মো কো কঁহা ছুঁড়ো বন্দে মৈ তো তেরে পাসমে।
না র্মৈ দেবল, না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাসমে।
জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপন আত্মার পরিশুদ্ধিই খোদা-প্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই এঁদের প্রাথমিক ব্রত। এঁদের আদর্শ হচ্ছে Knoweth thyself, আত্মাং বিদ্ধি–নিজেকে চেনো। হাদিসের কথায় মাআরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু।–যে নিজেকে চিনেছে, সে–আল্লাহকে চিনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা সে-খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে-পরমাত্মা হচ্ছেন–মনের মানুষ, অচিন পাখি, মানুষরতন, মমনুরা ও অলখ সাই (অলক্ষ্য স্বামী) প্রভৃতি। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে-রূপক দেহধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত।
মোটামুটিভাবে সতেরো শতকের দ্বিতীয়পাদ থেকেই বাউল-মতের উন্মেষ। মুসলমান মাধববিধি ও আউলচাঁদই এ মতের প্রবর্তক বলে পণ্ডিতগণের ধারণা। মাধববিধির শিষ্য নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্রই বাউল-মত জনপ্রিয় করেন। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ।
লালনের সঠিক জীবনকথা আজো জানা যায়নি। তাঁর সম্বন্ধে রূপকথার মতো নানা কাহিনী চালু আছে। লালন সম্বন্ধে সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য যে তথ্য পাওয়া যায়, তা এই:: লালন হিন্দুসন্তুতি। অল্প বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি শ্রীক্ষেত্রে তীর্থযাত্রা করেন। ফেরার পথে তিনি বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে পথে ফেলে বাড়ি চলে যায় এবং তাঁর মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দেয়। সিরাজ ফকির নামের এক নিঃসন্তান গরিব লকিবাহক তাঁকে পথ থেকে তুলে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। স্বামী-স্ত্রীর সেবাযত্নে লালন প্রাণে বাঁচলেন। কিন্তু একটি চোখ হারালেন। লালন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু মুসলমানের অন্ন খেয়েছেন বলে ঘরে উঠতে পারলেন না, তাঁর স্ত্রীও জাতিচ্যুত স্বামীর অনুগামী হতে অস্বীকার করলেন। এতে লালনের বিক্ষুব্ধচিত্তে বৈরাগ্য দেখা দেয়। তিনি আশ্রয়দাতা সাধক সিরাজের কাছে ফিরে আসেন ও তাঁকে গুরুপদে বরণ করেন। ১৮২৩ সালের দিকে লালন নানা তীর্থ পর্যটনের পর কুষ্টিয়ার গোরাই নদীর ধারে সেঁউড়িয়া গায়ের জোলাজাতীয় মুসলিম-স্ত্রী গ্রহণ করে এখানেই বাস করতে থাকেন।
কুমারখালির কাছাকাছি কোনো গায়ে লালনের পৈত্রিক নিবাস ছিল। আর সিরাজ সাঁইয়ের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার কালুখালি স্টেশনের কাছাকাছি কোনো গায়ে। ১৭৭৪ খ্রীস্টাব্দে(?) দীর্ঘজীবী লালনের জন্ম এবং ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর শুক্রবারে(?) তাঁর মৃত্যু হয় বলেই অধিকাংশ পণ্ডিতের মত। লালন কায়স্থ সন্তান ছিলেন। কেউ বলেন তাঁর কুল-বাচি ছিল কর, আবার কারুর মতে, দাস। সেঁউড়িয়ায়ই লালন দেহত্যাগ করেন। এখানে তার মাজার আছে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত দুদুশা রচিত লালন চরিত-এর অকৃত্রিমতা নানা কারণে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমী, জামী ও হাফেজের সগোত্র এবং কবীর, দাদু ও রজবের উত্তরসাধক। লালন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তাঁর গান লোকসাহিত্য মাত্র নয়–বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর। আমাদের উনিশ শতকী পাশ্চাত্যমুখিতার জন্যেই তাঁর যথাযোগ্য আদর-কদর হয়নি। তবু আড়াই লক্ষ বাউলের তিনি গুরু–জীবনপথের দিশারী।
লালন বলেন—
এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।
ডুবে দেখ দেখি মন তারে; কিরূপ লীলাময়।
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ এই দেহে তিনি রয়।
অথবা,
দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ।
ডাকলে কথা কয়
তোমার মনের মধ্যে আর এক মন আছে গো
তুমি মন মিশাও সেই মনের সাথে।
রবীন্দ্রনাথও বলেন–
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি
হৃদয় পানে চাইনি।
অথবা,
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারি সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।
কিংবা,
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।
রুমীও বলেন—
-I gazed into my own heart
There I saw Him, He was nowhere else.
আনল হক ধারণার প্রতিধ্বনি শোনা যায় লালনের মুখে–
আপন সুরতে আদম গড়লেন দয়াময়
নইলে কী আর ফেরেস্তারে সেজদা দিতে কয়।…
লালন বলে আদ্য ধরম আদম চিনলে হয়।
এবং আত্মা আর পরমাত্মা ভিন্ন ভেদ জেনো না।
আসল কথা
আপনার আপনি যদি চেনা যায়।
তবে তার চিনতে পারি সেই পরিচয়।
কেননা,
যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন
যেমন বাজায় বাজে তেমন
তেমনি যন্ত্র আমার মন
বোল তোমার হাতে।
জাত-বিচার সম্বন্ধে লালন প্রশ্ন করেন–
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন কয়, জেতের কী রূপ, দেখলাম না নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী-লোকের কী হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনী চিনি কী ধরে?
দেহাত্মবাদী লালন বলেন :
উপাসনা নাইগো তার
দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থ ব্রত যার জন্য।
এ-দেহে তার সব মিলে।