এমনি অবস্থায় তারা যা বলতে বা করতে চেয়েছেন, তাতে তাদের প্রাণগত সাধনা ও স্বজাতিবাৎসল্যের অপরিমেয় আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের সাধ যত ছিল, সাধ্য ততটুকু ছিল না। তাই তাঁদের হাতে তাঁদের অবদানের বাহ্য নিদর্শনস্বরূপ উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু পাইনি। কিন্তু যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য, যে আন্তরিকতা, উদ্যম ও অক্লান্ত সাধনা তাঁদের প্রচেষ্টাকে মহিমান্বিত করে রেখেছে, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধান্বিত না হলে, তাঁদের ঋণ স্বীকার না করলে, আজকের দিনে শুধু জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি নয়, নিজেদের প্রতিও অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের কাছে লিখিত এক পত্রে সৈয়দ এমদাদ আলী বলেছিলেন, যতই ক্ষুদ্র হই না কেন, আমরা সে-যুগে জাতির ভাগ্যাকাশে জ্যোতিষ্কস্বরূপ উদিত হয়ে জাতিকে দিশা দিতে চেষ্টা করেছি। অবিকল কথাগুলো আমার মনে নেই তবে ভাবটা এ-ই। একে কেউ তাঁর অহমিকার অভিব্যক্তি বলে ভাবলে তাঁর উপর অবিচার করা হবে। এতে তাঁর বা তাঁর সতীর্থদের সাধনার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই প্রকাশ পেয়েছে। পুরাতন ও প্রবীণদের আমরা ধরে রাখতে পারব না। কিন্তু পুরোনো ও প্রবীণের অবদানকে আমরা মহামূল্য পাথেয় করে রাখব। তা আমাদের জীবনে ও জাগরণে, সাধে ও সাধনায় কাজে লাগবে।
সৈয়দ এমদাদ আলী গেলেন কিন্তু তার আদর্শ আমাদের মধ্যে চিরন্তন হয়ে থাক–এ-ই কামনা করি।
সৌন্দর্যবুদ্ধি ও রবীন্দ্রমনীষা
০১.
রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য মানুষ। জীবন-প্রভাত থেকে মৃত্যু-মুহূর্ত অবধি তিনি নব নব রাগে বিচিত্র অনুভবে নিজেকে রচনা করে গেছেন। চিন্তার ও কর্মের বহুধা ও বর্ণালি অভিব্যক্তিতে তার জীবন বিপুল, বিচিত্র ও জটিল হয়ে প্রকটিত হয়েছে। বয়স তার যতই বেড়েছে, তার মনের দিগন্তও ততই হয়েছে প্রসারিত। বেড়ে গেছে তার ভাবাকাশের উচ্চতা ও পরিধি এবং সেহেতু হয়তো সরে গেছে সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই বলাকা-পূর্ব কাব্যের, গোরা-পূর্ব উপন্যাসের, অচলায়তন-পূর্ব নাটকের এবং গল্পসপ্তক-পূর্ব ছোটগল্পের পাঠকসংখ্যা যত বেশি, তার পরবর্তী রচনার সমজদার তত কম।
অতএব রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের শুরু আর শেষ একভাবে হয়নি। কোনো সত্যিকার প্রতিভাই ধ্রুবতায় অবসিত হয় না– হতে পারে না। কেননা অভাবিতকে ভাববদ্ধ করা, অচিন্ত্যকে চিন্তাগোচর করা, নিরবয়বকে অবয়ব দান করা প্রতিভার কাজ। প্রতিভা যুগের দান নয়– যুগের স্রষ্টা; অর্থাৎ প্রতিভা যুগের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, যুগকে প্রভাবিত করে। আমরা রবীন্দ্রনাথকে প্রতিভা বলে মানি। তাই তাঁর বক্র, বিপুল ও বিচিত্র সৃষ্টিপ্রবাহ যে-কোনো ঋজু সিদ্ধান্তের প্রতিকূল। আবার ভক্তি ও বিদ্বেষ–দু-ই যথাযথ ধারণা লাভের অন্তরায়। তাই কবির তিরোভাবের পঁচিশো বছর পরে রবীন্দ্র-বিচারে সতর্কদৃষ্টি ও অবিচলিত মন-মননের প্রয়োজন।
.
০২.
রবীন্দ্রনাথ আশৈশব সৌন্দর্যপিপাসু। এ পিপাসায় অনন্যতা আছে। কেননা এ সৌন্দর্যবোধ প্যাগান নয়, গ্রীক নয়, আধ্যাত্মিকও নয়। শৈশবে চাকর নির্দিষ্ট খড়ির গণ্ডি তার শারীর- বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করত বটে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিবাহী মানস-বিহার রোধ করা যায়নি। ফাঁক-ফুকরে প্রকৃতি-নিসর্গ তার হৃদয়দুর্গ দখল করে নিয়েছিল। বাধা ছিল প্রবল, তাই আগ্রহ হল তীব্র, অনুভূতি হল তীক্ষ্ণ। ফাটা দেয়ালের গুল্মফুল, পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছ, আকাশে মেঘের লীলা আর তারার অব্যক্ত বাণী শৈশবে-বাল্যে কবির মন ও হৃদয় হরণ করেছে। তাই আকাশচারিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের শুরু। আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নেমেছেন, ভূমি থেকে ব্যোমযাত্রা করেননি। গোড়া থেকেই অবশ্য মেশামেশি হয়ে গেছে ভূম আর ভূমায়, মাখামাখি ছিল জীবনে আর জগতে। কবি একেই জেনেছেন সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধন বলে। এ বোধের অনুগত ছিল বলেই বিহারীলালের কাব্য বালক-কবির মন জয় করেছিল। আর এ উপাদানের অভাবে মধূসূদনের কাব্য পেল তাঁর অবজ্ঞা।
.
০৩.
প্রকৃতি ও নিসর্গের সৌন্দর্যে মানুষ মাত্রই অম্লাধিক মুগ্ধ। কবিরা অনুভূতিপ্রবণ বলে তাদের উপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রভাব প্রবল। কিন্তু সাধারণ কবিতে তা যতখানি অর্জিতচেতনা, ততখানি অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যানুভূতি নয়। কিন্তু কোনো কোনো কবি-মনে সেরূপ চেতনা গভীর, ব্যাপক ও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। যে প্রকৃতি-চেতনা Words-worth-এর মনে বেদনাবোধ জাগিয়েছে, যে রূপ-অন্বেষা ও প্রেমানুভূতি শেলীকে আকাশচারী করেছে, যে সৌন্দর্যানুভূতি Keats-কে আনন্দিত করেছে, যে রূপমুগ্ধতা বিহারীলালকে তাত্ত্বিক করেছে, সেই সৌন্দর্যচেতনা রবীন্দ্রনাথে এনেছিল এক অনন্য অনুভূতি, একপ্রকারের মুগ্ধতা বা অভিভূতি, সারা জীবনেও কবি যার সীমা-শেষ খুঁজে পাননি। সে রূপ-মাধুরীর অনুভব কবিকে তিলে তিলে নতুন করে তুলেছে।
কৈশোরে কবির একদিন সত্যি সত্যি সৌন্দর্যে সচেতন দীক্ষা হয়েছিল। এক ঊষালগ্নে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়ে গেল, দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দ ও সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল, তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। [জীবনস্মৃতি] –এই সৌন্দর্যানুভূতি তাঁর চারদিন ছিল–এমনি অনুভূতি জেগেছিল আরো একদিন পূর্ণিমা রাতে–সৈকতে, তখন তিনি আমেদাবাদে।