কাজেই
ক্ষ্যাপা, তুই না-জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না-বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।
আমি যেরূপ, দেখ না সেরূপ দীন দয়াময়।
পরমাত্মা এ আত্মারই দোসর। কাছে থাকে, দেখা দেয় না, ধরা যায় না, এ জ্বালা কী হৃদয়ে সয়! তাই ক্ষোভ, তাই বেদনা :
আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
তারে জনম ভর একবার দেখলাম নারে।
কথা কয়রে দেখা দেয় না
নড়ে-চড়ে হাতের কাছে।
খুঁজলে জনম-ভর মেলে না
তাই—
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশী নগর।
এক পড়শী বসত করে।
তার কারণ
জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়,
ধরতে গেলে হাতে কে পায়।
তেমনি সে থাকে সদায় আলেকে বসে।
লালণের কণ্ঠে মানব মনের চিরন্তন কামনা ধ্বনিত হয়েছে :
খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।
কিংবা
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশ বেড়াই ঘুরে।
লালনের ও বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনায় বাউল প্রভাবও কম নয়। তাঁর ভাষাতেই আলোচনা শেষ করছি : (বাউল গান) থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়।… এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে।–এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।
লালনের গান আমাদের মূল্যবান সাহিত্য ও মানস-সম্পদ।
শাহাদাৎ-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য
সবদেশেই পাঠ্যপুস্তক অবলম্বন করেই বিদ্যার্জন শুরু হয়। কিন্তু কোনো কোনো দেশে এর বাইরের বিদ্যাও আয়ত্ত করবার সহজ সুযোগ ঘটে। বাঙলাদেশে আমরা যে-পরিবেশে লেখাপড়া করেছি বা এখনও পল্লী অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে যে-আবহাওয়া বিদ্যমান, তা পাঠ্যবইএর বাইরের বিদ্যার্জনের পক্ষে খুব অনুকূল নয়। কাজেই পাঠ্যবই-এ যাঁদের রচনা থাকে না, তাঁরা যতবড় প্রতিভাই হোন না কেন, নেহাত সাহিত্যানুরাগী ব্যতীত আর কারো কাছে তাদের লেখা দূরে থাক, নামও পৌঁছে না। এজন্যেই শক্তিমান কবি হওয়া সত্ত্বেও মোহিতলাল মজুমদার ও শাহাদাৎ হোসেন শিক্ষিত-সাধারণের কাছে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না।
স্কুলপাঠ্যবইএর উপযোগী কবিতার অভাবহেতু শাহাদাৎ হোসেন বা মোহিতলাল জনপ্রিয় বা প্রখ্যাত কবি হয়ে উঠতে পারেননি। অথচ রবীন্দ্র-যুগে যে-কয়জন বিশিষ্ট কবি বাঙলা কাব্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছেন, এঁরা তাঁদেরই সমস্থানীয়।
যখন স্কুলে পড়ি, তখন পাঠ্যপুস্তকে যাদের রচনা থাকত, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। তাদের এক-একজন মনশ্চক্ষে বিস্ময়কর ব্যক্তিরূপে প্রতিভাত হতেন। এখন বয়োধর্মে শ্রদ্ধাবিগলিত চিত্তের সে-উচ্ছ্বাস হ্রাস পেয়েছে অবশ্য, কিন্তু শ্রদ্ধা জাগরূকই রয়েছে। বাল্যে ও কৈশোরে যে কয়জন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের নাম ও লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, কবি শাহাদাৎ হোসেন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ মৃদঙ্গ এবং উপন্যাস রিক্তার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। মৃদঙ্গের ভাষা বা বক্তব্য বুঝবার বিদ্যা বা বয়স আমার ছিল না। তবু কবির কাব্য! শ্রদ্ধা জাগাবার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট ছিল। রিক্তা গদ্য-বই, উপন্যাস, সুতরাং ভালো তো বটেই!
নানা ব্যাপারে শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলালের মধ্যে মিল আছে, সেজন্যেই শাহাদাৎ হোসেন প্রসঙ্গে মোহিতলালের কথাও মনে জাগে। শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলাল ক্লাসিকধর্মী কবি। তবু তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং য়ুরোপীয় ভাবাদর্শের প্রভাব কম নয়। এতৎসত্ত্বেও তাদের কাব্যে যে-বস্তুটা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে কাব্যের আঙ্গিক বা কবিতার diction। শব্দ চয়নে আশ্চর্য নৈপুণ্য, ছন্দে গাম্ভীর্য ও লালিত্য, ভাবাদর্শের আভিজাত্য, প্রকাশভঙ্গির সৌষ্ঠব ও সংযম তাঁদের কাব্যকে শ্রীমণ্ডিত করেছে। তারা উভয়েই আদর্শবাদী ও শিল্পী। ব্যবহারিক জীবনের রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু-ব্যথা, অথবা নিজের বা মনুষ্য-সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভাব-অনটন, অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনী মোহিতলালের কাব্যে স্থান পায়নি। শাহাদাৎ হোসেনেও খুবই কম। তার কারণ, তাঁরা ছিলেন রোমান্টিক কবি বাস্তব বিমুখ, কল্পলোকবিহারী! তাঁদের কাব্য প্রেরণার উৎস এ জগৎ ও জীবন নয়! প্রত্যক্ষ বাস্তবজীবনের হাজারো দুঃখ-বেদনা-লাঞ্ছনা-হতাশা-গ্লানি ভুলে থাকবার তাগিদে তাঁরা মনোময় কল্পলোক রচনা করে তাতে নির্দ্বন্দ্বে ও নির্বিঘ্নে সানন্দে জীবন উপভোগ করেন–জীবনে; যে কল্পসাধ মিটানো যায়নি, সে সাধ মিটেছে গানে, জীবনে যা অসম্ভব, কল্পনায় ও স্বপ্নে তা-ই সম্ভব ও সার্থক হয়ে উঠেছে। সুতরাং কবি হিসেবে শাহাদাৎ হোসেন মুখ্যত বাস্তবমুখী নন–কল্পাশ্রয়ী। তাঁর সমধর্মী কবি মোহিতলাল বলেন :
জীবন যাহার অতি দুর্বহ, দীন দুর্বল সবি
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সেইজন বটে কবি।
কারণ—এতে
ঘুচে যাবে খেদ, যত ভেদ ভয়,
কায়া আর ছায়াবৃথা সংশয়।
স্বর্গ হইবে ধরা।
শাহাদাৎ হোসেনের হৃদয়েও অমৃতের তৃষ্ণা, তিনিও মর্ত্যের সৌন্দর্যে, ধরিত্রীর যৌবন-লাবণ্যে বিমুগ্ধ হয়ে নেমে আসেন দেবতাদের মতো মর্তবিহারে। ধরণীর আবিলতা ও গ্লানি তাঁকে স্পর্শ করবার পূর্বেই তিনি চলে যান কল্পলোকবাসে। ধুলার ধরায় তিনি অতিথি। ধরণীর বনকুঞ্জে তাঁর আনন্দ প্রবাস চলেছিল মাত্র। কারণ, শ্যামায়িত সৌন্দর্যের ফুল্ল শতদল কবির রূপ-সৌন্দর্য-পিপাসু হৃদয়কে যে আকুল করে তুলেছিল!