তিজাত সহানুভূতি। তাই তার আবেদনে অকৃত্রিম আবেগ আছে, ঐকান্তিক সাধনার নিদর্শন নেই–যে সাধনা গড়ে তুলতে পারত সুন্দর নির্ঘ নির্বিঘ্ন সমাজ, দিয়ে যেতে পারত মহৎ ও বৃহৎ কোনো অবদান। তাঁর মধ্যে প্রচুর আবেগ, সীমাহীন উত্তেজনা রয়েছে। উত্তেজনা সবসময় ক্ষণস্থায়ী এবং মহৎ ও বৃহৎ কর্মের পরিপন্থী। ফলে বিদ্রোহ সার্থকতার পথ খুঁজে পেল না, বিপ্লব পেল না সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন। উত্তেজনায় সংযমের স্বাস্থ্য থাকে না, থাকে না সুপরিকল্পিত কর্মের প্রেরণা। তাই তিনি উত্তেজনা ও প্রাণপ্রাচুর্য বশে তারুণ্যের, যৌবনের, জীবনের, সুন্দরের বন্দনা করে গেলেও তাদের স্বরূপ চিহ্নিত করে দিতে পারেন নি।
যা পারেন নি, যা দেন নি তা নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। কিন্তু তিনি যা দিয়েছেন, তার মূল্যও অপরিসীম। তিনি সত্তা-অচেতন জড় জাতির জীবনে নতুন করে প্রাণ-স্পন্দন দিয়েছিলেন। দারিদ্র দাসত্ব-অশিক্ষা-শোষণ জর্জরিত স্বদেশবাসীর জন্যে তাঁর আকুলতার সীমা ছিল না, ক্ষোভের ছিল না অন্ত। এই ক্ষোভ ও আকুলতাই তাঁকে বিদ্রোহী ও বিপ্লবী করেছিল। সমাজে-রাষ্ট্রে-ধর্মে যেখানেই তিনি অন্যায় দেখেছেন সেখানেই রুখে দাঁড়িয়েছেন, নির্মমভাবে করেছেন আঘাত, নিঃসংকোচে প্রকাশ করেছেন তাঁর উপলব্ধ সত্যকে, নির্ভীকচিত্তে করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তিনি নিজেই বলেছেন যা অন্যায় বলে বুঝেছি অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কারও তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কারো পিছনে পো ধরি নাই। আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই–সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। (জবানবন্দী)।
নির্যাতিত স্বদেশী লোকের দুঃখবেদনায় সমবেদনা জানাতে গিয়ে কবি বিশ্বের দুর্গত জনসাধারণের হয়ে অন্যায়-অত্যাচরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। ব্যক্তি-চেতনা জাগানো এবং ব্যক্তি-সত্তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর সাধনা। স্ব স্ব মর্যাদায় অধিকারে ও বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত থেকে মানুষ তৈরি করবে মিলন-ময়দান-যে ময়দানে সমবেদনায় সকলে হয়েছে ভাই। নির্যাতিত মুমূর্ষ মানুষকে আত্মচেতনা ও আত্মবিশ্বাস দানই ছিল তার ব্রত। এ ক্রন্দন কী আমার একার? না এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল নীরব ক্রন্দসীর সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের প্রলয়-হুঁঙ্কার একা আমার নয়, সে নিখিল আর্তপীড়িত আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার। (জবানবন্দী)