এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে
ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে।
অতএব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-চেতনাই রবীন্দ্রচিত্তে বৈচিত্র্যে ঐক্য-তত্ত্বেরও বীজ বুনেছিল। এরই বিকাশে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একত্ব ও একাত্ম অনুভব করেছেন; আর এরই বিস্তারে তার ব্যবহারিক জীবনে তথা সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় বোধে মানবিকতা, মানবতা, সর্বমানবিকবাদ বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা পায়। তাঁর এই মানবধর্মের সমর্থন রয়েছে বলেই উপনিষদ তাঁর প্রিয়। আর ঐক্যতত্ত্বের বিরলতার দরুনই স্মৃতি, পুরাণ ও গীতায় তাঁর অনুরাগ সীমিত।
এই সৌন্দর্যবুদ্ধি কীভাবে তার স্বদেশ, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে ও নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে, তার পরিচয় নেয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
.
০৫.
স্বদেশের ও য়ুরোপের এক যুগসন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এদেশে তখন বুর্জোয়া আদর্শে নগরকেন্দ্রী জীবনচর্যা শুরু হয়েছে। আমি এসেছি যখন … নতুন কাল সবে এসে নামল। ওদিকে সামন্ততন্ত্রী সমাজ ও নৈতিক জীবনবোধ গায়ে গায়ে তখনো অটল। কেননা তখনো গাঁয়ের নিয়তি নির্দিষ্ট জীবনে ইংরেজিশিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি।
বৃটিশ তখন দেশের মালিক, গ্রেট বৃটেনই তখন আমাদের বিলেত। সে বিলেতে শিল্পবিপ্লবের ফলে ফিউডেল সমাজ লুপ্ত; গড়ে উঠেছে বুর্জোয়া সমাজ এবং এই ধনিক সভ্যতা তখন সাম্রাজ্যবাদে পরিণত। সামন্ত ও বুর্জোয়া সমাজে পার্থক্য সামান্য নয়–সামন্তরা ছিল সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু দেশের মানুষের ধন-প্রাণের মালিক, শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক, মান ও ঐশ্বর্যের প্রতিভূ, তারাই সব; আর সব তাদের প্রজা ও মজুর-ক্ষেতমজুর ও আফিসি মজুর।
আর বুর্জোয়াদের আছে বৃত্তি, বিত্ত ও বেশাত। তাদের মুখে হাসি, বুকে বল আর সংকল্পে ভরা মন। তারা আত্মরচনায় ও আত্মপ্রসারে ব্যাকুল। তারা ধনে কেবল ধনী নয়, মানস-সম্পদেও ঋদ্ধ। তারা জিজ্ঞাসু এবং বিজ্ঞান ও যন্ত্রপ্রিয়; কিন্তু কলারসিক, সংস্কৃতিপ্রাণ, কল্যাণকামী, সেবাধর্মী আর মহৎ ও বৃহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ। সামন্ত ছিল কয়েকজন, বুর্জোয়া হল কয়েক লক্ষ। তাদের ঐশ্বর্যের সীমা নেই, তাদের সৌজন্য অতুলনীয়।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধ হচ্ছে বুর্জোয়া জীবনের ও ঐশ্বর্যের সোনার যুগ। দ্বিতীয়ার্ধ এর ক্ষয়ের যুগ– আত্মধ্বংসী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও হানাহানির কাল। য়ুরোপে বুর্জোয়া জীবনের অবক্ষয়কালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। কিন্তু বাঙলাদেশে সে অবক্ষয়ের সংবাদ তখনো পৌঁছেনি। বুর্জোয়া সমাজের আত্মিক ও আর্থিক ঐশ্বর্যের পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ লালিত। বুর্জোয়ার এই প্রাণময়তা, উদারতা, সংস্কৃতিবানতা ও বিলাস-বাঞ্ছ শহুরে বাঙালির হৃদয়-মন হরণ করেছিল।
রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এঁদের মধ্যে প্রধান। এঁরা উভয়েই চাকরি ও ব্যবসা করে সম্পদ অর্জন করেন এবং সবটা সদুপায়েও নয়। এঁরা দুজনেই ছিলেন সাহেব-ঘেঁষা এবং ইংরেজ-প্রীতি এঁদের মজ্জাগত হয়ে উঠেছিল। তবু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল। রামমোহন ছিলেন বিদ্বান ও প্রজ্ঞাবান–এই বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রাণের বাণীটি তিনি বুঝেছিলেন। তাঁর উদারতা, গ্রহণশীলতা ও আন্তর্জাতিক চেতনা তা-ই ছিল সে-যুগে অতুলনীয়।
দ্বারকানাথ বিদ্বান না হলেও বুদ্ধিমান ছিলেন। নতুন যুগের বৈষয়িক প্রসাদে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। তাই শৌখিনতায়, বিলাসিতায়, দানশীলতায় ও সাহেব-প্রীতিতেই তাঁর নতুন জীবনচেতনা অবসিত। মনের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বর্জনশীল, গ্রহণশীল ছিলেন না। তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও আমরা এই রক্ষণশীলতাই কেবল লক্ষ্য করি, তার অধ্যাত্মবুদ্ধি তাকে ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ করেছিল, কিন্তু উদার করেনি। এই অনুদারতার জন্যেই তিনি সাহেবদের এড়িয়ে চলতেন, ব্রাহ্ম হয়েও ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যের ধারক ছিলেন; রামমোহন চরম তাচ্ছিল্যে যে-পৈতার শিকল ছিড়লেন, তিনি নতুন করে সেই পৈতার-বন্ধন স্বীকার করেই গর্ববোধ করলেন। অতএব, রবীন্দ্রনাথ পিতা থেকে উদারতার কিংবা প্রতীচ্য প্রাণময়তার দীক্ষা পাননি।
দ্বিজেন্দ্রনাথ অনেকটা বাপের মতোই ছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বাজাত্যবোধ তাকে অনুদার রেখেছিল, অতএব পারিবারিক প্রভাব রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতা বা সর্বমানবিক বোধের অনুকূল ছিল না। তাই ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম পঁয়তাল্লিশ বছর কেটেছে অন্যের প্রভাবে। এ সময়েও অবশ্য কাব্যের ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্ববোধের প্রকাশ ও বিকাশ নির্দ্বন্দ্ব ও নির্বিঘ্ন ছিল। যদিও কালিদাসের প্রভাবে প্রাচীন ভারত, তপোবন আর ব্রাহ্মণ্য মহিমায়ও তিনি প্রায় সমভাবেই মুগ্ধ ছিলেন, তবু তাতে বিরোধ ঘটেনি, কেননা সেখানেও তিনি ঐশ্বর্যের মধ্যে ত্যাগ; ভোগের মধ্যে সংযম এবং প্রেমের মধ্যে তপস্যার বীজ ও মহিমা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে স্বাদেশিক, স্বাজাতিক ও স্বধর্মীয় গোঁড়ামি তারও প্রশ্রয় পেয়েছে। কৈশোরেই তিনি সঞ্জীবনী সভার সদস্য, হিন্দুমেলার উৎসাহী কর্মী, স্বজাতির ঐতিহ্যগর্বী ও গানের মাধ্যমে স্বদেশপ্রীতি প্রচারে ব্রতী। পারিবারিক জীবনেও অশিক্ষিতা বালিকাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণে কিংবা নিজের বালিকা কন্যার বিবাহদানে কোনো সংকোচ ছিল না তার। তার এই ব্যবহারিক ভুবনে তাঁর চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে–তাঁর পিতা ও তাঁর অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-তিলক প্রমুখ উগ্র স্বাজাত্যগর্বীদের প্রভাবে।