রবীন্দ্রজীবনের অন্তিম মুহূর্তে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের মরণ কামড় আবার শুরু হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রবাদ প্রসার লাভ করেছে। ধনিক সভ্যতার অবসান-প্রায় সোনার যুগে তার আবির্ভাব আর সমাজতন্ত্রের বিকাশ মুহূর্তে তার তিরোভাব–তাই ইতিহাস ও বিজ্ঞান-সচেতন না হয়ে পারেননি তিনি।
তাঁর ধারণায় : যেখানে symmetry, harmony ও symphony নেই, সেখানে সত্যও নেই। সত্য ও কল্যাণের পথ দুরূহ কিন্তু গন্তব্য নিশ্চিত শান্তির। সত্য যে কঠিন–সে কখনো করে না বঞ্চনা।
কিন্তু সাধারণ লোক যতটা আপাত-প্রয়োজন-সচেতন, ততটা দূরদর্শী নয়–আশু ফল প্রাপ্তিই তাদের লক্ষ্য। এ কারণেই কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্যে তিনি যা-কিছু করেছেন ও করতে চেয়েছেন, তা কৃষকদের মধ্যেও সমাদৃত হয়নি। তাঁর রাজনৈতিক মতও উপহাস পেয়েছে, তার সমাজচিন্তা পেয়েছে অবহেলা।
.
০৭.
আজকের দিনে কে না স্বীকার করে যে, খণ্ড-ক্ষুদ্র হয়ে এ-যুগে কেউ বাঁচতে পারে না। বাঁচবার পক্ষে সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য-ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র সম্বন্ধে এ সত্য সমভাবে প্রযোজ্য। জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে যৌথ রাষ্ট্রব্যবস্থা অবধি সংহতি ও সহযোগিতা লক্ষ্যে গঠিত অসংখ্য সংস্থায় দুনিয়া ভরে গেছে। এ তো সেই বিশ্বানুভূতিরই ফল–সেই বৈচিত্র্যে ঐক্য সন্ধানের, স্বাতন্ত্রে সমন্বয় সাধন প্রয়াসের ও সর্বমানবিকবাদের স্বীকৃতি। অথচ অর্ধশতাব্দী আগে এ তত্ত্ব উচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথ উপহাসই পেয়েছেন। একটি মহাযুদ্ধের তুর্যধ্বনিতে আজ যুগারম্ভের দ্বার খুলেছে।… মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্বন্ধ এক মহাদেশে ব্যাপ্ত, তার মধ্যে সত্যের সামঞ্জস্য যতক্ষণ না ঘটবে ততক্ষণ এই কারণের নিবৃত্তি হবে না। এখন থেকে যে-কোনো জাত নিজের দেশকে একান্ত স্বতন্ত্র করে দেখবে, বর্তমান যুগের সঙ্গে তার বিরোধ ঘটবে, সে কিছুতেই শান্তি পাবে না। এখন থেকে প্রত্যেক দেশকে নিজের জন্যে যে-চিন্তা করতে হবে, সে-চিন্তার ক্ষেত্র হবে জগৎজোড়া। চিত্তের এই বিশ্বমুখী বৃত্তির চর্চা করাই বর্তমান যুগের শিক্ষার সাধনা। (সত্যের . আহ্বান)।
অতীতে আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিত্বকে মনীষা আর মনীষাকে কবিত্ব বলে জেনেছি। তাঁর বিশ্বচেতনা ও অদ্বৈতবোধ Mysticism বলে অবহেলা পেয়েছে আমাদের। তার যুগচেতনা ও যুগসমস্যার সমাধান প্রয়াস কবির স্বাপ্নিক-কাক্ষা বলে হয়েছে উপেক্ষিত। ফলে রবীন্দ্রচিন্তা তাঁর স্বদেশেও গুরুত্ব পায়নি।
আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, নানা বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তাঁর ঔপনিষদিক বসুবৈধ কুটুম্বকম-বাদ আজকের দুনিয়ায় কবি-কল্পিত তত্ত্বমাত্র নয়, অতি গুরুতর তথ্য এবং মানবজীবনের নিরেট সত্য। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের সেই মানবতা, সর্বমানবিকতা বা বিশ্বজনীনতা ও সেই মৈত্রীধর্ম আজ জয়ের পথে, দেখতে পাই।
.
০৮.
পৃথিবীর কোনো একক ব্যক্তির রচনার এমন বিপুল ও বিচিত্র বিস্তার আর দেখা যায়নি। এমন সর্বতোমুখী ও সর্বত্রগামী ভাব-চিন্তা-কর্মও অদৃষ্টপূর্ব। অবশ্য গল্পে-উপন্যাসে-নাটকে-প্রবন্ধে তার সমকক্ষ কিংবা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখক য়ুরোপখণ্ডে বিরল নয়, কিন্তু কাব্যজগতে বিশেষ করে গীতিকবিতার ও গানের ভুবনে তার তুলনা বিরল। অনুভূতির সূক্ষ্মতায়, বৈচিত্র্যে, চিত্রায়ণে, মাধুর্যে, তাৎপর্যে, উৎকর্ষে আর অনেকতায় তাঁর গান ও গীতিকবিতা প্রায়-অনুপম। তাঁর স্বভাষী তার কাছে পেয়েছে সৌন্দর্য দেখার চোখ, সুরুচির পাঠ, মানবতার বোধ ও বিশ্বজনীনতায় দীক্ষা। তার কাছে পেয়েছে তারা মুখের ভাষা, কণ্ঠের সুর, প্রাণের প্রীতি, চরিত্রের দার্ট, আত্মসম্মান বোধ, আনন্দের কাক্ষা ও জীবনে প্রত্যয়। আজকের সংস্কৃতিবান মানবতাবাদী বাঙালি মাত্রই রবীন্দ্রনাথের মানস সন্তান।