আমার শিশুকালেই বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে আমার খুব একটি সহজ ও নিবিড় যোগ ছিল। বাড়ির ভিতরের নারিকেল গাছগুলি প্রত্যেকে আমার কাছে অত্যন্ত সত্য বলিয়া দেখা দিত।… সকালে জাগিবামাত্রই সমস্ত পৃথিবীর জীবনোল্লাসে আমার মনকে তাহার খেলার সঙ্গীর মতো ডাকিয়া বাহির করিত, মধ্যাহ্নে সমস্ত আকাশ এবং প্রহর যেন সুতীব্র হইয়া উঠিয়া আপন গভীরতার মধ্যে আমাকে বিবাগী করিয়া দিত এবং রাত্রির অন্ধকার যে মাঝপথের গোপন দরজাটা খুলিয়া দিত, সম্ভব-অসম্ভবের সীমানা ছাড়াইয়া রূপকথার অপরূপ রাজ্যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করিয়া লইয়া যাইত। এবং গঙ্গার পালতোলা নৌকায় যখন-তখন আমার মন বিনা ভাড়ায় সওয়ারি হইয়া বসিত এবং যে সব দেশে যাত্রা করিয়া বাহির হইত ভূগোলে আজ পর্যন্ত তাহার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নাই।
কি মাটি, কি জল, কি গাছপালা, কি আকাশ সমস্তই তখন কথা কহিত, মনকে কোনো মতেই উদাসীন থাকিতে দেয় নাই। –[জীবনস্মৃতি]।
আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালোবাসি(ছিন্ন পত্রাবলী ১৩)। পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। (ছিন্ন পত্রাবলী ৯৩)। সৌন্দর্য যখন একেবারে সাক্ষাত্তাবে আত্মাকে স্পর্শ করতে থাকে, তখনই তার ঠিক মানেটি বোঝা যায়, আমি একলা থাকি, তখন প্রতিদিনই তার সুস্পষ্ট স্পর্শ অনুভব করি, সে যে অনন্ত দেশ কালে কতখানি জাগ্রত তা বুঝতে পারি। (-ছিন্ন পত্রাবলী ১৯৭)।
সৌন্দর্য আমার পক্ষে সত্যিকার নেশা। আমাকে সত্যি ক্ষেপিয়ে তোলে।…. সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ার শক্তিরও অতীত; কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাকে, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না। (ছিন্ন পত্রাবলী ২৫)।
শৈশবে-বাল্যে তার মন-আত্মা সৌন্দর্য-সমুদ্রে অবগাহন করে করেই পুষ্ট হতে থাকে। তাঁর নিজের জবানীতে এমনি আরো উদ্ধৃতি দেয়া সহজ, কিন্তু অশেষের পথে এগুব না। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে এমনি রূপদর্শী ও রসগ্রাহী ছিলেন, ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী তার সাক্ষ্য।
.
০৪.
প্রকৃতি বা নিসর্গ অখণ্ড কোনো বস্তু নয়– খণ্ড, ক্ষুদ্র ও বিচিত্র বস্তু ও বর্ণের সমষ্টি মাত্র। কিন্তু তার সৌন্দর্য অখণ্ড সত্তার স্বীকৃতিতেই লভ্য। অতএব, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যানুভূতিই এ সৌন্দর্যবোধের উৎস। শৈশব-বাল্যেই এ বোধে অবচেতন দীক্ষা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
খণ্ড-ক্ষুদ্রকে সামষ্টিক সমগ্রতায় উপলব্ধি করার জন্যে দৃষ্টি ও মননের যে-প্রসার প্রয়োজন, অন্যের পক্ষে যা পরিশীলনেও সম্ভব হয় না–রবীন্দ্রনাথে তা প্রায় অনায়াসলব্ধ। অন্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : The first.stage of my realization was through my feeling of intimacy with nature. (Religion of man). apfo fesat fantas সবকিছুই সুন্দর নয়—হ্রস্ব-দীর্ঘ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সুগন্ধী-দুর্গন্ধী, মরা-তাজা, ভাঙা-মচকানো, ঋজু-বাঁকা, বর্ণালি-বিবর্ণ সব রকমই আছে। কিন্তু সৃষ্টির কিছুই তুচ্ছ নয়, নিরর্থক নয়–এ বোধের বশে যদি কেউ প্রকৃতি-নিসর্গের দিকে তাকায়, তাহলে সর্বত্র একটা রহস্য, একটা কল্যাণচিহ্ন প্রত্যক্ষ করা সহজ হয় :
এ মাঝে কোথাও রয়েছে কোনো মিল
নহিল এত বড় প্রবঞ্চনা।
পৃথিবী কিছুতেই সহিতে পারিত না।
–এই আস্তিক্যবুদ্ধিই মানুষকে জীবন-রসরসিক করে তোলে তখন বিষ আর অমৃতের আপাত বৈপরীত্য ঘুচে যায়–দু-ই জীবনের অনুকূল বলে অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের মুখে তাই শুনি আমি স্বভাতই সর্বাস্তিবাদী–অর্থাৎ আমাকে ডাকে সকলে মিলে, আমি সমগ্রকে মানি। গাছ যেমন আকাশের আলো থেকে আরম্ভ করে মাটির তলা পর্যন্ত সমস্ত কিছু থেকে ঋতু পর্যায়ের বিচিত্র প্রেরণা দ্বারা রস ও তেজ গ্রহণ করে তবেই সফল হয়ে ওঠে– আমি মনে করি আমার ধর্মও তেমনি–সমস্তের মধ্যে সহজ সঞ্চরণ করে সমস্তের ভিতর থেকে আমার আত্মা সত্যের স্পর্শ লাভ করে সার্থক হতে পারবে। (রবীন্দ্র-জীবনী-৩: পৃ. ২৯৪)। জগতের সঙ্গে সরল-সহজ সম্বন্ধের মধ্যে অনায়াসে দাঁড়িয়ে যেন বলতে পারি, আমি ধন্য। যা কল্যাণকর তা-ই সুন্দর, তা-ই শ্রদ্ধেয় এবং তা-ই প্রিয়। এ অনুভবের গভীরতাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর সঙ্গে একত্ব ও একাত্মবোধ জন্মায়। তখন সহজেই বলা সম্ভব যদি জানিবারে পাই ধূলিরেও মানি আপনা। যাকে বিষ বলে জানি, সুপ্রয়োগে তা-ই প্রাণ বাঁচায়, অপপ্রয়োগে অমৃত হতে পারে জীবনঘাতী। দুর্ব্যবহারে ভাইও হয় প্রাণের বৈরী, আবার প্রীতি দিয়ে অরিকেও মিত্র করা সহজ। এ তত্ত্ব একবার উপলব্ধ হলে বিশ্বজগতের প্রাণী ও প্রকৃতির আপেক্ষিকতা তথা জীবনধারণ ব্যাপারে পারস্পরিক উপকরণাত্মকতা হৃদয়-গোচর হয়। তখনই বলা চলে, আমি আছি এবং আমার সঙ্গে আর সমস্তই আছে, আমাকে ছেড়ে এই অসীম জগতের একটি অণুপরমাণুও থাকতে পারে না (ছিন্ন পত্রাবলী ২৩৮)। বোধের এমনি স্তরে প্রাণী, প্রকৃতি ও মানুষকে অভিন্ন সত্তার অংশ বলে না-ভেবে পারা যায় না। এরই নাম বিশ্বানুভূতি, এ তত্ত্বের ধর্মীয় নাম অদ্বৈতবাদ। এমনি করে রবীন্দ্রনাথে বিশ্বানুভূতি বা বিশ্বাত্মবোধ জাগে। প্রভাত উৎসব, বিশ্বনৃত্য, অহল্যার প্রতি, বসুন্ধরা, সমুদ্রের প্রতি, মধ্যাহ্ন, প্রবাসী, মাটির ডাক প্রভৃতি কবিতায় তা সুপ্রকট।